‘বন পুনরুদ্ধারঃ উত্তরণ ও কল্যাণের পথ’ প্রতিপাদ্যে রবিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন দিবস-২০২১
বিশেষ প্রতিবেদকঃ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে সকল ধরনের বন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রতিবছর ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক ভাবে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এবারের আন্তর্জাতিক বন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে- “Forest Restoration: A path to recovery and well-being”; যার ভাবার্থ করা হয়েছে- “বন পুনরুদ্ধারঃ উত্তরণ ও কল্যাণের পথ”। এবার আন্তর্জাতিক বন দিবস উপলক্ষ্যে বন অধিদপ্তরে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমদ শামীম আল রাজী।
অনুষ্ঠানে বন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানে সামাজিক বনায়নে উপকারভোগীদের মাঝে চেক বিতরণ করা হবে।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ শুরু করেছিলেন। দেশজুড়ে বৃক্ষরোপণ, উপকূল সংরক্ষণে বনায়ন, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী ও অন্যান্য জলাভূমি সংরক্ষণ, ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম প্রতিষ্ঠাসহ প্রকৃতি ও মানুষের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগী কর্মকাণ্ড দৃষ্টান্তমূলক ও প্রশংসার দাবিদার।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর এসকল উদ্যোগ স্মরণীয় করে রাখতে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ২০২০ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনগণের মাঝে বিনামূল্যে ১ কোটি চারা বিতরণ করা হয়েছে। জাতির পিতার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার দেশের বিদ্যমান বনাঞ্চল সংরক্ষণ এবং বনায়ন কার্যক্রম জোরদার করেছে। জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেকসই বন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ ও বনের প্রতিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লক্ষ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৫.৫৮%। এর মধ্যে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লক্ষ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের প্রায় ১০.৭৪%। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এবং জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট আয়তনের ২২.৩৭% এ উন্নীত হয়েছে।
যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪% এর বেশি উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, কৃষিভূমি সম্প্রসারণ, আবাসন প্রভৃতি নানা কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। ফলে দেশের বন ও বন্যপ্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন। সারা দেশে বনভূমির অবৈধ ভাবে দখলের প্রবণতা দেখা যায়।
দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ১,৩৮,৬১৩ হেক্টর জবরদখল হয়ে গেছে। অবৈধ জবরদখল উচ্ছেদের মাধ্যমে বনভূমি পুনরুদ্ধার ও তা সংরক্ষণে সরকার কাজ করছে এবং ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমানে অবৈধ দখলে থাকা বনভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে । সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় সরকার এ বিশেষ কার্যক্রমে সফল হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে উঠা চরে বনায়নের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে ১৬০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ভূমি দেশের মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ২০০০ বর্গ কিলোমিটার উপকূলের নতুন জেগে উঠা চরে বন সৃজন করা হয়েছে। এসব বন একদিকে যেমন সবুজ বেষ্টনী হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করছে, অন্যদিকে উপকূলীয় জেলাসমূহে পর্যটনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ পর্যন্ত সামাজিক বনায়নের আবর্তকাল উত্তীর্ণ গাছ আহরণ করে ১,৬৮,৫৬৪ জন দরিদ্র উপকারভোগীর মধ্যে ৩৫৬ কোটি ৮২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫২২ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। একসময় যারা লোক চক্ষুর আড়ালে বন নিধনের কাজে ব্যস্ত থাকত, তাদের অনেকেই এখন এই কর্মসূচির আওতায় নিশ্চিত উপকারভোগী হওয়ায় বন অধিদপ্তরের সাথে হাতে হাত রেখে বনজ সম্পদ সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। ভূমিহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের খাদ্য, জ্বালানি, আসবাবপত্র ও আবাসন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। বনায়নে বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতিকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে।
অবক্ষয়িত ভূমি ও প্রান্তিক ভূমিতে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নারীদের সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে বন অধিদপ্তর অভূতপূর্ব সাফল্য অর্র্জন করেছে। সামাজিক বনায়ন বিধিমালা, ২০০৪ অনুযায়ী ৩০% দুঃস্থ নারী উপকারভোগী হওয়ায় সুযোগ পেয়ে থাকেন। রক্ষিত এলাকা সহ-ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৭ অনুযায়ী গ্রাম সংরক্ষণ দল, পিপলস্ ফোরাম, সহ-ব্যবস্থাপনা সাধারণ ও নির্বাহী কমিটির প্রতিটি পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
বর্তমান সরকার সুন্দরবন সংরক্ষণে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ফলে সুন্দরবনের বৃক্ষ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় বন জরিপের তথ্যমতে সুন্দরবনে মোট কার্বন মজুদের পরিমাণ ১৩৯ মিলিয়ন টন, যেখানে ২০০৯ সালে পরিচালিত জরিপ অনুসারে এর পরিমাণ ছিল ১০৭ মিলিয়ন টন।
এছাড়া বন সেক্টরে কার্বন নির্গমন হ্রাস করার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সামিল হয়েছি। সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া মাত্রই দ্রুত সাড়া দেয়া সম্ভব হচ্ছে। স্মার্ট পেট্রোলিং এর আওতায় জিপিএস এর পাশাপাশি ড্রোন ব্যবহারের কার্যক্রমও ইতোমধ্যেই হাতে নেয়া হয়েছে। প্রতিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিবেচনায় আমাদের টিকে থাকার জন্য প্রাকৃতিক বন পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে তৃণমূল পর্যায়ে আরো সচেতনতা বাড়াতে সরকার কাজ করছে, এলক্ষ্যে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। স্ব স্ব অবস্থান থেকে বনায়ন কার্যক্রম আরো বেগবান করতে হবে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত নির্মাণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলা করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী নির্মাণ ও মানবজাতির কল্যাণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।