অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক ঘর থেকেই – শাহানা সিরাজী

PicsArt_03-08-12.02.00.jpg

অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক ঘর থেকেই – শাহানা সিরাজী

১.
‘এক নারী কখনো কন্যা কখনো জায়া কখনো জননী
তবু নারীর চোখের জল এখনো থামেনি!’

প্রশ্ন হতে পারে কেন নারীর চোখের জল থামেনি কিংবা থামে না? নর এবং নারী একে অপরের পরিপূরক। যাপনের প্রতিটি মুহূর্তেই প্রয়োজন একে অপরকে সহযোগিতা করা, পাশে থাকা, ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে মানসিক শক্তি যোগানো। কিন্তু আমাদের সমাজে তা হচ্ছে না। বরং একজন অপর জনের প্রতিপক্ষের ভূমিকায় দাঁড়ায়। জীবন নামের পাগলা ঘোড়ার অর্থ অনর্থ হয়ে যায়। এজন্য এককভাবে নরকে দায়ী করলে তা মারাত্মক ভুল হবে!

নারী নিজেই এখনও নিজেকে মানুষ ভাবার মতো মানসিকতা ধারণ করে না। শৈশব থেকে মা-নারী কন্যা-নারীকে শেখায় কী ভাবে নিজেকে নারীর মতো বেঁচে থাকতে হয়, কী ভাবে ভালো খাবার, ভালো পোশাক ভাইকে দিয়ে দিতে হয়, কী ভাবে নিজের লেখাপড়ার জায়গা ভাইকে ছেড়ে দিতে হয়। সংগত কারণে কন্যা- নারী নিজেকে মানুষ না ভেবে অসহায় দুর্বল সন্তান উৎপাদনের মেশিন মনে করে! বয়সের একটি সময় ভালো-লাগাবোধ যখন আসে তখনই তাকে বয়সের , সম্পদের তফাৎ থাকা সত্ত্বেও বিয়ে দিয়ে দেয়। সেখানে সে এডজাস্ট করতে না পারলে তারই দোষ হয় এবং সে দোষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্বাশূড়ি-নারী , ননদ-নারী,জা-নারীর কাছ থেকেই আসে। এই তিন নারীই স্বামী-নর, শ্বশুর-নর, দেবর-ভাসুর-নরকে ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে দেখা যায় খুব সামান্য কারণেই বউ-নারী জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে যায়। এর ফল হলো, হয় সুইসাইড করে নয় মেরেই ফেলে। আবার বিপরীত চিত্রও আছে বউ নারীর অত্যাচারে শ্বাশুড়ি – নারী মনের দুঃখে গৃহত্যাগী হয়। এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন নারীও অন্য নারীকে অত্যাচার করার জন্য প্রভাবিত করে।

২.

বেগম রোকেয়া দুশো বছর আগেই বলেছেন- জাগো ভগিনী জাগো… নারী যদি নারীকে সম্মান করতো, নারী যদি নিজেই নিজেকে সম্মান করতো এবং মানুষ ভাবতো তাহলে নারীর অধিকার আপনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতো।

যে পুরুষ নারীর গর্ভজাত সে পুরুষ কী করে নারীকে মুক্তি দেবে! কেনই বা তার কাছেই আমরা মুক্তি চাই!

নর এবং নারী শারীরিক গঠনে ভিন্ন বলে দৈহিক শক্তি বেশি বা পেশী শক্তি বেশী। নারী আর পুরুষ যুদ্ধ বাঁধালে পুরুষ জিতে যাবে। খুবই স্বাভাবিক। এই জিতে যাওয়াই পুরুষকে বানায় অসুর। কিন্তু ডাক্তারি হিসেব মতে প্রতিটি মানব সন্তান সমান সংখ্যক নিউরন নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সে মানব সন্তানের বিকাশের পরিবেশ এবং প্রতিবেশের উপর নির্ভর করেই তার মনোজগৎ তৈরি হয়, চিন্তনের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়, দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয় কিংবা বলা যায় উন্নত রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
নারীর বেড়ে ওঠার কুঞ্চিতক্ষেত্রের কারণেই নারী বৃহত্তরক্ষেত্রের চিন্তা করতে পারে না। যারা পেরেছে তারা সমাজ এবং পরিবার থেকে চ্যূত হয়েছে। কিংবা ক্রমাগত যুদ্ধ করে করে টিকে থাকে। পরিবার সমাজ তাকে কোন ভাবেই সহযোগিতা করে না।

বেগম রোকেয়া মা নয় ভাই এর সমর্থনে পড়াশোনা করেছেন একান্তই নিজের মতো করে, স্বামী মারা যাবার পর তিনি বেগম রোকেয়া হয়ে উঠতে পেরেছেন। বেঁচে থাকলে শাখাওয়াত হোসেন তাঁকে বেগম রোকেয়া হয়ে চিরজাগ্রত নারীর কাতারে আসতে দিতেন কী?

প্রীতিলতা তার মায়ের বা পরিবারের সহায়তায় নয় বরং মাস্টার দা সূর্য সেনের সাহসেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে অমর হয়েছেন। প্রীতলতা বিয়ে করে সাধারণ নারীর মতো কেবল সন্তান উৎপাদনে নিমগ্ন থাকলে আজ আমরা তার নাম জানতে পারতাম না। তার মায়ের হাজার অভিযোগ ছিলো, পাড়া প্রতিবেশীর টিটকারি ছিলো, বুড়ো হয়ে যাচ্ছে তবু বিয়ে করছে না কেন? এখানেও নর এর চেয়ে উৎসুক নারীরাই তাকে সূচের মতো বিঁধেছে।

নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া, সরোজিনী নাইডু ইতিহাস হয়ে আছেন একান্তই তার নিজের প্রচেষ্টায়। তার মা বহুবার বলেছে , তার কেন এতা রাজনীতি করা লাগবে! কিন্তু নাইডু মেট্রিক পাশ করার পর দুবছর কলেজে ভর্তি না হয়ে বিভিন্ন ধারার লেখাপড়া করে নিজের ভেতর স্বদেশ প্রেম জাগ্রত করেছেন। জেল খেটেছেন। তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম ভারতীয় মহিলা সভাপতি হন।তিনিই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর প্রথম ভারতের উত্তর প্রদেশর রাজ্য পাল নিযুক্ত হন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অংশ নেন। নাইডুর কথাই চিন্তা করলে দেখা যাবে যার চেতনা দেশ এবং দেশের কল্যান তার অন্য নারীকে অত্যাচারের সময় কোথায়!

৩.

আমরা ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈর খবর জানি। প্রতি পক্ষের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে। শুধু যুদ্ধ করছে তা নয় যোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে । সবাই ভাবছে কে এই যোদ্ধা ? পরে দেখা গেলো তিনি আর কেউ নন স্বয়ং ঝাঁসির রাণী লক্ষী বাঈ। পি শিঠেশু সন্তান বেঁধে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেই যাচ্ছেন।

এসব সফল নারীর গল্প একদিনে কিংবা সহজে তৈরি হয়নি! পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারক ও বাহক স্বয়ং নারী নিজেই। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত নারীরাই এক অপরকে দাবিয়ে রাখা, ভোগ্য পণ্যের মতো নিজেদের উপস্থাপন করার মতো নিকৃষ্ট কাজগুলো করে যাচ্ছে। বাবার গৃহে যেমন বাবা স্বপ্ন দেখে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে হবে তেমনি সে বাবার চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত মা- বোন –দাদী- নানী- ভাবী সব নারীই চিন্তা করে কবে বিয়ে দেবে কবে সে সংসারী হবে! যেন নারী মাত্রই ইন্ডাস্ট্রি এবং বাবুর্চি। অধিকাংশ নারী জানেই না তারও আর্থিক প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। স্বামী মারা গিয়েছে। আহা কী ভালো স্বামী ছিলো! বাড়ির দরজায়ও যেতে দিতো না ! এখন বেচারী কী করবে? ভায়ের গলগ্রহ হবে? দেবর- ভাসুরের গলগ্রহ হবে নাকি কোন কাজ করবে? কাজ করার যোগত্যতা তো তার নেই? সুতরাং জামা সেলাই করো, কাঁথা সেলাই করো, বাড়ি বাড়ি কাজ করো ! এ যে যুদ্ধ করতে হচ্ছে পিতৃগৃহে নারী সন্তানকে পুত্র সন্তানের মতো মানুষ করলে তা করতে হতো না। তার নিজস্ব আইডেনটিটি থাকতো। নারীরাও পারে সব কাজ করতে। অথচ তাকে করে রাখা হয়েছে কেবলই অন্যের মনোরঞ্জনের একটি উপাদান মাত্র ! সেখানেও নারীর ইচ্ছার গুরুত্ব কেউ দেয় বলে মনে হয় না। নারী হয়তো এ জীবনে কখনো প্রকৃত জীবনের স্বাদই পায়নি!
দৈহিক শক্তির বাহাদুরি দেখানোর কোন কারণ নেই কারণ এটাই নেচার। নইলে প্রজনন হতে পারতো না!

বর্তমান আরো ভয়াবহ। নারীরা বেরিয়ে আসছে । বাইরে কাজ করছে। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। আমরা নুসরাত হত্যার কথা জানি। সেখানে ওই পুরুষ একা নুসরাতকে হত্যা করতে পারতো না যদি না তার বান্ধবী ওই বদখত প্রিন্সিপালকে মদদ না দিতো!

এমনি প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোন না কোন নারী আছে যে ইন্দন দিচ্ছে, মদদ যোগাচ্ছে। ঘরে এবং বাইরে। এর প্রকৃত কারণ নারী শিশুকে সঠিক ভাবে বেড়ে উঠতে না দেয়া এবং পুরুষ শিশুর সমস্ত অন্যায় আবদার মেনে নেয়া। নারী শিশুটি নিজ পিতৃগৃহে বঞ্চিত হতে হতে সে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে। ফলে প্রথমেই স্বামী নামকপুরুষটির উপর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে, তারপর তার আশেপাশে যারা ভালো থাকার চেষ্টা করছে তাদের ভেতর কানকথা মনকথা ছড়িয়ে বিষ উদগার করে সাংসারিক শান্তি নষ্ট করে থাকে।

বাইরের পুরুষগুলোর উপর চালায় নানাবিধ কুটকৌশল। এতে এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ তারা লাভ করে! এটা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক নয় বরং বিকৃত রুচির বহিঃপ্রকাশ।

আজকাল পিতারাও মেয়েদের নানাভাবে হেয় করছে। তার চাক্ষুষ প্রমাণ চারপাশে রয়েছে।

৪.

চাকুরিজীবী নারীরাও পারে না সে মানসিক বৈকল্য থেকে বেরিয়ে আসতে। দেখা যায় অফিসের বস এমন আচরণ করছে তার ভালো লাগছে না, ভেতরে ভেতরে তেঁতে ওঠে। চান্স পেলেই কামড় বসায়। আবার অনেক পুরুষ আছে বস নামের কলংক। নারীকে মানুষ নয় বরং একখণ্ড মাংসপিণ্ড মনে করে। আবার নারীরাও অধিকার সচেতন হয়ে চাকুরি করবে তা যেন পারেই না। তাই যদি না হবে তাহলে জামাল পুরের ডিসির একান্ত কক্ষে সে নারী কেন গেলো? ডিসির অন্যায় আবদারের প্রতি সে কেন রেসপন্ড করলো? আমরা জানি সেই ডিসির শাস্তি হয়েছে। তার গ্রেড ডাউন করে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু নারীও কী অপরাধী নয়?

আবার ডিসি সুলতানার কথাই ধরেন, অন্যায়গুলো সাংবাদিক আরিফ প্রকাশ করতে চাচ্ছে এই অপরাধে তাকে দিগম্বর করে পেটানো কতোটা হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে! এসব মনোবৈকল্য ছোটবেলা থেকে তাপেচাপে কাবু হয়ে থাকার দরূন হয়েছে।

অনেকেই বলে, অমুকে নারীকে অধিকার দিয়েছে, তমুকে নারীকে অধিকার দিয়েছে। আমি বলি বাপু তুমি আমার গর্ভ থেকে বেরিয়েছো , তুমি কে আমাকে অধিকার দেয়ার! অধিকার আমার জন্মগত। আমি কানা, অন্ধ তোমাদের ভালোবাসি তাই সে সুযোগে আমার স্বাধীনতা তোমরা হরণ করছো। আমাকেই আজগবি পোশাকে নিজেকে আবৃত করে রাখতে হবে! কেন বাপু? আমাদের দেখলে যদি তোমার সমস্যা হয় তাহলে তুমি মানুষ কেন? তুমি তো কেবল কামনা বাসনার কারখানা। সব সময় তোমর খেবল খাই খাই। মানসিক পরিবর্তন তোমার প্রয়োজন। একই রকম ভাবে নারীরও পরিবর্তন প্রযোজন।

চাকুরিজীবী নারীরা নিজের সিকিউরিটি নিজেই মেনটেইন করতে পারেন। আয়ের পুরো অংশ স্বামী সন্তানের জন্য খরচ না করে নিজের জন্য একটি অংশ রেখে দেয়াই উত্তম। কারণ আপনি জানেন না জীবনের কোন বাঁকে কোন দুঃখ আপনার জন্য ওৎ পেতে আছে। হাতের পাঁচ ছেড়ে দিয়ে কেন যন্ত্রণা সহ্য করবেন!

বিড়ালের গলায় ঘন্টা কে বাঁধবে?

ঘন্টা বাঁধার কাজটি গৃহ থেকেই শুরু হোক। নারীশিুশু পুরুষশিশুর মাঝে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য না থাকুক। বৈষম্যের কারণেই নারীর ভেতর ঘৃণা, হিংসা, ক্রোধ ক্রমাগত ভাবে বাড়তে থাকে যার প্রকাশ ঘটায় তারা প্রতি পদে পদে। ফলে দেখা যায় নারীকে নারীই নির্যাতন করছে। পুরুষ সুযোগ পেয়ে তাদেরকে খেলনা বানাচ্ছে মাত্র! খেলা শেষ ছুঁড়ে দিচ্ছে ডাস্টবিনে।
যদি পুত্র সন্তান নিজ গৃহে দেখে তার বাবা তার মাকে সম্মান করছে, দাদীকে সম্মান করছে, বোনকেও একই ভাবে বেড়ে উঠতে দিচ্ছে সে পুরুষ কখনোই কোন নারীকে নির্যাতন করতে পারে না!

মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ মূল্যবোধ মুখস্ত করে কেউ অর্জন করে না । দেখে দেখে অর্জন করে। আপনি পিতা মাতা হিসেবে আপনার কন্যা এবং পুত্রের প্রতি কতোটা ন্যায়পরায়ণ তা নির্ধারণ করবে আপনার সন্তানের মূল্যবোধ। পুত্র সন্তানকে যেমন প্রোভাইড করে দেয়ার চিন্তা থাকে তেমনি কন্যাসন্তানকেও অর্থনৈতিক ভাবে প্রোভাইড করে দিন। কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া নারীর স্বাধীনতা কখনো আসবে না। বিয়ে দেয়া এমন জরুরী নয় যতোটা জরুরী লেখাপড়া শিখিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এতে আখেরে আপনারই লাভ। কন্যা ভালো না থাকলে আপনি কী ভাবে ভালো থাকবেন?

আসুন আমরা পিতারা নারীকে সম্মান করি মাতারা কন্যাকে পুত্রের মতোই একই রকম ভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করি।

মানুষের প্রতি সদয় হওয়াই ধর্ম।

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর(সাধারণ)
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top