সরকারী চাকুরীতে তদবির ঠেকাতে কঠোর সিদ্ধান্ত আসছে
বিশেষ প্রতিবেদকঃ বদলি পদায়নের তদবির শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, মেডিকেল রিপোর্ট দিয়ে পোস্টিং বাতিল কিংবা পদায়ন চাইলে তা এসিআর ডোসিয়ারে সংরক্ষিত থাকবে।
সীমাহীন তদবির চাপে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এবার সত্যিই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যাতে কোনো কর্মকর্তা বদলি-পদায়নের জন্য তদবিরই করতে না পারেন সে পথ একেবারে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এ সংক্রান্ত কঠোর অনুশাসন সংবলিত বিশদ নীতিমালার খসড়া প্রায় চূড়ান্ত।
এ মাসে সম্ভব না হলেও ডিসেম্বরে এটি চূড়ান্ত হবে। পহেলা জানুয়ারি থেকে যাতে কার্যকর করা যায় সে রকম টার্গেট নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি।
চূড়ান্ত হওয়া ১৫ পাতার এ নীতিমালার খসড়া প্রস্তাবনায় মোটা দাগে বলা হয়েছে, কোনো কর্মকর্তা তার কিংবা অন্য কারও বদলি-পদায়নের জন্য তদবির করতে পারবেন না। শুধু অসুস্থতা এবং স্বামী-স্ত্রী এক স্টেশনে চাকরি করার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা লিখিত আবেদন করতে পারবেন। তাও সেটি বিবেচনা করবে একটি নির্দিষ্ট কমিটি। কিন্তু একবার কাউকে কোথাও বদলি করলে তাকে অবশ্যই সেখানে যোগ দিতে হবে।
আর যোগদান না করে সেটি বাতিল কিংবা নিজের পছন্দের জায়গায় পোস্টিং নিতে কোনো প্রকার তদবির কিংবা চাপ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সেটি চাকরি শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কাউকে স্ট্যান্ড রিলিজ কিংবা যেদিন থেকে তাকে অবমুক্ত করার কথা বলা হবে, সেদিনই তাকে রিলিজ নিতে হবে।
এ আদেশ কেউ অমান্য করলে তার বেতন বন্ধ রাখাসহ চাকরি অসন্তোষজনক হিসেবে রিপোর্ট করা হবে। নেতিবাচক এ প্রতিবেদন পদোন্নতির সময় মূল্যায়ন করা হবে। অর্থাৎ এ ধরনের কর্মকর্তার জন্য পরবর্তী পদোন্নতির বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হবে।
কোনো কর্মকর্তা মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিয়ে পদায়ন বাতিল কিংবা কাক্সিক্ষত স্থানে পোস্টিং চাইলে তা তার এসিআরের ডোসিয়ারে নোট আকারে সংরক্ষণ করা হবে। পরে সেটি তার এসিআর ফরমের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হবে।
এছাড়া কোনো কর্মকর্তার লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বদলির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তাকে মাঠ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট পর্যায়গুলোর মেয়াদ পূরণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই মেয়াদপূর্তির ৩ মাস আগে অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে হবে। কর্মকর্তাদের এ ধরনের লিখিত আবেদন বিবেচনা করার জন্য প্রতি ২ মাস অন্তর একটি সভা করে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।
বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে মেধা-যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়নসহ সমগ্র চাকরি জীবনে একটি ভারসাম্যের নীতি বহাল রাখাই হবে এ নীতিমালার মৌলিক উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মেধা-যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একজন কর্মকর্তা চাকরি জীবনের বেশির ভাগ সময় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করবেন, আর একজন সব ভালো পোস্টিং এনজয় করবেন, তা হবে না। এক্ষেত্রে সমনীতি কার্যকর করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ক্যারিয়ার প্ল্যানিং উইংকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ উইংয়ের মাধ্যমে কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কর্মজীবনের বাস্তব দক্ষতাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মূল্যায়ন করে প্রত্যেক কর্মকর্তার বিষয়ে পৃথক গোপনীয় রোডম্যাপ সংরক্ষণ করা হবে। এছাড়া একজন কর্মকর্তা যাতে ঘুরেফিরে মাল্টিপোস্টিং তথা অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন সে ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
তবে বদলি ও পদায়ন নীতিমালায় ভারসাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠা করতে জেলা ও উপজেলাগুলোকে ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ‘ক’ শ্রেণির জেলা ২৫টি, ‘খ’ শ্রেণির ২০টি এবং ‘গ’ শ্রেণির ১৯টি। এভাবে উপজেলাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি এজন্য করা হয়েছে, যেন কোনো কর্মকর্তাকে ঘুরেফিরে ৩ শ্রেণির জেলা-উপজেলায় পোস্টিং দেয়া যায়।
প্রস্তুত করা নীতিমালাটি প্রথমদিকে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের জন্য করা হলেও বর্তমানে সেটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদায়ন নীতিমালা হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যত ধরনের বদলি ও পদায়নের এখতিয়ার রাখে সেখানে এটি প্রযোজ্য হবে। কেননা, বিভিন্ন ক্যাডার থেকে অপশন দিয়ে অনেকে প্রশাসন পুলের উপসচিব পদে যোগ দিয়ে থাকেন।
নীতিমালায় কয়েকটি পদে পদায়নের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা সন্নিবেশিত থাকবে। এরমধ্যে নিজ বিভাগ ব্যতীত সহকারী কমিশনারদের (শিক্ষানবিস) অন্য বিভাগে পদায়ন করতে হবে। কমপক্ষে ২ বছর শিক্ষানবিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রশাসনিক কারণ ছাড়া এ সময়ে অন্যত্র বদলি করা যাবে না। তবে তা হবে কমিটির সুপারিশে।
চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর জ্যেষ্ঠতা বজায় রেখে সহকারী কমিশনার (ভূমি), সহকারী কমিশনার পদে পদায়ন করতে হবে। এ পদে তিনি সর্বোচ্চ ২ বছর দায়িত্ব পালন করবেন। এরপর তাকে বিভাগীয় কমিশনার অথবা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবশ্যিকভাবে পদায়ন করতে হবে।
সিনিয়র স্কেলপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য হতে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর/চার্জ অফিসার/জেসিও পদে পদায়ন করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে এসি ল্যান্ড পদে যারা বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু এসি ল্যান্ড হিসেবে তিনি যে জেলায় কর্মরত ছিলেন তাকে সেই জেলা ব্যতীত অন্য জেলায় পোস্টিং দিতে হবে।
এছাড়া সিনিয়র স্কেলপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য হতে জেলা পরিষদের সচিব/পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে পদায়ন করতে হবে। এজন্য তাদের চাকরি যথারীতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হবে।
অপরদিকে সিনিয়র স্কেল প্রাপ্তি এবং চাকরির মেয়াদ কমপক্ষে ৬ বছর পূর্ণ হওয়ার পর একজন কর্মকর্তাকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে পদায়নে ফিটলিস্টভুক্তির জন্য বিবেচনা করা যাবে। তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাকে তার নিজ এবং স্বামী বা স্ত্রীর জেলা ব্যতীত অন্য কোনো জেলায় পোস্টিং দিতে হবে। এ পদে তার সাধারণ কর্মকাল হবে ২ বছর। তবে কোনো ইউএনওকে একই জেলায় একাধিক উপজেলায় পদায়ন করা যাবে না।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনারসহ মন্ত্রী ও সচিবদের পিএসসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের পদে পদায়নে বিস্তর গাইডলাইন রয়েছে এ নীতিমালায়।
পদায়ন নীতিমালা প্রস্তুত করতে ৩ মাস আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডিকে (অতিরিক্ত সচিব) প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে এপিডি উইং ছাড়াও সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি উইংয়ের কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করা হয়েছে।
এ কমিটি সর্বশেষ বৈঠক করেছে ২৯ অক্টোবর। আশা করা হচ্ছে, আরও ২-৩ বৈঠক হওয়ার পর নীতিমালা চূড়ান্ত হবে। ইতোমধ্যে খসড়া আকারে যা চূড়ান্ত করা হয়েছে সেখানে নীতির সারমর্ম চলে এসেছে। এখন শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ঘষামাজার কাজ চলছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বাদ পড়েছে কিনা বা কোথাও কোনো ফাঁক-ফোকর থাকলে সেটি বন্ধ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো গানমাধ্যামকে জানায়, দীর্ঘদিন থেকে বদলি-পদায়নের সীমাহীন তদবিরের চাপে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় রীতিমতো অতিষ্ঠ। সাধারণ কিছু গাইডলাইন বিদ্যমান থাকলেও সেটি কেউ আমলে নিতে চান না। যে যার সুবিধামতো কাক্সিক্ষত পোস্টিং বাগিয়ে নিতে সম্ভব সব কিছু করতে মরিয়া। এক কথায় বলা যায়, যে বা যাদের খুঁটির জোর যত বেশি, তাদের কব্জায় বেশির ভাগ প্রাইজ পোস্টিং।
এর ফলে অন্যতম রেগুলেটরি মন্ত্রণালয় হিসেবে যেখানে মেধাসম্পন্ন শক্তিশালী প্রশাসন গড়ে তুলতে এ মন্ত্রণালয়ে গবেষণাধর্মী বিভিন্ন পলিসি প্রণয়নের কথা, সেখানে তাদের তদবির বাস্তবায়ন করা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। যদি ১০ জন দর্শনার্থী ফেস করি তাহলে ৭ জনই আসেন তদবির নিয়ে।
এক কথায়, রীতিমতো রুটিন কাজের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে তদবির। এছাড়া তদবির নিয়ে প্রতিদিনই এমন সব গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় থেকে ফোন আসতে থাকে যে, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হোক বা না হোক আমলে না নিয়েও উপায় থাকে না। বিষয়গুলোতে এতটাই গুরুত্ব দিতে হয় যে, প্রতিদিন অফিসের নোট প্যাডে দিন-তারিখ দিয়ে তা লিখে রাখতে হয়।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এ নীতিমালা প্রণয়নের পেছনে বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। তারা যথাযথ পরামর্শ দিয়ে চূড়ান্ত হতে যাওয়া নীতিমালাকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এছাড়া জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন সব সময় এটি মনিটরিং করছেন। তারা মনে করেন, এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে বেশিরভাগ কর্মকর্তা খুশি হবেন।
পাশাপাশি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আরও শক্ত ভিত অর্জন করবে এবং প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়নে আরও বেশি সক্রিয় হতে পারবে। শুধু নানা রকম প্রভাব খাটিয়ে যারা এতদিন ফায়দা নিয়ে আসছেন তাদের পথ রুদ্ধ হবে। কর্মকর্তাদের মধ্যে পর্দার আড়ালে গড়ে ওঠা কথিত কোনো নেতা কিংবা বিশেষ গ্রুপের ভূমিকা রাখার সুযোগও চিরতরে বন্ধ হবে। কর্মস্থলে সবাই প্রাপ্য মর্যাদা নিয়ে কাজে আরও বেশি মনোনিবেশ করতে পারবেন।
বিশেষ করে চেইন অব কমান্ড শতভাগ অক্ষুণ্ন থাকবে। তারা বলেন, এজন্য নীতিমালার কোথাও তদবিরের কোনো সুযোগও রাখা হচ্ছে না। কেননা, ন্যূনতম সুযোগ রাখলেই বিপদ। তখন নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। কোনোভাবে আর বাস্তবায়ন করা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, কোথাও যদি ২০০ জন লোককে বিশেষ অনুদান দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়, দেখা যাবে সেখানে কমপক্ষে ২ হাজার লোক এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন।
ঠিক তেমনি বদলি পদায়নের জন্য যদি বিশেষ কোনো সুযোগ রাখা হয়, তাহলে দেখা যাবে ওটা আর বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এজন্য বাইপাস সার্জারির কোনো পথ আমরা খোলা রাখছি না। রাখলে দেখা যাবে, সবাই ওই বাইপাস দিয়ে ঢুকে পছন্দের পোস্টিং হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এছাড়া তদবির এমন একটি বিষয়, যার লিংক আছে সে ব্যক্তিস্বার্থে সেটি ব্যবহার-অপব্যবহার সবই করবে। তাই এখন আমরা যেভাবে নীতিমালা করছি, সেখানে ঘুরেফিরে ভালো-মন্দ মিলে সব পদে সবাইকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কাজ করতে হবে।