ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি, এর নির্মূল সামাজিক ভাবেই করতে হবে – শাহানা সিরাজী
এক নারী
কখনো কন্যা কখনো জায়া কখনো জননী
তবুও নারীর চোখের জল এখনো থামেনি!
নারী একটি সত্ত্বার নাম। যে সত্ত্বা না থাকলে পৃথিবী আজকের অবস্থানে আসতো না। নারী সৃষ্টির আদি রসাত্মক গল্পটিও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। নারীও অকপটে তা মেনে নিয়ে পুরুষের পাঁজরের হাড় হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
বেশ তো হাড় হয়েই থাকো, লেপ্টে থাকো,আশায় ভরসায়, স্নেহে, মায়ায়,প্রেমে ভালোবাসায় । তাহলে সংকট কোথায়?
সংকট অর্থনীতিতে। ছেলেরা যখন উপার্জন করে, ছেলেদের উপার্জনে মেয়েরা বাঁচে তখনই এক প্রকার দম্ভে দম্ভিত হয়। পুরুষ হওয়ার দম্ভ। আমার কথাই চূড়ান্ত। সমাজ তো আমিই নির্মান করি,আমি ভাঙি। সুতরাং আমিই সর্বশক্তিমান।
নারী আপন মনে হীনমন্যতায় ভূগতে ভূগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে৷ সেই যে হারিয়ে ফেললো নারী আর সাহসী হলো না। এখন অনেক নারীই উপার্জন করে কিন্তু তার অর্থ তার ব্যয় করার অধিকার থাকে না। চেক দিয়ে দিতে হবে। পুরুষ সে টাকা নিজের ছকে ব্যয় করবে। নারী মেনেই নিচ্ছে।কারণ নারী ধারণ করে। তার মাসিক হয়,রক্তপাত হয়,আবার বন্ধ হয়।তার পেট ফুলে ঢোল হয়,তাকে কেটে ছিঁড়ে বেহুঁস করে বাচ্চা বের করে – সবই দৃশ্যমান। ফলে নারীর দায়িত্ব বেড়ে যায়। সন্তান তাকেই মানুষ করতে হবে বড়ো করতে হবে।
এই সুযোগটাই পুরুষ গ্রহণ করে। তার তো মাসিক হয় না,তার তো রক্তপাত হয় না,তার পেট ফুলে না,তাকে কেউ লেবাররুমে নিয়ে যায় না,সেতো জানেই না লেবার পেইন কী? সুতরাং সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে বীর্যপাত করতে পারেই সমস্যা নেই!
তাই যখন যেভাবে থাকে সেখানেই যদি কামনা বাসনা জেগে ওঠে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং জোর করে টেনে হিঁচড়ে যে ভাবেই পারুক সে নিজেকে রিলাক্স করে। যাকে টেনে হিঁচড়ে জোর করলো,সে কী বাসে? ট্রেনে?,রাস্তায়? আলু ক্ষেতে? প্রাইভেট কারে? সে কী একা? সে কী শিশু? সে কী যুবতী! প্রৌঢ়া? বৃদ্ধা? কোন কিছুই তারা তোয়াক্কা করে না। তাদের দরকার ঝরানো-
এর ফলে উদ্ভুত কোন সমস্যা তাকে ফেস করতে হয় না।
এমন কী তার দেহে এমন কোন চিহ্নও থাকে না যা দ্বারা সে লজ্জিত হবে! কেউ তাকে প্রশ্ন করবে!
পুরুষদের খানিকটা উন্নাসিক মনোভাবের জন্য তাদের যেন লজ্জা থাকতেই নেই। তারা যখন এক জায়গায় গেদারিং করে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে সে সব শুনেও অনেক সুবোধ ছেলেও গ্যাং রেপিস্ট হয়। সঙ্গদোষে দুষ্ট হয়!
ধর্ষণের মূল থিমই হলো আধিপত্যবাদ। তারপর রয়েছে ক্ষমতার দাপট।
সেটি হলো যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা বাস করি এখানে নারী মাত্রই খেলনা! ওই যে অর্থনীতি। নারী যে তার উপর নির্ভরশীল! সুতরাং যতো ইচ্ছা নারী ধরো,মারো খাও! এ অবস্থার উত্তোরণ আদৌ সম্ভব কি না জানি না তবে হ্যাঁ, পুরুষ যদি সংবেদনশীল হয়,তারা যদি মনে করে আমরা আছি তোমাদের পাশে-
বাবা যদি কন্যাকে পাত্রস্থ করে স্বর্গ বা বেহেশতের চিন্তা না করে বরং মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করায়,তাকে চাকুরি,ব্যবসা- বাণিজ্য ইত্যাদি কাজে সহযোগিতা করে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ঠিক করে দেয়,
স্বামী যদি ভাবে আমার স্ত্রী সেও মানুষ, আমার মতো সেও উপার্জিন করুক,
ভাই যদি ভাবে আমার বোন আমার মতোই উপার্জন করুক,স্বাধীন মতামত দিক, রাস্তায় পথিক যদি ভাবে আমার মতো সেও পথিক,বাসে যাত্রী যদি ভাবে আমার মতো সেও যাত্রী, সহকর্মী যদি মনে করে আমার সহকর্মী তাকে আমার সম্মান করা দরকার। তাহলেই কেবল নারী ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাবে।
এর জন্য প্রয়োজন উন্নত রুচিশীল মানসিকতা। সে মানসিকতা গঠনে ভূমিকা পালন করে পরিবার,রাষ্ট্র।
একটি রাষ্ট্র যেমন তার জনগণ দ্বারা প্রভাবিত হয় জনগণও রাষ্ট্রীয় নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাজনীতি এখানে বড়ো ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্র তার নাগরিককে কী ভাবে দেখতে চায়, সে ভাবেই শৈশব থেকেই তাকে তৈরি করতে হবে। মানব ক্ল্যাণে আইন তৈরি করে সঠিক নিয়মে তা বলবৎ করতে হবে। সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে,তাৎক্ষণিক বিচার করতে হবে। জন্মের পূর্ব হতেই পিতামাতা উভয়কেই ট্রেনিং দিতে হবে। জন্মের পর পরই স্কুল।সেখানকার পরিবেশ সমতা ও সাম্য ভিত্তিক করতে হবে নইলে মানুষের ভেতর তৈরি হবে না রুচি।
রুচিশীল মানুষ হাত পেতে ভিক্ষা নিতে পারে না। ভিক্ষার সামিল হলো- ঘুষ,লুট,তহবিল তসরুপ, অন্যের সম্পদ দখল করা এগুলো সব ভিক্ষাবৃত্তি। কেউ ছেঁড়া কাপড়ে ভিক্ষা করে কেউ শীতল কক্ষে সুন্দর কাপড়ে।
আমাদের দেশে অধিকাংশ লেখাপড়া জানা লোক ভিক্ষুক। ভিক্ষার টাকায় তারা যে সন্তান লালন পালন করে তারা কখনোই ভদ্র,রুচিশীল এবং মানবিক হতে পারে না!
ব্যথা কী রকম -যে ব্যথা পায় সে জানে যে পায় না সে জানে না। একজন মানুষকে সংবেদনশীল হতে হলে গভীরে প্রবেশ করতে হবে,চিন্তার গভীরে, রক্তপ্রবাহের ধারা আবিষ্কার করতে হবে তবেই সে অন্য মানুষকে হার্ট করার আগে বুঝবে, অনুভব করবে অন্যের অনুভূতি।
নারী এবং পুরুষ পরস্পরের জন্য তৈরি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে।একা নারী যেমন বাঁচতে পারে না পুরুষও না। দুজনই সমান সমান। যে ক্রিয়া কর্মের জন্য পুরুষের আরেক নাম হয়েছে ধর্ষক সে কর্মে আপনি একা কী করে সফল হবেন!
তাই আসুন আমরা নারী পুরুষ সমান ভাবে একে অপরকে সাপোর্ট দিই। সম্মান করি। জয় করি। আমাদের সন্তানদের শেখাই কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ তো দূরে তার সাথে কথাও বলা যাবে না।
প্রকৃতির দিকে খেয়াল করুন- বৃষ্টি নামার আগে আকাশে সাজ সাজ রব থাকে,ময়ূর পেখম কেন মেলে, মোরগ পাখা মেলে কাছে গিয়ে মুরগীর কাছে কী চায়? নিদেনপক্ষে কুকুরকে দেখুন কুকুরীর পিছু পিছু কতো সময় ব্যয় করে! আপনি মানুষ- উন্নত বুদ্ধির আপনি কেন লাজ লজ্জাহীন, বেতমিজের মতো যেখানে সেখানে যার তার কাছে নির্লজ্জের মতো বিবস্ত্র হন?
আপনার কী লজ্জা থাকতে নেই!
শালীনতা থাকতে নেই!
আপনি কেন নানান অজুহাতে নারীর উপর চড়াও হন!
ধর্ষণের শাস্তি রাষ্ট্র নির্ধারণ করেছে মৃত্যূদণ্ড। ভাবুন তো এই সুন্দর পৃথিবী, এই আলো এই বাতাস এই জগত রেখে আপনি তাগড়া যুবক,৬০ বছরের বুইড়া,আপনাকে কী কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মরতে হবে! যৌনতা আপনার মৌলিক অধিকার। আপনি প্রপার ওয়ে সে অধিকার ভোগ করুন। ফোর্স মৃত্যু যা এক জন মা হিসেবে, বোন হিসেবে,সজন
আপনি যৌবন প্রাপ্ত হয়েছেন,আপনার ভালোবাসার অধিকার আছে। যাকে ভালোবাসবেন আমাদের সমাজে বিবাহ জরুরী তাকে বিয়ে করুন। আবার উভয়ের সম্মতিতে বিয়েও দরকার পড়ে না কারণ সেটা জোর নয় জয়।
তাও না পারলে আপনি খাবার নিয়ন্ত্রণ করুন,আত্ম নিয়ন্ত্রণ করুন, ভালো কাজ করুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। রাজনৈতিক অপশক্তি থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনাকে পুঁজি করে অন্যেরা ক্ষমতায় থাকে। তাতে আপনার কী উন্নয়ন হলো! ওসব থেকে বেরিয়ে আসুন। সন্ত্রাস- মাদক -পর্ণ আপনার জীবনীশক্তি ক্ষয়ে দেবে। আপনি নিজকে আর কখনো দাঁড় করাতে পারবেন না। অন্যকে দেখে নয় নিজেই এমন কিছু করুন যাতে আপনিই অন্যের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারেন।
এরপরও যদি আপনি আত্ম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তাহলে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান।
সমাজের প্রতিটি সদস্যকে নারীর প্রতি সদয় হবার আহবান করি।
নারীকে আহবাম করি আমাদের সন্তানদের আমরা জেন্ডার বৈষম্য না করে সন্তান হিসেবে মানুষ করি যাতে তারা রাহাজানিতে লিপ্ত না হয়।
নারী পুরুষ মিলে সুন্দর পৃথিবী গড়ি
জয় হোক নারীর জয় হোক পৃথিবীর…
শাহানা সিরাজী।
ইন্সট্রাক্টর ( সাধারণ)
পিটি আই মুন্সীগঞ্জ
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।