ভুয়া জমি দেখিয়ে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নাসিম

ভুয়া জমি দেখিয়ে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নাসিম!

অপরাধ প্রতিবেদনঃ ৩০০ কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ! ১৫টির বেশি ভুয়া প্রতিষ্ঠান! শতাধিক মামলা। ৫৫টি গ্রেফতারি পরোয়ানা। নিজের অফিসের আন্ডারগ্রাউন্ডে গোপন সুড়ঙ্গ গড়ে পালিয়ে থাকার চেষ্টা। সম্প্রতি আলোচনায় উঠে আসা ‘নাসিম রিয়েল এস্টেট’-এর মালিক ইমাম হোসেন নাসিমের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠেছে। র‌্যাব বলছে, মাত্র সাত দিনে ৩৫৫ জন ভুক্তভোগীর অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। ৬৪ জেলা থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আসছে।

গত ১ অক্টোবর মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে নাসিম রিয়েল এস্টেটের অফিসের আন্ডারগ্রাউন্ডের গোপন সুড়ঙ্গ থেকে স্ত্রীসহ গ্রেফতার হয় ইমাম হোসেন। ফিঙ্গারপ্রিন্টে খুলবে এমন দরজা ছিল ওই সুরঙ্গে। রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় নাসিমের বাসা ও চিড়িয়াখানা রোডে নাসিম রিয়েল এস্টেটের অফিসে অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় একটি ৭ পয়েন্ট ৬৫ মিলিমিটার বোরের বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, তিন রাউন্ড গুলি, এক লাখ ৩৫ হাজার জাল টাকা, ১৪শ’ পিস ইয়াবা, দুই বোতল বিদেশি মদ, চারটি ওয়াকিটকি সেট, ছয়টি পাসপোর্ট, ৩৭টি ব্যাংক চেক ও ৩২টি সিমকার্ড জব্দ করা হয়।

নাসিমকে গ্রেফতারের পর একটি হটলাইন নম্বর চালু করে র‌্যাব। গত সাত দিনে এই হটলাইনে ও সরাসরি র‌্যাবের অফিসে এসে ৩৫৫ জন ব্যক্তি প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ এনেছেন। প্রতারিত হওয়া এমন অভিযোগকারীর মধ্যে কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চিকিৎসক, কেউ পুলিশ, কেউ চাকরিজীবী, কেউবা গৃহিণী।

এই অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মেজর রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘৩৫৫ ব্যক্তির কাছে থেকে আমরা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ পেয়েছি। ২০০৫ সালে রিয়েল এস্টেটের লাইসেন্স পাওয়া নাসিম ২০০২ থেকেই প্রতারণা করে আসছিল। নাসিমের বিরুদ্ধে আছে শতাধিক মামলা। বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে গ্রেফতার এড়িয়েছে সে। আমরা তার বিরুদ্ধে সিআইডিতে মানি লন্ডারিং মামলা করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছি। তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।’

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, র‌্যাব প্রতারিত হওয়া ভুক্তভোগীদের কাছে থেকে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করছে। পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য র‌্যাব তাদের সাহায্য করবে। ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরও বাড়ছে।

র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে শফিকুল ইসলাম টিটু নামের প্লট কেনাবেচার এক দালালের সঙ্গে পরিচয় হয় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের আলী আকবরের। ব্যবসায়ী আলী আকবর নিজের ও শ্বশুরের জন্য দুটি প্লট কেনার সিদ্ধান্ত নেন। শফিকুল ইসলামের মাধ্যমে রাজধানীর চিড়িয়াখানা রোডে নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক নাসিমের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের। সাভারের উত্তর কাউন্দিয়া এলাকায় ১৮ লাখ টাকায় দুটি প্লট কেনার বিষয়ে চুক্তি হয় তাদের মধ্যে। দুটি জায়গাই পানির নিচে। ২৪ কিস্তিতে দুই বছরে ১৮ লাখ টাকা পরিশোধ করারর শর্ত দেওয়া হয় আলী আকবরকে। এরপর কয়েক কিস্তিতে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন আলী আকবর। ১০ লাখ টাকা পাওয়ার পর থেকেই আস্তে আস্তে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে নাসিম। এতে হতাশ হয়ে পড়েন আলী আকবর (৪২) ও তার শ্বশুর আইজউদ্দিন (৬৭)।

এরপর আলী আকবর হঠাৎ গত ১ অক্টোবর সংবাদমাধ্যমে জানতে পারেন রিয়েল এস্টেটসহ ১৫ ভুয়া কোম্পানির নামে প্রতারণা করার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক নাসিম ও তার স্ত্রী।

একইভাবে ২০০৪ পুলিশ কনস্টেবল মাহবুব আজম পেনশনের টাকা দিয়ে প্লট কেনার জন্য নাসিম রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে চুক্তি করেন। শুধু নকশা দেখেই বিনিয়োগ করেন তিনি। মাসিক কিস্তিতে মোট পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন নাসিম রিয়েল এস্টেটকে। ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল, এই ১৪ বছরেও প্লট দেয়নি নাসিম। পরে ডিএমপির শাহ আলি থানায় মাহবুব আজমের ছেলে আল মেহেদি হাসান বাদী হয়ে প্রতারণার মামলা করেন। সেই মামলায় গত বছর চার্জশিটও দিয়েছে পুলিশ।

র‌্যাব-৪ অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সরকারি খাস জমি, দখল করা জমি, পতিত জমি নিজের দাবি করে প্লট বিক্রির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নাসিম। আগে খোঁজ-খবর নিয়ে ক্লায়েন্টকে একটা নির্দিষ্ট দিনে নিয়ে যেত জায়গা দেখাতে। সেখানে আগেই সবকিছু প্রস্তুত করা থাকতো। পরে চুক্তির মাধ্যমে ভুয়া কাগজ করে দিতো। নাসিম প্রতারণা করার পর ক্লায়েন্টদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতো। কখনও কখনও অস্ত্র ও ওয়াকিটকি দেখিয়ে নিজের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতো। তার নামে প্রতারণার অভিযোগ এখনও আসছে।’

একই বিষয়ে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘নাসিমের বেশ শক্তিশালী দালাল চক্র আছে। তারা সারা দেশে সক্রিয় ছিল। তাদের মাধ্যমে এই প্লটগুলো বিক্রি হতো। অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শুধু এক বা দুই জেলা থেকে নয়, প্রায় ৬৪ জেলার দুই-একজন করে পাওয়া যাবে, যারা নাসিমের প্রতারণার শিকার হয়েছে।’

নাসিমের উত্থান
ইমাম হোসেন নাসিমের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান থানাধীন মেদুয়া গ্রামে। তার বাবা ১৯৫০ সালের দিকে ঢাকায় চলে আসেন। নাসিমের তিনটি বিয়ে করার তথ্য পাওয়া গেছে।

নাসিম ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঠিকাদারির পেশায় জড়িত ছিল। পরে ২০০২ সাল থেকে নিজেকে কথিত ‘নাসিম রিয়েল এস্টেট’ কোম্পানির মালিক পরিচয় দিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে প্রতারণা শুরু করে। অন্যের জমি, খাস জমি দখল করে আবাসিক এলাকা গড়ে দেওয়ার নামে প্রায় পাঁচ হাজার গ্রাহকের সঙ্গে বায়না করে সে। এটার পাশাপাশি সে ২০০৫ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে ভিন্ন ভিন্নভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছে।

৫৫টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও কেন অধরা ছিল নাসিম

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় প্রতারণা মামলার অন্তত ৫৫টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় ইমাম হোসেন নাসিমের বিরুদ্ধে। প্রতারণা, ভূমিদস্যুতা, মাদক ও জালটাকার কারবারসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তবু কেন অধরা ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৪ অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘একটা প্লট চুক্তিতে তার যতটুকু কাজ, তার বেশি সময় দিতো না নাসিম। গ্রেফতার এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ডে গোপন সুড়ঙ্গে অবস্থিত ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংবলিত দরজাযুক্ত অফিসে পালিয়ে থাকতো। তার অনুপস্থিতিতে তৃতীয় স্ত্রী হালিমা আক্তার সালমা প্রতারণার কর্মকাণ্ড দেখাশোনা করতো। তাই তাকে পাওয়া যায়নি।’

রিহ্যাবের বক্তব্য

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, ‘নাসিম রিয়েল এস্টেটের বিরুদ্ধে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে প্রথম দুটি অভিযোগ পাই। একটি অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা প্রতিষ্ঠানটির মালিক নাসিমকে ডেকে পাঠাই। পরে দুই পক্ষের অভিযোগ শুনে বিষয়টি সমাধান করে দেই। অন্য অভিযোগকারী আর যোগাযোগ করেননি। তবে বর্তমান এই ঘটনায় এখনও কেউ অভিযোগ করেননি। রিহ্যাবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য, কেউ প্রতারিত হয়ে যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমরা দুই পক্ষকে বসিয়ে সমাধান করে দেবো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top