বিপরীত – শাহানা সিরাজী
কী ভয়নক কা- ঘটাতে যাচ্ছিলাম! ও মাগো! কী ভয়ঙ্কর! ভাবতেই পারছি না , মানুষ এতো বহুরূপী কী করে হয়! ভাগ্যিস গাধাটা বেঁকে বসেছে। না হয় কী ভয়ানক ঘটে যেতে পারতো! কী ভয়ঙ্কর! বাপরে!
আরে কী হয়েছে, বলো। এতো হা পিত্যেস করছো কেন?
জীবনের অনেক গল্প আছে যা বলা যায় না কেবল দেখে যেতে হয়। আবার যদি কখনো আমাদের দেখা হয় তখন দেখিয়ে দেবো। ফোন ছেড়ে দেয় রেখা। আজ তার মন বড়ো বিষন্ন। আহা মানুষ! স্বপ্নের মানুষ! কী করে বোঝাই এই খেরোখাতার জীবনে আসলে নিজের বলেই কিছুই নেই। যখনই যাকে আপন ভেবে কাছে টানি সেই মারে ঘাই! একবারে কলিজার মাঝখানে। টপটপ জলের ধারা চিবুক বেয়ে গ-দেশে ভেসে যাচ্ছে। কেন তার এতো বিলাপ! কেন তার এতো বিষাদ! প্রতিদিনই কী কেবল দুঃখে কাটে আনন্দ কী কিছুই নেই! রেখা ভাবতে থাকে। আসলে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। রেখা নিজের ভেতর হারিয়ে যায়। যখনই কিছু পেতে চাই তখনই কষ্ট পাই। আজ থেকে নিজের জন্য জন্য চাওয়া থামিয়ে দেবো। নিজের একান্ত ভালোবাসার মানুষের সাথে অন্য কাউকে কেন সে জড়াতে চায়? কেন ভালোবাসাকে নিজেই পরিণতির দিকে না নিয়ে অন্যের দিকে ঠেলে দিতে চায়! আসলে সে চাচ্ছে কী? রেখা প্রাত্যহিক কাজে নিজেকে মগ্ন রাখতে চায়। রুগ্ন বাবার সেবা করতে করতে কখন তার প্রেম ভালোবাসায় অনীহা এসেছে তা অনুমান করতে পারে না। বাবা চলে গেলো। মা তো অনেক আগেই চলে গিয়েছেন। তার জন্য এখন রইলো কী? কিছুই না। তাহলে রফিকের সাথে কেন সে সামনে হাঁটতে চায় না! কিসের ভয়! যতোবার রফিক কাছে আসে সে ততোবারই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বার বার চেয়েছে অন্য কারো সাথে জোড় বেঁধে দিতে। আচ্ছা এটাও কী তার নিজের জন্য চাওয়া? রেখা নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। রফিককে কাছে টানে কিন্তু বাঁধে না, এমনও তো হতে পারে রফিক নিজেই চাচ্ছে না! রেখা বিরক্ত! নিজেকে বলে লেট ইট গো। আপন কাজে মন দাও। কিন্তু মন বড়োই অদ্ভুত, শাসন মানে না। নানান চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে । সারাদিন অফিসে যতো কাজই করুক না কেন অবচেতনে রফিক তাকে শক্তি যোগায়। একা একা কথা বলে, মনে মনে হাসে। কতো কথার নকশীকাঁথা বুনুন করে। বাইরে কেউ বলতে পারবে না রেখার ভেতর কোন প্রকার রাগ অনুরাগ আছে কিন্তু ভেতরবাড়ি ভালোবাসার আধার। রফিককে কাছে পাবার অদম্য আকাঙক্ষা তার ক্রমাগত বেড়েই চলে। এখন তার কাজের ছন্দপতন হয়। এতো যারে পাবার ইচ্ছা এতো যারে অনুভবে পায় সে কাছে আসলে রেখা কেন এতো কঠিন হয়ে যায়! মেঘে মেঘে অনেক বেলা বেড়ে গেছে কখন সে টেরই পায়নি। রফিক জানে যতোই ভালোবাসুক জীবনের জন্য লাগে সন্তান। রেখা সন্তান দিতে পারবে না রফিক খুব ভালোই জানে। রেখা নিজেও জানে। নারী অদ্ভুত সত্ত্বা। তার ভালোবাসা তখনই সমাদৃত হয় যখন সে সন্তান সংসার সব দক্ষ হাতে সামলাতে পারে তখনই সে অনন্য নারী হয়ে ওঠে। রেখা এ চিন্তা বাদ দেয়। ঠিকই তো রফিক কেন তার সাথে জড়াবে! কিন্তু জড়িয়ে যে আছে! যখনই মন চাচ্ছে ফোন করছে, নক করছে, খাবার দাবার কিনে একবারে হাজির। হৈ চৈ করছে … কী না করছে! মন চাইলে নেমে পড়ছে দিঘিজলে। হাবুডুবু , সাঁতরে বেড়ানো । একান্তই নিজের মতো চলছেই। রেখার কোন বিকার নেই যেন। তার সাথে সায় দিচ্ছে নিজের মনে পাথর হয়ে যাচ্ছে। এ আলেয়া,এর পেছনে ছোটা নয়। বরং নিজের ভেতর নিজেকে বন্দী করা জরুরী। রেখা তাড়া দিয়ে যাচ্ছেই- তোমার এবার সংসারী হওয়া প্রয়োজন। প্রতিবারই সে সিরিয়াস হয়ে বলে,পাত্রী দেখো। তোমকে ছুঁয়ে শপথ করছি এবার বিয়ে করবোই। রেখা অবাক হয় আমাকেই দেখতে হবে পাত্রী! হ্যাঁ তোমাকেই। এদের ভালোবাসা বড়োই অদ্ভুত! কেউ কাউকে ছাড়বে না অথচ কাছেও আসবে না। কিন্তু রেখা মরিয়া, ওকে আমিই দেখবো পাত্রী। দেখতে দেখতে আবারো বসন্ত এলো, কোকিল ডাকলো। পাত্রী পেলো না। যাকে রেখা সিলেকশান দেয় মনে হয় এ তো ডাইনি, কেবল খাই খাই!
যার সাথেই কথা বলে সব নারীর একই বক্তব্য, আরে বিয়ে করবো তো ছেলের গাড়ি থাকবে বাড়ি থাকবে নিদেন পক্ষে এ সব করার স্বপ্ন থাকতে হবে! কেবল শিল্প দিয়ে তো পেট ভরে না! রেখা হাল ছেড়ে বলে, তোমার বউ তুমি খোঁজো । আমি পারছি না। রফিক সেদিন তীব্রমাত্রায় ঘন হয়ে বলে, তুমি পারো না আমাকে মাত্র একটা বাচ্চা দিতে? তুমিই হও আমার বাচ্চার মা। তুমি ছাড়া আর কারো কাছে আমি কেমন করে যাবো! আমার দ্বারা হবে না! আমি এভাবেই থাকবো। তার চোখের কোণ ভিজে ওঠে। কিন্তু রেখা! ভেঙে যাচ্ছে,মিশে যাচ্ছে, কাঁপতে কাঁপতে হাড় জরোজরো হচ্ছে তবুও স্থির। এই বসন্ত এভাবে গেলেও আমি আবার দেখবো। আঁচলে রফিকের চোখের জল মোছে, হাসতে হাসতে বলে, তোমাকে বাবা হতে হবে যে! না হয় বংশে কে বাতি দেবে? আমি নারী। চাকুরী করি। চাকুরীই আমাকে দেখবে। তোমার জন্য, বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সন্তান প্রয়োজন। রফিক এলোমেলো, অসহায়ের মতো রেখার হাত চেপে ধরে তুমিই নাও আমার বেবি। রেখা হাসে , সে হাসির অর্থ বোঝার শক্তি রফিকের থাকার কথা নয়, চাইলেই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া যায় না। রেখা জানে ন্যাচার কেড়ে নিয়েছে তার মাতৃত্ব! সুতরাং তাকেই সহ্য করতে হবে ভালোবাসার মানুষকে দূরে রাখার কষ্ট। রেখা আবার লেগেছে রফিকের বউ চাই..
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। তারপর দিন সকালেই ফোন আসতে শুরু করেছে। পাত্রী পক্ষের প্রথম প্রশ্ন, আপনি পাত্রের কী হন? রেখা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভাবতে থাকে, কী বলবে! অবশেষে বলে আমি তার অভিভাবক। বেশ মানানসই জবাব। কেউ তো আর জানে না কিংবা দেখেনি রেখা আসলে কে? মেরী নামের এক পাত্রী মোটামুটি রাজি । তার একজন মানুষ চাই যে শুধু ভালোবাসবে। রফিককে নিয়ে তারা বেলি রোডে গেলো।
সে দিনের সে দিনের সব আয়োজন রেখার। এবার রেখা নিশ্চিত রফিকের বউ সে পেয়েই গিয়েছে। নিজের হাতে রফিককে সাজিয়ে গুজিয়ে রেডি করে শোপিস বানিয়ে যাচ্ছে। পথ যতো এগুচ্ছে রফিককে ততোই চঞ্চল দেখাচ্ছে, ততোই সে রেখার সাথে ঝগড়ার মাত্রা বাড়াচ্ছে। আমি পাত্রী দেখতে যাচ্ছি,আমার জামার কলার ঠিক আছে কি না তা কেউ দেখে দেয়নি। রেখা তাৎক্ষণিক দেখে দিচ্ছে , না ঠিক আছে তো! রফিক ইচ্ছা করে জামার হাত এলোমেলো করে বলে, এই যে আমার হাতের বোতাম লাগানো হয় নি। রেখা হাতের বোতাম ঠিক করে দিয়ে বললো, ওখানে গিয়ে যেন আবার বলো না,আমার চুল এলোমেলো,কেউ পরিপাটি করে দেয়নি। তাতো বলবোই চুল এলোমেলো থাকলে মেরী আমাকে পছন্দ করবে? বলেই মুখটি অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয়। রফিকের ভেতরে কী হচ্ছে সে কী আসলেই পারবে রেখাকে ছেড়ে বাঁচতে? সে কী সত্যিই মেরীকে বিয়ে করবে? রেখা স্থির অনড়। কোন প্রকার ভাবলেশহীন এক অভিভাবক হয়ে রফিক-রেখাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। রেখাও খানিকটা দেউলিয়া টাইপের মেয়ে। জীবনের প্রতি উদাসীন। কিন্তু লোভ আছে। যদিও সে ফোনে ফোনে জানিয়েছে আসলে তার একজন মানুষ দরকার কেবল। মনের মতো মানুষ হলে জীবন এমনিই চলে যায়। রেখাও বিশ্বাস করেছে। প্রচ- মানসিক শক্তি না থাকলে কেউই পারে না নিজের সমস্ত অনুরাগ বিসর্জন দিতে। রেখা নিজেকে শাসন করে- রফিককে যদি ভালোবাসো তবে তাকে সংসার উপহার দাও। সুস্থ জীবন দাও। তার ভবিষৎ বংশ দাও। চোখের জল মোছো। রফিক-মেরী যখন মুখোমুখি রেখা তখন অন্য দিকে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। ওদের দিকে যাতে দৃষ্টি না পড়ে তাই সরে যায় সেখান থেকে।
রফিকের উপর ভরসা আছে জমাতে পারবে। কিন্তু রফিক যে ভূতুড়ে কাজ করবে কে জানে! মেরীর সাথে কথা বলছে ঠিকই রেখাকে না দেখেই শুরু করেছে খোঁজা। রেখা তার ফোন বন্ধ করে রেখেছে। কাছে পিঠে থাকলেও ঠিকানা না জানলে কী ভাবে খুঁজে বের করবে! তার উদ্বিগ্নতা দেখে মেরী ব্যতিব্যস্ত,কী হয়েছে?
-ম্যাডামকে দেখতে পাচ্ছি না।
-ম্যাডাম আপনার কী হয়?
-উনি বলেন নি?
-বলেছেন অভিভাবক।
-তাহলে আবার জানতে চাচ্ছেন কেন? এখনই প্রশ্ন? পরে তাহলে কী করবেন?
মেরী বিস্ময়ের সাথে বলে, আপনি ঘামছেন কেন?
তাতে আপনার কোন সমস্যা আছে?
মেরী আরো বিস্মিত হয়- কী ব্যাপার! এমন করছে কেন? ড্রাগ এডিক্ট নয় তো! সে অনুমান করার চেষ্টা করে। রফিক কী আসলেই আলাভোলা নাকী রেখার উপর নির্ভরশীল! রেখা ছাড়া যদি সে কিছুই না বোঝে তাহলে তাকে পছন্দ করা ঠিক হবে কী! রফিকের অস্থিরতায় মেরী ভড়কে যায়। রফিক দুহাতে মাথার চুল এলোমেলো করে ভাবতে থাকে তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে! মেরীই হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে , ওই যে রেখা আপা!
রফিক চঞ্চল হাওয়ার মতো ভেসে ওঠে, এগিয়ে যায় দৃপ্ত পায়ে কাছে গিয়েই সে থেমে যায়, আমি বউ দেখতে এসেছি আমার যে চুল এলোমেলা তা কেউ দেখেনি!
রেখা বলে এখন আর দেখে কাজ নেই। সে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে আসে। বলেছিলাম উল্টাপাল্টা করা যাবে না। তুমি তাই করলে!
কিছুই করিনি।
তাহলে তুমি বাইরে কেন? তোমাদের আলাপ করতে দিয়ে আমি বেরিয়েছি। তুমি আলাপ রেখে বাইরে কেন?
বাইরেও আলাপ করা যায়! তুমি কোথায় গিয়েছো? তোমাকে ছাড়া আমি এলোমেলো হয়ে যাই, জানো না বুঝি!
আর কতো কাল! এবার ভীড়াও তোমার তরী। রেখার মাথায় একটি মাদুলী পোকা হেঁটে যাচ্ছে। রফিক হন্তদন্ত হয়ে পোকা সরিয়ে দেয়। পোকাও বুঝে গেছে আমি ছাড়া তুমি অর্বাচীন! কে তোমার চুল থেকে পোকা ফেলে দেবে?
ও কাজ যে কেউই করতে পারে , তার জন্য তুমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে না থাকলেও চলবে। রেখা ফোঁড়ন কাটে। রফিক যেন ঝড়ো বাতাস, উড়িয়ে নেবে সব। রেখার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।সামনে পা বাড়ায়। চলো মেরী বসে আছে।
সে দিন বাকী সময় তারা শিল্প সাহিত্য নিয়েই কথা বলে। মেরী সাহিত্য চর্চ্চা করলেও তার ভেতর শিল্পবোধ তৈরি হয়নি বলে রফিক অভিমত প্রকাশ করে। মেরীর বিপরীতে সে শক্তিশালী যুক্তি দেয় সে লোভী এবং বহু ঘাট মাড়ানো নারী। তাকে তুমি যতো সহজ ভাবছো সে ততো সহজ নয়। তোমার সাথে আমি নিজেকে উগরে দিতে পারি সে আমার ভেতরের আমাকে এক মুহূর্তও সহ্য করবে না। সে হলো সাগরের বুকে কচুরীপানা তুমি ঝিনুক যাতে আছে মুক্তো! আমি মুক্তো রেখে কচুরীপানা কেন নেবো?
কচুরীপানারও রূপ আছে যদি সে ভাবে দেখো।
সে হলো এঁদোডোবা তুমি সমুদ্র
আমি সমুদ্র রেখে ডোবায় কেন যাবো!
রেখা বলে কখনো কখনো ডোবাতেও ঝিনুক জন্মে!
রফিক বলে-সমুদ্রের ঝিনুকে যে অভ্যস্ত সে ডোবার ধারে কাছেও যাবে না।
রেখা সেদিন রফিকের জন্য ডাল ভাত রান্না করলো, রফিক স্বর্গীয় তৃপ্তিতে সে খাবার খেলো। সারামুখে তার প্রশান্তির ছাপ, সেদিনই সে ঘোষণা করে, মাই ডিয়ার গার্লফ্রেন্ড তুমি নিশ্চিত থাকো- মেরীর সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে না। বলেই রেখার বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। রেখাকেও বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কী করতে পারি রফিক তোমার জন্য!
সবাই যাকে মাস্তান বলে ঘৃণা করে রেখা তাকে সজ্জন বলে ভালোবাসে। এ দেশ এমনই এক বন্ধ্যা সময় পার করছে এখানে ন্যায় হলো অন্যায় , অন্যায় হলো হলো ন্যায়। রাষ্ট্রীয় দূরাচারের বিরুদ্ধে গেলেই সে মাস্তান? সরকারি অফিসগুলোতে জনগনের টেক্সের টাকায় রাখা লোকগুলো জনগণের টাকা লুট করছে,নিজেদের দায়িত ¡যথারীতি পালন করছে না,এর বিরুদ্ধে কথা বললেই সে মাস্তান? রেখা রফিকের ভেতর খুঁজে পায় এক সরল সহজ শিশুমন, যে মানুষের জন্য ভাবে, বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যার নেশা তাকে তো ফেলে দিতে পারে না! সবাই দেখে সে জোর করছে কিন্তু কার বিরুদ্ধে কার পক্ষে করছে তা কেউ দেখে না। রেখা তাকে কাছ থেকে দেখে, সকাল থেকে সন্ধ্যা মানুষের জন্য খেয়ে না খেয়ে দৌড়ে। যেখানে মানুষকে মানুষ গুরুত্ব দেয় না,রাজনৈতিক অপরাধ বলগাহীন বেড়েই চলছে,মানুষের কথা বলার অধিকার নেই,জীবন ধারণ এক সিন্ডিকেটের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, যেখানে ব্যবসা বাণিজ্য সবই ‘চলো হরি’র দখলে, যেখানে অনায়াসে নারী নির্যাতন,শিশু নির্যাতন চলেই আসছে, যেখানে জুলুম অত্যাচার নিত্য ব্যাপার সেখানে এক রফিক কী করতে পারে! তবু সে তার এলাকার মানুষের জন্য তার সংগঠনের মানুষের জন্য রাতদিন দৌড়াচ্ছে। যখনই ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে তখনই ডাক আসে রেখার- এই তুমি কেমন আছো? রেখাও যেন ভালোবাসার অধিক মমতার চাদর বিছিয়ে অপেক্ষা করে। এসো এসো কেমন আছো? কতোদিন দেখি না তোমায়। রেখার শূন্যজীবনে এ মায়াবী আলোকরশ্মি। এরে যতনে আগলে রাখতে চায়। রেখার ভাই- বোন এ সম্পকর্কে কী ভাবে নেয় বা নিচ্ছে এ সবে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ সে ভাইকে দেখে সংসারে মনে হয় ন্যাকড়াটিরও মূল্য আছে তার নেই। তার ভাই অনায়াসে অপরাধ করেই যাচ্ছে। নইলে এতো টাকা কোথায় পায়? বউ প্রতি মুহূর্তে তাকে পাকড়াও করে রাখে। একই বাড়িতে থাকে কিন্তু রেখার থেকে আলাদা। কখনো যদি রেখার ঘরের সামনে তাকে পায় সেদিন যেন তুকালামকা- ঘটে যায়। হাবীব রেখাকে দেখলেই ঘুরে দাঁড়ায়। রেখা নিজেই সরে যায়। ভায়ের জীবনে আর কতো অশান্তি সে করবে! মা অনেক ছোট বেলায় মরেছে। বাবাকে দেখতে দেখতে জীবনের কোন প্রান্তে দাঁড়িয়েছে তা সে ভাবতে চায় না। কারণ বাবাকে দেখাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। হাবীব তার বাবার সেবা করতে না পারার কষ্টে ধুকে ধুকে মরে। বোনকে দেখাশোনা দায়িত্ব পালন করতে না পারার কষ্টে ছটফট করে। রেখা সব বুঝতে পারে। একদিন ভাইকে ডেকে বললো, তুই আমার ছোটো না? মারা যাবার পর তোকে বড়ো করেছি না? বাবাকে আগলে রেখেছি না? হাবীব অনর্গল চোখের জল মুছছিলো। রেখা দৃঢ় ভাবে বললো, তোকে দেখে রাখা এখনো আমার কর্তব্য। বাবার সহায় সম্পদ যা আছে সবাই বন্টন করে নাও। এ বাড়িতে আমাকে কোন অংশ দেবে না। যেখানেই দাও দিও, কেবল এবাড়িতে নয়। হাবীব শিউরে উঠলো, কোথায় থাকবেন?
আমি সরকারি চাকুরী করি। এ শহর থেকে বদলী হয়ে যাবো। আগামী সপ্তাহে অর্ডার আসবে। হাবীব হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তবুও প্রতিদিন ঘরের দরজার দিকে তাকাতাম। বাইরে লক থাকলে ভাবতাম এখনো ফিরেননি,লক খোলা থাকলে ভাবতাম ভেতরেই আছেন। শব্দ পেতাম। রেখা ভাইকে টেনে নিয়ে বলে, বোকা জগতে ভাই-বোন কখনো পর হয় না। আমিও নারী সেও নারী। সে হয়তো নিজেকে সিকিউর ভাবে না। তাই ও রকম করে। আমি দুরে গেলে তুই ভালো থাকবি। অন্তরের টান যদি গভীর হয় প্রতিদিন আমার ডাক শুনবি। যতো দুরেই থাকি আমি তোর বোন। এবং বড়ো বোন। তোর বউ আমার ভায়ের বউ। একদিন তার ভুল ভাঙতে পারে। এর জন্য তুই নিজেই দায়ী।
বউকে তার দায়িত্ব পালন করতে তুইই দিসনি । ও সব লুটপাট এবার বন্ধ কর। পাপ যখন বড়ো হয় তখন প্রকৃতিই মেচাকার করে দেয়। হাবীব অসহায়ের মতো বলে এতো চাহিদা আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। রেখা হাসে। তোর বউ মাস্টার্স পাস না? তাকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াচ্ছিস আর যা করতে বলে তাই করছিস, তোকে তার কাছে বিক্রি করেছি নাকি! তাকেও উপার্জন করতে বল। হাবীব বলে তাহলে রাতে তো এখন ঘরে প্রবেশ করতে পারি তখন তাও পারবো না। রেখা হাসে। কী জানি রে! রেখা ভাবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমিও সোচ্চার কিন্তু ঘরে ঘরে এখন ছেলেরা বাবা মা ভাই বোনের সাথে সাথে সম্পর্ক রাখতে না পারার কষ্টে কতোটা জর্জরিত তা কেউ এখনো ভাবেনি। আসলে পুরুষ লোকেরা কেন ঘুষখোর লুটেরা হয় তার একটি জরীপ হওয়া দরকার,কতোজন পুরুষ নারীর কাছে সম্মানের সাথে বাস করছে তারো একটা জরীপ হওয়া দরকার। কারণ নারীর সাথে কথা বললে মনে হয় সত্যি পুরুষ খারাপ। আবার পুরুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ দেখলে মনে হয় নরীর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কেউ নেই।
রফিকের সাথে যুথবদ্ধযাপন না করার পেছনে এও বড়ো একটি কারণ। পাছে তার দ্বারা রফিক কষ্ট পায়। পাছে তার সাথে রফিকের সম্পর্ক নষ্ট হয়!
এসব ভাবনায় রেখা যখন অস্থির রফিক তখন বেঘোর ঘুমুচ্ছে। রেখা পাশ থেকে তাকিয়ে আছে। কী নিষ্পাপ একটা মুখ! সারা মুখে ভিন্ন এক জ্যোতি বিকিরণ ছড়িয়ে আছে। ঘরটা জুড়েই প্রশান্তির মায়া বিস্তৃত। রেখা এবার ভেঙে পড়ছে। একে ছাড়া আমি কী ভাবে বাঁচবো! আমি ছাড়া এ কী ভাবে বাঁচবে! মেরী যদি শান্তার মতো অশান্ত হয় তবে রফিক বাঁচবে না। ভীষণ কাঁদছে। সে কী করবে!
দুপুর রাত পেরিয়ে সুবহি সাদিকের সময় ঘনিয়ে এলো। রেখা অবিরাম ঝরছে। হৃদয় বনাম বাস্তবতার লড়াই এ কে জিতবে?
আজান হলো। ঘুমন্ত পৃথিবী আড়মোড়া ভাঙছে। রফিরেও ঘুম হালকা হয়ে এসেছে। সে হাত পা নাড়ছে। এবার ঘুম ভাঙবে হয়তো। রেখা চুলায় চায়ের পানি চাপে। দুটো কাপ রেডি করে। সে জানে রফিক চা খায় না এবং খাবেও না। তবুও চায়ের কাপ একটা দেখলে বলবে আমারটা কোথায়? রেখার অনুযোগের তখন শেষ থাকে না। তুমি খাও নাকি! অহেতুক দুধ-চিনি- চা নষ্ট করার মানেই হয় না। রফিক তখনই দেখিয়ে দেবে সে চা খায়। রেখার কাপ টেনে এক টানেই সাবাড় করবে। এই যে খেলাম এবং খাই। রেখাও কম যায় না চা তো খায়নি যেন বিষ গিলেছে। রফিক আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে, তোমার হাতে যদি দাও বিষ অমৃত ভেবে ঢালবো গলায় তাতেও যদি সুখি হয় প্রিয়তমা আমার! রেখা তখন অপলক চেয়ে থাকে হাসে বলে,বিষ আর খেতে হবে না আমি আসছি বলেই দৌড় দেয় কিচেনে। ফিরে আসে এক কাপ চা আর কাপ দুধে ডোবানো মুড়ি কিংবা খই। রফিকের ধারণা সে শুধু শুধু দুধ খেলে তার পেটে সমস্যা হয়। রেখা জানে,ব্যাপারটি হলো দুধ খেলে তার পেটে গ্যাস হয়। অন্য কিছুর সাথে মিশিয়ে খেলে গ্যাস কম হয়। কিন্তু কিছুই বলে না। রফিকের জন্য কিছু করতে পারলে তার ভালো লাগে।
রফিক এলোমেলো হয়ে যায় আবার , তোমার মতো করে কে ভালোবাসবে আমাকে!
-তুমি যার স্বামী হবে সে বাসবেই। না বাসলেই কী! একটা বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। রেখা তখন তল হয়ে যাবে,আরো পরে ট্রফিজিয়ামের বাইরের কেউ। রফিক হু হু করে চোখ ভাসায়। রেখা হাসে। তাকে হাসতে হয়। পোড়াবসন্তে ফুল ফোটে না। ফুলশূন্য বাগানের মালি বাগানের প্রতিমোহ হারিয়ে ফেলে।
সেদিনই মেরীর সাথে রফিকের বিয়ে ফাইনাল করবে ভেবে রেখা অফিস শেষ করে বের হয়। পথিমধ্যে ফোন করে টিউলিপ। ম্যাডাম কেমন আছেন? ভালো আছি। কেমন আছো তুমি? অনেক দিন কথা হয় না। তোমার কবিতার হাত কিন্তু দারুন। ফ্রি আছো নাকি? আজ একটু আগে বের হলাম একটা শুভ কাজ করতে যাচ্ছি। ম্যাডাম মেরীকে চিনেন? হ্যাঁ তার সাথেই তো আজ কাজ।
টিউলিপ হাসে। শুনেছি আপনি তার জন্য বিয়ে ঠিক করেছেন। পাত্র তার দারুণ পছন্দ। কিন্তু আপনি জানেন মেরীর কথা বার্তা যেন কেমন? সে আমার সাথে পুরো ব্যাপারটি আলাপ করেছে বটে আমার মনে হলো সে আপনার উপর বিরক্ত। পাত্র নাকি আপনি ছাড়া কিছুই বোঝে না। যাই হোক তার বদ অভ্যাস হলো সে যেখানে পাবে সেখানেই পোশাক বদলাবে।
রেখা বলে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকতে পারে। যাই হোক দেখি তার সাথে দেখা করি।
টিউলিপ আবারো হাসে, আপু তোমাকে বারো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই থেকে রফিক ভাইকেও । তুমি যাকে আগলে রাখো তাকে কার কাছে দিতে চাও? জানি বাচ্চাইতো? সে মেরীর হবে না।অনেক আগেই তার অপারেশন হয়েছে। ইউটেরাস ফেলে দিয়েছে। তার এতো সমস্যা তুমি বা রফিক ভাই সামলাতে পারবে না। সে এখন একটু আশ্রয় খুঁজছে শুধু। বেচারা রফিক ভায়ের লাইফ শেষ করো না। রেখা আচ্ছা বলে ফোন রাখে। থর থর করে কাঁপতে থাকে। তার চিৎকার করে কান্না আসে। কী করতে যাচ্ছিলো ! রফিক কেবল বাবাই হতে চায় , একটা বাচ্চা তার চাই। সে কী করতে যাচ্ছিলো। টিউলিপকে ধন্যবাদ ।
বার বার ফোন করছে রফিককে, কোথায় সে? এ কাহিনী শুনলে হার্ট এটাক হবে। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বার বার ডায়াল করছে ফোন রিসিভ হচ্ছে না। কোথায় যাবে? কাকে জিজ্ঞেস করবে?
এই যখন ভাবনা তখনই টিভি ফুটেজে ভেসে উঠলো , অবশেষে ডিবি পুলিশ সন্ত্রাসী যার অত্যাচারে সমস্ত প্রশাসন অস্থির সেই রফিককে গ্রেফতার করেছে।
প্রশাসনের সাথে মাস্তানী করতে যেযাগ্যতা লাগে! সেটা রফিকেরই আছে। প্রশাসন জনগনের অধিকার ঠিকমতো না দিলে কে কথা বলবে!
রেখা মোটেই ভয় পায়নি। সোজা থানায় গিয়ে হাজির। তার পরের কাহিনী প্রিয় পাঠক সাজানো নাটক।
আমাদের ধ্বজভঙ্গ এ দেশে কেউ নৈতিকতা নিয়ে আইন নিয়ে সচ্ছ্বতা নিয়ে টিকে থাকতে পারেনি পারে না। কিন্তু রেখা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। টাকা যাক সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আছে শো করতে হবে। এরই মধ্যে নিপীড়িত শ্রেণি থেকে মন্ত্রী এমপি সকলেই তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। দেশব্যাপি মিডিয়ায় চলছে বিশ্লেষণ- সংশ্লেষণ। থানা ঘিরে ফেলেছে স্থানীয় জনগণ। অনেক আগে দেখা নাটকের বাকের ভায়ের মতো অভিনব সন্ত্রাসী যার জন্য প্রশাসনের এক অংশও দাঁড়িয়ে গিয়েছে। রেখা ভাবলো, গুটি কয়েক মানুষ খারাপ এদের হাতেই ক্ষমতা , এদের কাছেই মানুষ জিম্মি। না হয় এতো মানুষ কোথা থেকে বেরিয়ে এলো। সেদিন সারারাত রেখা থানায় দফায় দফায় মিছিল মিটিং করে সেই ডিবিপুলিশ কামালকে ইন্সট্যান্ট ক্লোজ করিয়ে রফিককে নিয়ে ঘরে ফিরে। মজার ব্যাপার হলো এই কামাল রফিককে ফোন করে চাঁদা দাবী করে। মাস্তানী করেন, মাদক ব্যবসা করেন টাকা দেন দশ লাখ টাকা। রফিক তখনই প্রতিবাদ করে আপনি যদি প্রমাণ করতে না পারেন আমি মাদকব্যবসায়ী তার জন্য কিন্তু আপনাকে খেসারত দিতে হবে। কামাল তখন রফিককে বলে,হালা তোরে আজই চালান দিমু মাদকব্যবসায়ী হিসেবে। যতো হাজার ইয়াবা লাগে ততো হাজারই আমার কাছে আছে। রফিকের ফোনে অটো রেকর্ড হয় । সাথে সাথে রফিক তা পুলিশের ডিআইজ, এসপি সবার কাছে পাঠিয়ে নিজের নিরাপত্তার জন্য অনুরোধ করে। কামাল তো বুঝতে পারেনি ‘শাপে বর’ হবে!
রফিকের নাম থেকে চিরতরে সন্ত্রাসী নামটি মুছে দিয়েছে মিডিয়া এবং পুলিশ প্রশাসন। সে একজন জনদরদী হিসেবে সবার কাছে নতুন মূর্তিতে দাঁড়ালো। পরদিন পত্রিকার হেড লাইন রফিক আসলে কে? বিস্তারিত পড়লে আপনিও বুঝে যাবেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছেন। এদেশের আপামর জনসাধারণের প্রাণের নেতা হয়েছেন। এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন প্রয়োজন নৈতিকতার উন্নয়ন । তাই প্রতিবাদ করতেই হবে যেন জনগনের টাকা কিছুতেই খাল কাটা ,মাছ ধরা, খিচুড়ি রান্না শেখার মতো প্রজেক্টে কেউ খরচ করতে না পারে। এ জন্য রফিকের মতো কোটি কোটি সন্ত্রাসীর জন্ম হোক।
রফিক চুপচাপ বসে আছে। রেখা কাঁদছে। এবার রফিকই মুখ খোলে,তাহলে তুমি কী করতে বলো?
রেখা রফিকের দিকে তাকিয়ে বলে- যা করতে মন সায় দেয় তাই করবে।
রফিক বলে, আমার মন চাচ্ছে তোমাকে কাছে পেতে বলেই রেখার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, রেখা হতবিহবল নির্বাক: হাত বাড়াবে নাকি ফিরিয়ে দেবে…
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ)
পিটিআই, মুন্সীগঞ্জ
কবি প্রাবব্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।