বিচার বিভাগের ইতিহাসে শীর্ষ জালিয়াতির ঘটনা
আদালত প্রতিবেদকঃ
জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও থেমে নেই উচ্চ আদালতে জালিয়াতির ঘটনা। বিচারিক আদালতের নথি জালিয়াতি করে হাইকোর্টে অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে কয়েকটি জালিয়াত চক্র। আদালতের সজাগ দৃষ্টি উপেক্ষা করে দিনের পর দিন এই চক্রগুলো কৌশল বদলে কলুষিত করছে বিচার বিভাগের পবিত্রতাকে।
তবে পুরনো সব ঘটনাকে ছাপিয়ে বিচার বিভাগের ইতিহাসে বড় একটি চাঞ্চল্যকর জালিয়াতির ঘটনা হাইকোর্টের নজরে এসেছে।
একটি অস্ত্র মামলায় ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুস সাত্তার নথি জাল করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়। পরে ওই জামিন বাতিল করায় আসামি কারাগার থেকে বের হতে পারেনি।
একটি পিস্তল ও গুলিসহ ২০১৮ সালে গ্রেফতার হয়েছিল চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কায়েতপাড়ার নিজাম উদ্দিনের ছেলে আব্দুস সাত্তার। পরে ওই মামলায় একমাত্র আসামি সাত্তারকে ১৭ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন বিচারিক আদালত। এরপর কারাগারে থেকেই সে এ মামলায় জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানায়। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে আসামি সাত্তারকে জামিন দেন হাইকোর্ট।
তবে জামিনের আদেশ হলেও পরবর্তীতে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়, এই অস্ত্র মামলার এজাহার, তদন্ত প্রতিবেদন, জব্দ তালিকা ও রায় পরিবর্তন করে জামিন চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিচারিক আদালতের সংশ্লিষ্ট সব নথি পাল্টে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি এ অস্ত্র মামলায় আব্দুস সাত্তার একমাত্র আসামি হওয়া সত্ত্বেও জাল নথিতে তাকে দুই নম্বর আসামি দেখানো হয়েছে। আর মামলার এক নম্বর আসামি দেখানো হয়েছে আব্দুস সালাম নামের এক ব্যক্তিকে। তবে জালিয়াত চক্র এখানেই থেমে যায়নি। মামলায় সাত্তারের কাছ থেকে অস্ত্র (পিস্তল) উদ্ধার করা হলেও জাল নথিতে চায়নিজ কুড়াল উদ্ধারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া মামলায় সাক্ষীদের দেওয়া প্রতিটি জবানবন্দিও পরিবর্তন করেছে হাইকোর্টে জামিন চাইতে আসা জালিয়াত চক্র।
পরে অভিনব এমন নথি জালিয়াতির ঘটনা বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আসে। এরপর আদালতে এ মামলার ওপর শুনানি হয়।
বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) মামলাটির শুনানিতে আদালতে আসামির পক্ষে হাজির ছিলেন আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
জামিন আবেদনের শুনানিকালে হাইকোর্ট বলেন, ‘জামিন জালিয়াতি চক্র নথি জাল করে কত জামিন আদেশ হাসিল করে কে জানে? হয়তো আমরা সব ধরতে পারি না। কিন্তু নথি তৈরি করে এরকম জামিন জালিয়াতি তো হচ্ছে।’
জামিন আবেদনের শুনানিতে আসামি সাত্তারের আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমানকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেন, ‘এই জামিন জালিয়াত চক্র আপনাকে চিনলো কীভাবে? (এর আগেও এই আইনজীবীর একটি মামলায় জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে) আরও দুটি জামিন জালিয়াতির মামলায় আপনি ও আপনার ক্লার্ক সোহেল রানার নাম এসেছে। একজন সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে কি আপনার কোনও দায়িত্ব নেই? মামলা পেলেন আর দাঁড়িয়ে গেলেন? জালিয়াত চক্র আপনার ওপর ভর করেছে কেন?’
জবাবে আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমান বলেন, ‘জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরে আমি আসামির এলাকায় আমার ছেলে ও দুই সহকারীকে পাঠিয়ে তথ্য নিয়ে এসে আদালতে দাখিল করেছি। শেষ বয়সে এসে আমাকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, আমি লজ্জিত!’
পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী আদালতকে বলেন, ‘এই অস্ত্র মামলার এজাহার, তদন্ত প্রতিবেদন, জব্দ তালিকা, সাক্ষ্য ও রায় পরিবর্তন করে জামিন চাওয়া হয়েছে। এর চেয়ে বড় জালিয়াতি বিচার বিভাগে হয়েছে কিনা, আমি জানি না!’
এ সময় আদালত বলেন, ‘সব নথিই তো সৃজনকৃত। এরকম অনেক জালিয়াতি হচ্ছে, হয়তো আমরা ধরতে পারি না।’
এরপর আসামি সাত্তারের আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমানের প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক আদালতকে বলেন, ‘উনি বৃদ্ধ মানুষ। উনি জালিয়াত চক্রের তিন জনের নাম আদালতে দিয়েছেন। ওই আবেদন গ্রহণ করে তাকে অব্যাহতি দিয়ে দিন।’
জবাবে হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা কক্সবাজারের সাড়ে সাত লাখ ইয়াবা মামলায় জামিন জালিয়াতির ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানানো হয়নি।’
পরে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্টে জামিন জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে মামলা দায়েরের এ নির্দেশ দেওয়া হয়। জালিয়াতিতে জড়িতরা হলো—আসামি আব্দুস সাত্তার, দুই কারারক্ষী বিশ্বজিত ওরফে বাবু ও খায়রুল, জামিন আবেদনের এফিডেভিটকারী আসামির পিতা নিজামুদ্দিন এবং মামলার তদবিরকারক।
এছাড়া তদন্তে আসামিপক্ষের আইনজীবীর জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে কারাগারে থাকা আসামি সাত্তারের জামিন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট।
এর আগেও হাইকোর্টে বহুবার জামিন জালিয়াতির এমন ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু সেসব জালিয়াতির ঘটনায় মাদক উদ্ধারের সংখ্যা, পরিমাণ কিংবা আসামির নাম বা সাজা পরিবর্তনের মতো নথি জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সাত্তারের মতো করে বিচারিক আদালতের যাবতীয় সব নথি বদলে ফেলা, তথা জালিয়াতির ঘটনায় এটাই সবচেয়ে বড় বলে মনে করছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
এসব জালিয়াতির ঘটনায় বিব্রত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা। এ বিষয়ে সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘তদন্ত ছাড়া কোনও আইনজীবীকে দায়ী করবো না। তবে কোনও আইনজীবীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জামিন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের জালিয়াতিতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’