জনপ্রশাসনে পদোন্নতি পোস্টিং বদলি বৃত্তে আটকা

Picsart_22-10-26_15-39-52-328.jpg

জনপ্রশাসনে পদোন্নতি পোস্টিং বদলি বৃত্তে আটকা

জনপ্রশাসন এখন পদোন্নতি, পোস্টিং আর বদলির চক্রে আটকা পড়ে আছে। এর বাইরে বেরিয়ে প্রশাসনকে গতিশীল সংস্কার করে সত্যিকার জনবান্ধব প্রশাসন তৈরির কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে—জনবান্ধব প্রশাসনের জন্য দরকার দক্ষ যোগ্য মানবিক কর্মকর্তা। এজন্য প্রশিক্ষণ বড় মাধ্যম; কিন্তু প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কোনো কাজে আসছে না আমলাতন্ত্রে। যে কর্মকর্তা যে বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছেন বা চাকরিতে প্রবেশ করে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন যেসব বিষয় মূল্যায়ন করে প্রশাসনে পদায়ন করা হয় না। বস্তুত ‘মুখচেনা’ এক অদৃশ্য পদ্ধতিতে পদায়ন হয়ে থাকে। যদিও পদায়ন সম্পর্কিত একটি নীতিমালা আছে কিন্তু তা এখন ‘কিতাবি’ বলেই বলা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর গুচ্ছ পদ্ধতিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের কাজকর্ম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এখানে বলা হয়েছিল একেক জন কর্মকর্তাকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ তৈরি করে তাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হবে এবং তিনি চাকরি জীবনের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান সেই মন্ত্রণালয়ের কাজে লাগাবেন; কিন্তু তা এখন মৃত ইতিহাস।

দেশ স্বাধীনের সময়টা ৫০ বছর পেড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হলে কাঙ্ক্ষিত জনবান্ধব, দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসনের স্বপ্ন আজও অধরা। সুষ্ঠুনীতি ও পরিকল্পনার অভাব, দলবাজি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তের অভাব, কর্তৃপক্ষের পছন্দ-অপছন্দের নীতি ইত্যাদি কারণ দক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় অন্তরায় বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞ মহল বলছেন, বস্তুত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, নিয়োগ পদোন্নতি পদায়ন—এসব ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিয়ে সে অনুযায়ী বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল বহু আগেই। আর সেটা না করায় কাঙ্ক্ষিত প্রশাসন গড়ে ওঠেনি।

ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ একজন সাবেক সচিব বলেন, অষ্টম শ্রেণি থেকে মেধা অনুযায়ী শ্রেণি বিভাজন করা দরকার। ঐ সময় সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন শিক্ষার্থী কোন বিভাগে পড়াশুনা করতে পারবে; কিন্তু এখনো শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের ইচ্ছা অনুযায়ী বিভাগ নির্ধারণ করা হয়। বিশেষ করে বিসিএসে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন চাকরিপ্রত্যাশীকে একাধিক ক্যাডার পছন্দ করার সুযোগ রাখা হয়; কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশী ব্যক্তির শিক্ষাজীবনের মৌলিক বিষয় এ ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্ব পায় না। যদি মৌলিক বিষয়ে নজর রেখে ক্যাডার পছন্দের সুযোগ দেওয়া হতো তাহলে সে সেই ক্ষেত্রে যোগ্যতার ছাপ রাখতে পারতেন।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ, পদোন্নতি বা পদায়নের কর্তৃত্ব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজস্ব বিবেচনা অনুযায়ী কিছু করতে পারেন না। কখনো কখনো যে কর্মকর্তাকে যে মন্ত্রণালয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন বা দেন সেই কর্মকর্তা তখন দলীয় ক্ষমতা দেখিয়ে মন্ত্রী এমপি বা আরো ওপর থেকে তদবির করে তা পালটাতে বাধ্য করেন। আবার নির্দিষ্ট একটি বলয় কাজ করে কোন কর্মকর্তার পদোন্নতি হবে কোথায় তার পোস্টিং হবে বা আদৌ পদোন্নতি দেওয়া যাবে কি না, ইত্যাদি তারাই নির্ধারণ করেন। অবশ্য সময়ে সময়ে বলয়ের কর্তৃত্ব খর্ব হলেও নতুন নতুন বলয় সবসময় সক্রিয় থাকে।

একজন কর্মকর্তার নিয়োগের পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে বুনিয়াদি থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিষয়ভিত্তিক দেশে-বিদেশে ডক্টরেট করার সুযোগ দেওয়া হয়। বিদেশেও পড়াশোনাসহ নানা ধরনের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়; কিন্তু বাস্তবে এই প্রশিক্ষণ কি কোনো কাজে লাগে? এই জিজ্ঞাসা ৫০ বছরের পুরোনো। দেখা যায় নির্দিষ্ট একটি মন্ত্রণালয় থেকে ১০/১২ জন কর্মকর্তা ঐ মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মের ওপর বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে গেছেন; কিন্তু ঐ প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থায় তার অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করে দেওয়া হয়েছে বা দেশে আসার কিছুদিন পর মন্ত্রণালয় পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। আবার একজন কর্মকর্তা যে বিষয়ের ওপর বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে পিএইচডি লাভ করেছেন তার সেই বিষয় মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠানে ঠাঁই হচ্ছে না। আসলে নিয়োগ বদলি পদায়নের মূল নিয়ামকই হয়ে উঠেছে তদবির। অবশ্য সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তদবিরে পদায়ন বদলির বিষয়ে কঠোর নীতিমালা করছে বলে জানা যায়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দাবি—যোগ্য অভিজ্ঞতা দক্ষতা ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ইত্যাদি বিবেচনা করেই প্রশাসনে নিয়োগ বদলি পদায়ন হচ্ছে। যদিও নৈতিকতা আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ ইত্যাদি পর্যালোচনার কথা বলা হয়ে থাকে বস্তুত ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দই পদোন্নতি নিয়োগ বদলির প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে।

এ কর্মকর্তা বলেন, ছোটখাটো ভুলত্রুটি হতে পারে। সেটি জানা গেলে সংশোধন করা হয়। তিনি বলেন, প্রশাসন এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় গতিশীল ও দক্ষ। একটি দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব বর্তমান বেবজার চেয়ারম্যান শেখ মো. ইউসুফ হারুনের সোজাসাপটা জবাব রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দিতেই হবে। ফলে রাজনৈতিক আদর্শগত দিক থেকে যে কোনো সুপারিশ আসতেই পারে। সেটি যথাযথ হলে মানতে দোষের কিছু নেই।

গুচ্ছপদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দক্ষ বা যোগ্য প্রশাসন গড়ে তোলা সহজতর হতো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে এটি একটি বড় সংস্কার। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়োগ পদ্ধতিসহ সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়ে হাত দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বাস্তবতা হচ্ছে—এসব দিকে নজর নেই সংশ্লিষ্টদের। তারা পদোন্নতি পোস্টিং বদলির চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছেন।

এটাই তাদের প্রধানতম কাজ বলে দৃশ্যত ধারণা করা হয়।

ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top