সাদিয়ার শিকার শতাধিক পাত্র, দ্বিতীয় স্বামীর নেতৃত্বে প্রতারনা
অপরাধ প্রতিবেদকঃ ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে ১০ বছর ধরে প্রতারণা করে আসছে সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৮)।
একদিনেই এই নারী পাত্রদের কাছ থেকে ৪০ লাখের বেশি টাকা তুলেছেন। তবে কেউ জানতো না কারও তথ্য। শতাধিক পাত্র তার শিকার হয়েছে। এই ব্যবসা করে সাদিয়া অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছে। রিমান্ডে থাকা সাদিয়া সিআইডিকে তথ্য দেওয়া শুরু করেছে।
তবে প্রতারক চক্রের মূল হোতা সাদিয়ার স্বামীসহ আরও চার সদস্য এখনও পলাতক।
সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে সাদিয়া প্রতারণার নানা কলাকৌশল বলতে শুরু করেছে। কখনও অবিবাহিত যুবক, কখনও বিপত্নীক, কখনও তালাকপ্রাপ্ত, কখনও নামাজি আবার কখনও বয়স্ক পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতো সাদিয়া। যে পাত্রের জন্য যেমন পাত্রী দরকার তেমন রূপেই নিজেকে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করতো। বিশেষ করে ধনাঢ্য পাত্রদের টার্গেট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দিয়েই বেশি প্রতারণা করতো।
এভাবে গত প্রায় ১০ বছর ধরে শতাধিক পাত্রের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাদিয়া।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে গ্রেফতারের পরদিন শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে সিআইডি।
পাত্রদের কাছ থেকে টাকা নিতে ডায়েরি ব্যবহার করতো সাদিয়া। কে কত কখন টাকা দিয়েছে সব লিখে রাখতো। এরপর নিতো পাত্রদের পাসপোর্টসহ বিভিন্ন কাগজপত্র। যা তার বাসা থেকেই উদ্ধার হয়েছে।
শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানান, দৈনিক পত্রিকায় পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে সাদিয়ার প্রতারণার অনেক তথ্য মিলেছে। তার কাছে থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরি, মোবাইল ফোন ও সিম কার্ডেই মিলেছে শতাধিক পাত্রের তথ্য। ইতোমধ্যে তদন্তের প্রয়োজনে ওইসব ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে সিআইডি। পাশাপাশি সাদিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার প্রতারণার কৌশল ও প্রতারক-চক্রের বাকি সদস্যদের বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করছে।
সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে তার বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরিতে বিভিন্ন পাত্রের নাম পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছে সেই হিসাবও পাওয়া গেছে। এছাড়া পাত্র হিসাবে যাদের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের বিষয়েও আলাদা হিসাবের তথ্য মিলেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, সাদিয়া খুবই ধূর্ত প্রকৃতির। দ্বিতীয় স্বামীর অবস্থানের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মনে হয়েছে, সে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, দৈনিক পত্রিকায় একাধিক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতো এই চক্রের সদস্যরা। সেখানে থাকতো যোগাযোগের একাধিক মোবাইল নম্বর। প্রকাশ হওয়া বিজ্ঞাপন অনুযায়ী যিনি যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে কথা বলে তার ইচ্ছে জেনে সেই অনুযায়ী প্রতারণার কৌশল ঠিক করতো। এভাবে গত ১০ বছরে শত শত পাত্রের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের জিজ্ঞাসাবাদকারী আরেক কর্মকর্তা বলেন, সাদিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন আলামতের মাধ্যমে শতাধিক পাত্রের সন্ধান মিলেছে। যাদের কাছ থেকে সাদিয়া বিভিন্ন অংকের টাকা নিয়েছে। এখন তার দ্বিতীয় স্বামীকে ধরতে পারলেই প্রতারণার পুরো চিত্র পাওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, সাদিয়ার প্রতারণার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবগুলো শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এসব হিসাব পাওয়ার পর চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তার আর্থিক লেনদেনের সব তথ্য বের করা হবে। এরপর তার প্রকৃত অর্থের হিসাব জানা যাবে।
তিনি আরও জানান, সাদিয়াকে যেদিন গ্রেফতার করা হয়, ওইদিনই সে চারটি ব্যাংকে প্রায় ৪০ লাখ টাকার এফডিআর করেছে। এছাড়া টার্গেট করা পাত্রদের কাছ থেকে সবসময়ই নগদ টাকা নিতো। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা গ্রহণ করতো না। এছাড়া তার বাসা থেকে যেসব জমির দলিল উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলোও যাচাই করা হচ্ছে। যেসব ভুক্তভোগীর পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে সিআইডির পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। এছাড়া উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন সিম কার্ডে থাকা নাম ও নম্বরের সূত্র ধরে ভুক্তভোগীদের তালিকা করা হচ্ছে। সেই মোতাবেক তাদের ডেকে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তবে ভুক্তভোগীদের অনেকেই প্রতারিত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও নাম পরিচয় প্রকাশ হওয়ার ভয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, প্রতারণার ক্ষেত্রে খুবই কৌশলী সাদিয়া। তিনি একজন পাত্রের সঙ্গে কথা বলার জন্য পৃথক সিম কার্ড ব্যবহার করতো। যে নম্বরে যার সঙ্গে যোগাযোগ করতো, সেই নম্বর দিয়ে অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতো না। টার্গেট করা পাত্রের সঙ্গে কথাবলা ও প্রতারণা শেষ হওয়ার পর ওই সিম-কার্ড ফেলে দিতো। কখনও কখনও মোবাইল ফোন সেটও ফেলে দিতো।
কুমিল্লার দেবীদ্বারের বাসিন্দা সাদিয়া প্রতারণার উদ্দেশ্যেই দ্বিতীয় স্বামী বরিশালের মুলাদিয়ার বাসিন্দা এনামুল হাসান জিসাদকে বিয়ে করে। বিয়ের আগে তাদের দুজনের মধ্যে ফেসবুকে পরিচয় হয়। সেখানেই এই প্রতারণার কৌশল নিয়ে কথাবার্তা চলে। তারপর বিয়ে করে প্রতারণার চক্র গড়ে তোলে তারা। রিমান্ডে সাদিয়ার তথ্যানুযায়ী তাদের দ্বিতীয় ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলেমেয়েরা তাদের নানীর সঙ্গে বেড়াতে গেছে বলে দাবি করলেও আসলে তারা আত্মগোপন করেছে বলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের সিনিয়র সহকারী বিশেষ পুলিশ সুপার জিসান আহমেদ বলেন, প্রতারক সাদিয়া ও তার চক্রের মাধ্যমে শত শত মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। যাদের অনেকেই সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন।
সাদিয়া জান্নাতের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বারে। দ্বিতীয় স্বামী এনামুল হাসানকে নিয়ে সাদিয়া গড়ে তোলে ৫ সদস্যের চক্র। বাকি সদস্যরা হলো শাহরিয়ার, ফারজানা এবং আবু সুফিয়ান। এছাড়া আরও একাধিক ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রের প্রধান হিসাবে সাদিয়া বিয়ের জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপনে কখনও উল্লেখ করতো, ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কানাডার সিটিজেন ডিভোর্সি সন্তানহীন পাত্রীর জন্য পাত্র প্রয়োজন। পাত্রীর ব্যবসার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী বয়স্ক পাত্রের অগ্রাধিকার।’ এছাড়া কখনও কখনও অবিবাহিত যুবক ও বয়স্ক পাত্রের জন্য আলাদা আলাদা বিজ্ঞাপন দিতো। যোগাযোগের ঠিকানা থাকতো ভিন্ন ভিন্ন। সর্বশেষ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী নাজির হোসেন তার প্রতারণার শিকার হওয়ার পর সিআইডির কাছে অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের তদন্তের একপর্যায়ে সাদিয়া ধরা পড়ে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের বিশেষ পুলিশ সুপার সামসুন্নাহার বলেন, রিমান্ডের প্রথম দিনে সাদিয়া ঠিকমতো কথা বলেনি। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তারপরও তার কাছ থেকে উদ্ধার করা বিভিন্ন আলামত বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। যেগুলো যাচাইয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, সাদিয়ার প্রতারণার অন্যতম সহযোগী তার দ্বিতীয় স্বামীসহ অন্তত আরও চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।