বাপেক্সের ১০ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অনিয়ম

Picsart_22-12-13_09-33-56-329.jpg

বাপেক্সের ১০ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অনিয়ম

দুদকের তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
ফেঁসে যাচ্ছেন বাপেক্সের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারী।
প্রকল্পের টাকা লোপাট ও বিনা টেন্ডারে একই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে! লোক নিয়োগ এবং স্থায়ীকরণে ভয়াবহ অনিয়ম

অপরাধ প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ফেঁসে যাচ্ছেন।

দুদকের প্রাথমিক তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন মহাব্যবস্থাপক (জিএম), উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও ব্যবস্থাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও বাপেক্সে কর্মচারী শ্রমিক লীগের একজন নেতা। দুদক সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ মেলেছে।

তাদের বেশির ভাগ বাপেক্সের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) পদে কর্মরত ছিলেন। সেসময় নানাভাবে তারা প্রকল্পের টাকা লোপাট, ঘুস বাণিজ্যের মাধ্যমে বিনা টেন্ডারে বারবার একই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। এছাড়া লোক নিয়োগ এবং স্থায়ীকরণে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাসনদ ছাড়াই বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ। এসব নিয়োগে বড় ধরনের অর্থ বাণিজ্য হয়েছিল বলেও অভিযোগ আছে।

ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বেশির ভাগই সদস্য তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডন করতে পারেননি। নিজদের পক্ষে কোনো যুক্তিও দেখাতে পারেননি দুদকে। এ কারণে অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশে যাওয়াসহ স্টেশন ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে।

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নন, এসব ঘটনায় ফেঁসে যাবে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও। নাম আছে কয়েকটি আউটসোর্সিং কোম্পানিরও। ইতোমধ্যে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ফাইল জব্দ করেছে দুদক। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর ওপর কোনো অডিট বা অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়ে থাকলে তাও হস্তান্তরের জন্য বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক।

একই সঙ্গে প্রকল্পগুলোর ভৌত এবং আর্থিক অগ্রগতিসংক্রান্ত তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। জানা যায়, বাপেক্সও কিছুদিন আগে সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট দুর্নীতি দমন কমিশনে হস্তান্তর করে।

সূত্রে জানা যায়, বাপেক্সের একজন প্রভাবশালী সিবিএ নেতার নামও উঠে এসেছে তাদের তদন্তে। তার নাম মাজহারুল ইসলাম। এই সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি বাপেক্সের বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন। এছাড়া প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে যোগসাজশে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে শীর্ষ ম্যানেজমেন্টকে ম্যানেজ করতেন।

বাপেক্সের বিভিন্ন শাখার কর্মচারী নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি তার ইশারা ছাড়া হয় না। শুধু কর্মচারী নন, শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদেরও পদোন্নতি ও বদলিতে তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের অভিযোগে মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে বাপেক্সে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে টাকা পরিশোধ না করারও অভিযোগ আছে।

অফিসের অনুমতি ছাড়া তিনি সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসাবে উপস্থিত থাকারও অভিযোগ আছে।

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, বাপেক্সের রূপকল্প-৩-এর পিডি (প্রকল্প পরিচালক), ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ প্রকল্পের পিডি, দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের পিডি, রূপকল্প-১-এর প্রকল্প পরিচালক, রূপকল্প-২-এর প্রকল্প পরিচালক, রূপকল্প-৪-এর প্রকল্প পরিচালক, ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের (ব্লক ৩বি, ৬বি ও ৭) প্রকল্প পরিচালক ও ভূতাত্ত্বিক জরিপ সরঞ্জাম ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালকের বিরুদ্ধেও দুদক তদন্ত শেষ করেছে। ব্যবস্থাপকদের মধ্যে রূপকল্প-৫-এর পিডি ও রূপকল্প-৯-এর পিডির বিরুদ্ধেও বেশকিছু অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

উল্লেখ্য, দুদকের তদন্ত শুরু হওয়ার পর তাদের অনেককে উল্লিখিত পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী গণমাধ্যমে বলেন, বাপেক্সে কোনো ধরনের দুর্নীতির ঠাঁই নেই। দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই কেউ যদি দুর্নীতি কিংবা অনিয়ম করেন, তাদের শাস্তি পেতে হবে। দুদক তার নিয়মে কাজ করবে। এছাড়া সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরাও বিভাগীয় তদন্ত করে থাকি।

জানা যায়, দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম এর আগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের তার অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকে বিনা টেন্ডারে বারবার একই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ প্রকল্পের পিডি ও একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিলে ২৪৭ কোটি ৭০ লাখ টাকায় ৯টি স্থানে জরিপ করেছে। এ জায়গাগুলোর মধ্যে কোনোটি বড় আবার কোনোটি অনেক ছোট। জায়গা যাই হোক না কেন, প্রতিটির জন্য সমান যন্ত্রপাতি ও শ্রমিক দেখানো হয়েছে। ফলে ব্যয়ের হারও সমান হয়েছে। যাতে অনিয়মের ছাপ স্পষ্ট।

দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন, ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিযুক্ত এক ডিজিএম বাপেক্সে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। বিনা টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেওয়া, শ্রমিক নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে ২৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার সিন্ডিকেট। তার বিরুদ্ধে আনা এ অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করেছে বাপেক্স।

জানা যায়, ২৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভূতাত্ত্বিক জরিপের কাজ করেছে বাপেক্স। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ হিসাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা-সার্বক্ষণিক কর্মরত জনবল ছিল ১২০০ জন। এতে জনবল বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। আর যানবাহনের ব্যয় দেখিয়েছে ৮০ কোটি টাকা। তবে জরিপ এলাকাগুলোর মধ্যে ১৫০, ২০০, ৩০০ ও ৬০০ বর্গকিলোমিটার জায়গাও ছিল। সেখানেও একই শ্রমিক ও একই পরিমাণ যানবাহন দেখানো হয়েছে।

প্রকল্পে নিয়ম না মেনে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রথম ধাপে ২ কোটি ৮০ লাখ ও দ্বিতীয় ধাপে ১৪ কোটি ৮ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও সেগুলো এখনো আসেনি। এছাড়া টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৫৮ কোটি ৫০ লাখ এবং ১৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top