বন্ধ হোক বিয়ে নামক ইত্রামি – তসলিমা নাসরিন

PicsArt_06-30-09.48.14.jpg

বন্ধ হোক বিয়ে নামক ইত্রামি – তসলিমা নাসরিন

বাপ মায়ের বাড়িতে বিয়ে করে বউ তোলে পুরুষেরা, আজো। পুরুষেরা এডাল্ট বা প্রাপ্ত বয়স্ক হতে চায় না। তারা মা বাপের কোলের শিশু হয়ে আজীবন কাটিয়ে দিতে চায়। বাপ মা ভাই বোন গায়ে গতরে বড় হওয়া পুরুষটির দেখভাল করে, তারপর যোগ হয় বধূ। আরেক সেবাদাসি। প্রাপ্ত বয়স্কের মতো নিজের দায়িত্ব নেওয়ার কাজটি আজও আমাদের বেশির ভাগ পুরুষ দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। বধূটি সম্পূর্ণ একটি নতুন পরিবেশে হিমশিম খায়। সবার মন রক্ষা করে চলতে হবে, না হলে লোকে তাকে মন্দ বলবে। নিজের স্বকীয়তা স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হয় মেয়েদের। এক্ষুণি আমি জানি শত মেয়ে এসে বলবে তাদের শ্বশুর শাশুড়ি কত ভালো, একেবারেই তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়নি। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটি মেয়েকে কেন স্বামীর আত্মীয়স্বজনের সংগে বাস করতে হবে, স্বামীকে তো মেয়ের আত্মীয় স্বজনের সংগে বাস করতে, এবং সবার মন জুগিয়ে চলতে বলা হয় না! বিয়ে হলে একটি মেয়েকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি, চেনা পরিবেশ, চেনা এলাকা ত্যাগ করে স্বামীর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। একটি পুরুষকে বিয়ে হলে কিছুই ত্যাগ করতে হয় না। অসম্যের একটা সীমা থাকা দরকার। বিয়ে সব সীমা ছাড়িয়ে যায়।

আসামের একটি লোক স্ত্রীকে তালাক দিতে চেয়েছে, কারণ স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে চায় না। এটাই লোকটির তালাক দেওয়ার কারণ। স্ত্রী যদি পছন্দ না করে স্বামী ছাড়া অন্য কারো সংগে বাস করতে, তখন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা স্ত্রী নিয়ে আলাদা সংসার করে, কিন্তু মা বাপের কোলের শিশুরা মা বাপের সংগে বাস করার জন্য গোঁ ধরে, স্ত্রীকে ত্যাগ করতে আপত্তি নেই তাদের। আমাদের পুরুষেরা কি শুধু মা বাপের কোলের শিশু? তারা তো ছলে বলে কৌশলে স্ত্রীদেরও কোলের শিশু বনে যায়। স্ত্রীরা তাদের নাওয়া খাওয়া থেকে শুরু করে তাদের জুতো মোজারও তদারকি করবে– এটাই চায় তারা।

আসামের অপদার্থ লোকটির প্রাপ্তবয়স্ক এবং দায়িত্বশীল পুরুষ হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। তাই তালাকের আয়োজন। বিচারক লক্ষ্য করেছেন লোকটির স্ত্রী শাঁখা সিঁদুর পরেননি। শাঁখা সিঁদুর না পরা মানে স্ত্রীটি নিজেকে বিবাহিতা বলে মনে করতে চাইছেন না, বিচারক এমন মন্তব্যই করেছেন। দুজন মানুষ একত্রে বাস করতে না চাইলে, দুজনের মধ্যে ভালোবাসা অবশিষ্ট না থাকলে, কেউ একজনও ভেবে চিন্তে তালাকের সিদ্ধান্ত নিলে কোনওরকম সমস্যা ছাড়াই তালাক সম্পন্ন হওয়া উচিত। হয়েওছে তাই।

তালাক নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু বিচারকের মন্তব্যটি নিয়ে আপত্তির আওয়াজ কানে আসছে। বিবাহিত মেয়ে মানেই শাঁখা সিঁদুর! ওদিকে বিবাহিত পুরুষ মানেই অবিবাহিত পুরুষ। একটি পুরুষকে দেখে কেউ বলতে পারবে না সে বিবাহিত কি না। বিবাহিত এবং অবিবাহিত পুরুষেরা দেখতে একই। বিবাহিত পুরুষদের শরীরে সকাল সন্ধ্যে কোনও বিবাহের চিহ্ন বহন করতে হয় না। তাদের কোনও শাঁখা সিঁদুর পরতে হয় না। হুম, অসাম্যের একটা সীমা থাকা দরকার। সীমা যে নেই, আমরা জানি। বলছি, মেয়েদের, এমনকী স্বামীকে ভালোবাসেন এমন মেয়েদেরও যদি ইচ্ছে না করে শাঁখা সিঁদুর পরতে? তাহলে নিশ্চয়ই তাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত ওসব না পরার? বিয়েটা বন্দিত্ব না হয়ে মুক্তি কেন হতে পারে না?

ইউরোপ আমেরিকায় বিবাহিত ক্রিশ্চান আর ইহুদি পুরুষ এবং নারী অনামিকায় বিয়ের অঙ্গুরি পরে। ওটিই তাদের বিয়ের চিহ্ন। কোনও দম্পতি যদি ইচ্ছে না করে অঙ্গুরি পরতে, তারা পরে না। সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে এই স্বাধীনতা থাকা উচিত। মুসলমান নারী এবং পুরুষ বিবাহিত বা বিবাহিতা হওয়ার কোনও চিহ্ন বহন করে না, বহন করে না বলে মেয়েরা যে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করে তা নয়। মুসলমান মেয়েরাও একই রকম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভুক্তভোগী।

বিয়েটা দিন দিন ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে । প্রভু দাসির সম্পর্ককে আইনত বৈধ করার জন্য বিয়ে নামক ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল। মেয়েদের দুর্বল, পরনির্ভর ভাবা হতো বলে, মেয়েদের শুধু যোনী আর জরায়ু ভাবা হতো বলে শুরু হয়েছিল। মেয়েদের শরীরকে অধিকার ভুক্ত করার জন্য শুরু হয়েছিল। ওইসব কারণের প্রতিটি এখন অকেজো। যে মেয়ে দুর্বল নয়, যে মেয়ে স্বনির্ভর, যে মেয়ের পরিচয় যোনী আর জরায়ু নয়, যে মেয়ে নিজের স্বাধীনতা এবং অধিকারে বিশ্বাস করে, যে মেয়ে প্রভু দাসির সম্পর্ক মানে না, সে মেয়ে বিয়েটা কোন দুঃখে করবে? বিয়েটা দরকার কিছু কোলের শিশু হওয়ার বাসনায় বুড়ো আঙ্গুল চুষছে যে পুরুষগুলো, তাদের।

কোনও বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষিত সচেতন নারী পুরুষের জন্য বিয়ের দরকার নেই। পৃথিবীটা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হোক, আর সেইসাথে বন্ধ হোক বিয়ে নামক ইত্রামি।

তসলিমা নাসরিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top