৬৭৭ কোটি টাকার গরমিল সাবরেজিস্ট্রার অফিসে
বিশেষ প্রতিবেদকঃ সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের আর্থিক কার্যক্রম নিরীক্ষায় (অডিট) ৬৭৭ কোটি ৭৫ লাখ ৭ হাজার ৩৬০ টাকার অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কিংবা বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়।
যেটিকে ‘গুরুতর আর্থিক অনিয়ম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সিএজি। আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।
আইন ও বিচার বিভাগের অধীন নিবন্ধন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ৭৩টি সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক কার্যক্রমের ওপর নিরীক্ষা চালায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অডিট অধিদপ্তর।
২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ এবং ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সময়কালে এ অডিট করা হয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতবুধবার সংবিধানের ১৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে মোট ৪৯টি অডিট ও হিসাব রিপোর্ট উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়সমূহের হিসাব সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স রিপোর্টে উক্ত ৬৭৭ কোটি ৭৫ লাখ ৭ হজার ৩৬০ টাকার অডিট আপত্তির বিষয়টি উঠে এসেছে।
সংসদে উপস্থাপিত অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, জমির প্রকৃত শ্রেণি পরিবর্তন করে নিম্ন শ্রেণির বাজারমূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন করায় সরকারের ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার ১৬১ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
বাজারমূল্য অপেক্ষা কম মূল্যে জমি রেজিস্ট্রি করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় ১ কোটি ৪৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৫ টাকা। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত প্লটের মূল্য অপেক্ষায় কম মূল্যে জমি রেজিস্ট্রি করায় সরকার রাজস্ব হারায় ২৩ লাখ ৫ হাজার ৮৯০ টাকা।
বন বিভাগের গেজেটভুক্ত খাসজমি অনিয়মিত ভাবে রেজিস্ট্রেশন করায় ১ কোটি ৯৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকার সরকারি সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে।
জমির প্রকৃত মূল্য (বায়নামূল্য) অপেক্ষায় কম মূল্য দেখিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৮০ হাজার ৮২৮ টাকা।
অডিট রিপোর্টে জানানো হয়, প্রযোজ্য হারে উৎসে কর আদায় না করে জমি রেজিস্ট্রি করায় সরকারের ১ কোটি ৭৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯৫৮ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
ডেভেলপার বা হাউজিং কোম্পানি কর্তৃক প্রকৃত শ্রেণি অনুযায়ী জমি/প্লট রেজিস্ট্রেশন না করে নিম্ন শ্রেণির বাজারমূল্যে রেজিস্ট্রেশন করায় সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৯ টাকা।
আইজিআর (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব্ রেজিস্ট্রেশন) তহবিলের ৬৫৬ কোটি ৬৯ লাখ ৮২ হাজার ৪৯২ টাকা সরকারের হিসাবের বাইরে রেখে এফডিআর হিসাবে জমা রাখা হয়েছে।
সংসদে অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপিত এ অডিট রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের জন্য বালাম বই সরবরাহ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে অতিরিক্ত ৪ কোটি ৮৫ লাখ ৪৮ হাজার ৪০০ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে।
চুক্তির শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে মালামাল সরবরাহ না করা সত্ত্বেও পারফরমেন্স গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত না করায় সরকারের ক্ষতি হয় ৯৪ লাখ ১২ হাজার ৪০ টাকা।
মুদ্রণ ও বাঁধাই কাজকে শুধু ‘বাঁধাই’ কাজ দেখিয়ে ভ্যাট আদায় না করায় সরকার রাজস্ব হারায় ১ কোটি ৩০ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৭ টাকা।
এছাড়াও সর্বমোট ৬৭৭ কোটি ৭৫ লাখ ৭ হজার ৩৬০ টাকার অনিয়মের মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত হার অপেক্ষা কম হারে আয়কর কর্তন করায় সরকারের ৮ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতির ঘটনা।
উল্লেখ্য, সংবিধানের ১২৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব এবং সকল আদালত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর হিসাব অডিট করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সংসদে উপস্থাপনের জন্য সংবিধানের ১৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সিএজি মো. নূরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ অডিট রিপোর্ট এ বছরের মার্চে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়।
জমির প্রকৃত শ্রেণি পরিবর্তন করে নিম্ন শ্রেণির বাজারমূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন
জমির প্রকৃত শ্রেণি পরিবর্তন করে নিম্ন শ্রেণির বাজারমূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন করায় সরকারের ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার ১৬১ টাকা রাজস্ব ক্ষতির বিষয়ে অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে আইন ও বিচার বিভাগের ২০০৮ সালের ১৬ জুনের জারিকৃত নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে। অডিট আপত্তির জবাবে খুলনা সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিস অডিট অধিদপ্তরকে জানিয়েছিল, ‘আদালত কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে রেজিস্ট্রি করায় সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হয়নি’। তবে এ ব্যাপারে আদালতের কোনো আদেশ দেখাতে পারেনি খুলনা সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিস। আর মাদারীপুর সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিস অডিট অধিদপ্তরকে জানিয়েছিল, ‘যথাযথভাবে যাচাই করার সুযোগ না থাকায় পক্ষগণ কর্তৃক প্রদত্ত ডকুমেন্ট দেখে রেজিস্ট্রেশন কার্য সম্পাদন করায় জমির শ্রেণি যথাযথ ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি’।
এ অডিট আপত্তির ক্ষেত্রে নিরীক্ষা মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরবর্তী সময়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৭টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মধ্যে দুটির আপত্তিকৃত টাকা আংশিক আদায় করা হয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের আপত্তিতে জড়িত ছয়টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মধ্যে পাঁচটির জবাব পাওয়া গেছে। একটির জবাব পাওয়া যায়নি।
আইজিআর তহবিলের ৬৫৬ কোটি টাকা সরকারের হিসাবের বাইরে
আইজিআর (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন) তহবিলের ৬৫৬ কোটি ৬৯ লাখ ৮২ হাজার ৪৯২ টাকা সরকারের হিসাবের বাইরে রেখে এফডিআর হিসাবে জমাসংক্রান্ত অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সরকারের নন-ট্যাক্স রেভিনিউ বিধায়, তা ট্রেজারি রুলস্-এর উপবিধি ৭(১)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের অর্থ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক ছিল। তবে তা করা হয়নি। উল্লিখিত অর্থ এফডিআরে জমা করে সরকারের হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে, যা গুরুতর আর্থিক অনিয়ম। আপত্তিকৃত অর্থ সরকারের কোষাগারে জমার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে সিএজি।
উল্লেখ্য, দলিল নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, পরিদর্শন ও তদারকি করার দায়িত্ব নিবন্ধন অধিদপ্তরের। মাঠ পর্যায়ে ৬১টি জেলায় ৬১টি জেলা রেজিস্ট্রার (তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে), ৬১টি জেলা রেকর্ড রুম এবং ৫০১টি সাবরেজিস্ট্রি অফিস রয়েছে।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আল মামুনকে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব দিয়েছে সরকার
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
সারাদেশে জমির নিবন্ধন কর কমানো হয়েছে; জমির ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই সুবিধা পাবেন
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
জমি-ফ্ল্যাট নিবন্ধনে কমছে কর; জুলাই ও আগস্ট মাসে ২০-৩০ শতাংশ রাজস্ব কম আদায়
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার – ঘুস দুর্নীতিতে সাবরেজিস্ট্রাররা বেপরোয়া
আরও সংবাদ পড়ুন।
কালামপুর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের নবনির্মিত ভবন শুভ উদ্বোধন