জমি ক্রয়-বিক্রয় অনলাইন রেজিস্ট্রেশন শুরু আগামী বছর থেকে
বিশেষ প্রতিনিধিঃ ই-নামজারি এবং অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর চালুর পর এবার সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-রেজিস্ট্রেশন বা অনলাইনের মাধ্যমে নিবন্ধনব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
পরীক্ষামূলক ভাবে অনলাইনে ১৭টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ভূমি নিবন্ধন কার্যক্রম চালুর পর ফল সফল হওয়ায় তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১ জেলার ৪৯৭টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কাগজের ভলিউমে দলিল রেজিস্ট্রির পরিবর্তে অনলাইনে দলিল রেজিস্ট্রি ও রেকর্ড সংরক্ষণের কার্যক্রম চালুর একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। নিবন্ধন অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটি অনুমোদন হলে আগামী বছরের শুরু থেকেই সারা দেশে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে দলিল রেজিস্ট্রির পরিবর্তে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন চালু করা হবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভূমি নিবন্ধন কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-রেজিস্ট্রেশন-ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ই-রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ‘ভূমি নিবন্ধন ব্যবস্থাপনা ডিজিটাইজেশনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছিল।
আরও সংবাদ পড়ুন।
রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার – ঘুস দুর্নীতিতে সাবরেজিস্ট্রাররা বেপরোয়া
এই সমীক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিবন্ধন অধিদফতরের অধীন দেশের ১৭টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে পরীক্ষামূলক ভাবে অনলাইনে দলিল রেজিস্ট্রি ও রেকর্ড সংরক্ষণের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এগুলো হচ্ছে-ঢাকা জেলার উত্তরা, খিলগাঁও, গুলশান এবং সাভার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং পাহাড়তলী, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, টাঙ্গাইলের বাসাইল এবং নাগরপুর, রাজশাহীর চারঘাট, সিলেটের তাজপুর, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, ময়মনসিংহের নান্দাইল এবং বরিশালের হিজলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে দলিল রেজিস্ট্রির পরিবর্তে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি প্রচলনের উপযোগিতা, ভূমি নিবন্ধন ব্যবস্থা ডিজিটাইজেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যারের প্রকৃতি, ডিজিটাইজেশনের সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য হার্ডওয়্যারের প্রকৃতি ও পরিমাণ, হাতে লেখা এলটি নোটিসের বদলে ই-এলটি নোটিস জারির পরীক্ষামূলক সফটওয়্যার এবং হাতে লেখা বালাম বহির পরিবর্তে ডিজিটাল বালাম প্রচলনের সম্ভাব্যতা, ডিজিটাল সূচিকরণ বা ই-ইন্ডেক্সিং পরীক্ষামূলক চালু এবং বিদ্যমান ম্যানুয়াল দলিলগুলো ডিজিটাল করার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়।
এ বিষয়ে সদ্য সমাপ্ত সমীক্ষা প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক ও কেরানীগঞ্জের (দক্ষিণ) সাব-রেজিস্ট্রার মো. শাহজাহান আলী পিএএ জানান, সারা দেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন চালুর জন্য ৫ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প সম্প্রতি আইন এবং বিচার বিভাগ থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
২০২৩-এর জুলাই থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হলেও যেহেতু এখনও প্রকল্পটি অনুমোদন হয়নি, তাই জুলাই থেকে চালু করা সম্ভব হবে না। প্রকল্পটি পাস হলেই শুরু করা হবে এবং মেয়াদ হবে ৫ বছরের।
তিনি জানান, সমীক্ষা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও ১৭টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এখনও অনলাইনে দলিল রেজিস্ট্রি চালু রয়েছে।
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলাম বলেন, যদিও আমি জেলা রেজিস্ট্রার হিসাবে নতুন যোগদান করেছি। তারপরও সরকারের ই – রেজিষ্ট্রেশন শুরু হলে জনসাধারণই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।
নিবন্ধন অধিদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (নিবন্ধন) মো. আবদুস সালাম আজাদ বলেন, সমীক্ষা প্রকল্পের কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত হওয়ার পর প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সারা দেশে অনলাইন রেজিস্ট্র্র্র্রেশন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য নতুন ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে।
তিনি বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে অনলাইন নিবন্ধনের বিকল্প নেই। তাই মানুষের ভোগান্তি কমাতে এই প্রকল্পের বিষয়ে সবাই একমত।
ঢাকা জেলার খিলগাঁওয়ের সাব-রেজিস্ট্রার ও বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এস এম শফিউল বারী জানান, ম্যানুয়ালি দলিল সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে কোনো দাতা এনআইডি কার্ড দিলে এটা সঠিক কি না তা যাচাই করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ই-রেজিস্ট্রেশন হলে যেকোনো সাব-রেজিস্ট্রার সার্ভারের মাধ্যমে এনআইডি এবং আঙুলের ছাপ সঠিক কি না তা যাচাই করতে পারবেন। এতে ভুয়া দাতা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। খিলগাঁওয়ে সমীক্ষা প্রকল্পের অধীনে ই-রেজিস্ট্রেশন চালু থাকায় তিনি এটা যাচাই করার সুবিধা পাচ্ছেন। আরেকটি সুবিধা হচ্ছে দলিল প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহীতার ফোন নম্বরে এসএমএস চলে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সারা দেশে ই-রেজিস্ট্রেশন চালু হলে একজনের জমি প্রতারণার মাধ্যমে একাধিকবার বিক্রি বন্ধ হবে। ভূমি অফিসের সার্ভারের সঙ্গে সংযোগ থাকায় সরকারি জমির তালিকা সার্ভারে থাকবে। এর ফলে কোনো প্রতারক সরকারি জমি বিক্রি করে দেওয়ার সুযোগ পাবে না। অন্যদিকে ম্যানুয়ালি দলিল হলে বালাম ৩ বছর পর পেত। কিন্তু ই-রেজিস্ট্রেশন হওয়ায় খিলগাঁয়ে এখন দলিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি সার্ভারে চলে যাচ্ছে এবং রেকর্ড সংরক্ষণ হচ্ছে। সারা দেশে ই-রেজিস্ট্রেশন চালু হলে এই সুবিধা সবাই পাবে।
ই-রেজিস্ট্রেশন চালু হলে নকলনবিশদের কাজ কী হবে জানতে চাইলে শফিউল বারী বলেন, মূল দলিল স্ক্যান করে রাখা হবে। মূল দলিল বালামভুক্ত থাকবে। তাই নকলনবিশদের কাজ হারানোর কোনো আশঙ্কা নেই। বরং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর করা হবে। ই-রেজিস্ট্রেশন চালু হলে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও প্রয়োজনে সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিস করা যাবে।
প্রকল্প বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ২০২১ সালের ১০ জুন থেকে ২০২৩ সালের ১৩ জুন পর্যন্ত ১৭টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ৭৮ হাজার ১৯৫টি দলিল ই-রেজিস্ট্রশন সিস্টেমে নিবন্ধিত হয়েছে। এর ফলে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন ও জাল খতিয়ানের মাধ্যমে দলিল নিবন্ধন বন্ধ হয়েছে। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমেছে। স্বল্প সময়ে ও কম খরচে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত হয়েছে। তাই সেবা গ্রহণে মানুষের হয়রানি, সময়, খরচ এবং আদালতে জমিজমা সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা কমাতে সারা দেশে ই-রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই নির্ভুলতার সঙ্গে দলিলের দাতা এবং গ্রহীতা রেজিস্ট্রেশন কার্য সম্পন্ন করতে পারবে। এর ফলে সরকারি রাজস্ব আদায়ও গতিশীলতা পাবে। সারা দেশের রেকর্ড রুমে রক্ষিত বালাম বহিগুলো আর্কাইভে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
তিনি বলেন, সারা দেশে অনলাইন-ব্যবস্থায় রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চালু হলে জনগণ সহজেই নিবন্ধন কার্য সম্পাদনসহ নিবন্ধিত দলিলের অনুলিপি তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ করতে পারবে। ফলে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে শৃঙ্খলা আসবে এবং জাল-জালিয়াতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসকে স্ব স্ব প্রশাসনিক এখতিয়ারের মধ্যে রেখে এরই মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া নকলনবিশদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান আইন মন্ত্রী।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
কালামপুর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের নবনির্মিত ভবন শুভ উদ্বোধন