দিয়াশলাই – সাগর চৌধুরী
সাত সকালেই রিমনের মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে ওঠলো। রান্নাঘরে গিয়ে খুঁজে পেল না। বিছানার আশপাশেও খুঁজে পেল না। খাবার টেবিলের আশপাশে খুঁজেও সে বস্তুটাকে পাওয়া গেল না। এই শীতে পানি গরম না করা গেলে গোসল এবং খাওয়া কি করে সম্ভব?
তাছাড়া গতকাল রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। কারণ অফিস থেকে ফিরে আর খাওয়ার কথা মনে ছিল না, বিছানায় শুয়ে পড়েছে। এই সাত সকালে খিদায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
খাবারের সব ব্যবস্থাই আছে। ফ্রিজে মাছ, মাংস, সবজি সব কিছু আছে। রান্নাঘরে চালের বস্তায় চাল আছে। তেল আছে নুন আছে হলুদ মরিচ সবই আছে।
তারপরও পেটে খিদে নিয়ে সেই সকাল থেকে।
নেই কি ?
দিয়াশলাই।
চারদিকে জনমানব বলতে আধা মাইল খানেক দূড়ে একটা দোকান আছে। সেটা দুপুর বারোটার আগে খোলা হয় না। সে দেকানের মালিক ছোট একটা চাকরি করে । সে চাকুরি থেকে ফিরে তারপর দোকানে বসে। এছাড়া আগুন পেতে হলে এক কিলো দূরে বাজার আছে সেখানে গিয়ে দিয়াশলাই পাওয়া যায়। রিমোনের মেজাজটা খারাপ হলো তো একেবারে হলো। ভাবলো এত দূরে গিয়ে দিয়াশলাই আনবো, তার চেয়ে কাউকে ফোন দিলেই সে আসার সময় নিয়ে আসবে।
এদিকে তার পেটের অবস্থা খুবই খারাপ। খিদেয় হাত পা লেগে আসছে।
প্রথমেই ফোন করলো জাহেদকে। জাহেদও একই সাথে থাকে।
কোথায় রে তুই ?
বাহিরে।
অফিসে যাসনি ?
অফিস থেকে একটু বের হলাম। মিনিট দশেক পরে ডুকবো। কেন বলতো ?
আরে বাসায় আগুন জ্বালাবার মতো কোন দিয়াশলাই নেই। ফেরার সময় দিয়াশলাই নিয়ে আসিস।
ঠিক আছে। বলে জাহেদ ফোন রাখলো।
এবার শিমুল কে ফোন দিয়ে বললো- তুমি কি ক্লাসে ?
হ্যাঁ। জরুরি কিছু হলে বল। সমস্যা নেই।
বাসায় আগুন জ্বালাবার মত কোন দিয়াশলাই নেই। ফেরার সময় দিয়াশলাই নিয়ে ফিরিস তো।
শিমুল একজন স্কুল টিচার। ওরা তিনজন এক বাসায় থাকে। থাকে মানে বেচলার থাকে। রান্নাবান্না বুয়া করে। কাপড় চোপরে বুয়াই ধোয়। ঝাড় দেয়া, পানি ধরা, বাজার করা। এসবই বুয়া করে।
কিন্তু গত তিন দিন ধরে বুয়ার ভীষণ জ্বর। কাজে আসতে পারি নি।
বুয়া ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। গতকাল আবার শিমুল বুয়ার বাড়িতে গিয়ে এই মাসের বেতটা দিয়ে এসেছে। বেতন না দিলে কি ভাবে হবে। সে খাবে কি ? ওষুধপত্রও তাকে কিছু কিনে দিয়েছে তারা।
প্রতিদিন রান্নাবান্না বুয়া করতো বলে কারো কোন খেয়াল ছিল না। এই তিন দিনে খবর হয়ে গেছে। গতকাল রাতে জাহেদ ভাতের মার ফেলতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছে। পরশু গরম কড়াইয়ে মাছ ভাজতে গিয়ে শিমুলের শরীরে গরম তেল পড়েছে। রিমোন বলতে গেলে কিছু করার আগেই না খেয়ে বসে আছে।
অবশ্য একমাত্র রিমোনই বুয়াকে মাঝে মাঝে রাগ করতো। দেরি করে আসলে ধমক দিত। দায়িত্ব অবহেলার জন্য। রান্নায় লবণ বেশি বা কম হলে তার জন্য কথা শোনাত। তবে
এই দু’দিনের রান্নায় তেল নুন কি হয়েছে সেটা না বললেই ভালো।
সকালের পর থেকে সে বসেই আছে। কখন ওরা আসবে।
রান্নাঘরে মাছ রেডি করা আছে। চাল রান্নার জন্য রেডি করা আছে। কিন্তু কোথায় ওরা?
দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেলের পথে। মাঝ খানে দোকানে গিয়েছে দিয়াশলাই আনার জন্য কিন্তু দোকান আজ খোলে নি। কেন খোলে নি জানতে পারে নি সে।
বাসায় ফিরে সে আবার পুরনো কাগজপত্র, রান্নাঘড়, বিছানার আশপাশে যেখানে যেখানে দিয়াশলাই থাকতে পারে খুঁজলো কিন্তু কোথাও খুঁজে পেল না।
এবার খিদে কিছুটা কম মনে হলো। আসলে বেশি খিদে হলে সে সময় খাবার না খেলে খিদে আগের চেয়ে একটু কম
লাগে। অবশ্য তারও একটু পড়ে মনে হয় খিদেই লাগছে না।
উপর তালার ভারাটিয়া এসে একবার দরজায় টোকা দিয়ে জানতে চেয়েছিল ‘ময়লা ফেলার গাড়ি এসেছে কিনা?
ময়লা ফেলার গাড়ি আসছে। এ কথা বলতে গিয়ে দিয়াশলাইয়ের কথা বেমালুম ভুলেই গেছে রিমোন।
আরে তার কাছে চাইলেই তো পাওয়া যেত। দরজা খুলেই লোকটাকে ডাক দিল। কিন্তু লোকটা এত তারাতারি কেমন জানি হাওয়া হয়ে গেল।
দরজা খুলে তাকে আর পাওয়া গেল না। রাত হলে বেঝা যেত এটা ভূতের কাণ্ড কিন্তু দিনের বেলা ভূত ? এই কথা ভাবতেই রিমোনের হাসি পেল। হাসি পেলেও কথাটাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
দরজাটা লাগিয়ে ভেতরে এসে যখন ঢুকলো। দরজায় আবার একটা টোকা পড়লো।
রিমোন মনে মনে ভাবলো নিশ্চয় কেউ এবার আসছে। এবার লম্বা পা ফেলে সে দরজা খুলে দেখলো একটা বিড়াল। চোখগুলো বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিজের মনের ভয়টা নিজের উপহাসেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল সে। ঘরে সে একা।
খিদের বিষয়টা সে কেমন যেন ভুলেই গেছে। এখন আর খিদেটা তেমন লাগছে না।
ওদের কাছে ফোন করে লাভ নেই।
শিমুলের স্কুল ছুটি হবে সেই বিকেল বেলা। স্কুল শেষ করে সে আবার টিউশনিতে যাবে। সেখান থেকে ফিরে যাবে পলাশের বাসায়। গতকাল যাওয়ার কথা ছিল। বাসায় বুয়া নেই। রান্না করতে হবে তাই আজ যাবে বলেছে। কিন্তু আজও সে ওখানে যেতে পারে।
শিমুল না এলে রান্নাই বা কে করবে? তাছাড়া এই তিন জনের মধ্যে শিমুলই একটু ভালো রান্না করতে পারে।
জাহেদ রান্না তেমন পারে না। তবে ও কাটাকাটি করে দেয়। পেয়াজ, রসুন, আদা, কখনো সখানো তরকারি কুটে দেয়। চাল ধুয়ে দেয়। আসল রান্নাটা শিমুলই করে। রিমোনের
একটা ভালো গুন আছে, সেটা কি ?
রান্না হবার পর কোন তরকারীতে লবন বেশি হয়েছে কোন তরকারিতে লবণ কম আবার কোনটায় তেল হলুদ বেশি হয়েছে এই সমালোচনা ভালো করতে পারে।
পরশুর কথাটাই শুনলে হাসি আসে। রান্না শেষে শিমুল যখন খেতে বসেছে তখন রিমোন বললো- এই ডালটাতে লবন বেশি মনে হচ্ছে দোস্ত।
‘এই ব্যাটা এটা কি নামাজ নাকি সব ঠিকঠাক না হলে হবে না। না খেয়ে পেটে চড় নিয়ে ঘুমিয়ে থাকতি ।
রান্না করলাম; এখন খেতে বসে বিবিসির সংলাপ শুরু করেছো।’
জাহেদ রিমোনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিল, ‘চুপ যা’ ।
তিন জনে খাওয়া দাওয়া শেষ করে পানি খাবারের জন্য যেই রিমোন গ্লাস হাতে নিল। জাহেদ একটু কি যেন বলতে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। সেই সাথে রিমোনও শুরু
করলো হাসি। শিমুল প্রথমে বুঝতে পারে নি পরে হাসি দেখে বুঝতে পারলো ওকে নিয়েই হাসছে ওরা।
দুপুর গড়িয়ে বেলা শেষ। সারাটা দিন সে না খেয়েই কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার আগে আগে নিশ্চয় কেউ চলে আসবে। তাদের দুজনকেই বলা আছে।
জাহেদ তার অফিস শেষ করে অন্য কোথাও যায় না। সোজা বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু আজ যে মাসের তিন তারিখ
সেটা কি রিমোনের জানা আছে ?
তিন তারিখে সবার বেতন হয়। বেতন হওয়া মানে মাসের শেষে টাকা পেয়ে মোটামুটি সবাই পাখায় হাওয়া লাগায়। এই হাওয়া লাগতে লাগতে কখনো কখনো রাতের দশটা
বেজে যায়। যেদিন অফিসের কলিগদের সাথে রাতের পার্টি থাকে সেদিনের কথা তো ভিন্ন।
কি সব ভাবতে ভাবতে রিমোন ঘুমিয়ে পড়লো। জেগে যখন উঠলো তখন রাতের দশটা।
ঘুম ভেঙেছে বলতে জানালাটা খোলা ছিল বলে; ঠান্ডা হাওয়া আসতে ছিল, সেই ডাণ্ডায় ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাতের দশটা। ফোন করতে গিয়ে দেখলো।
ফোনে কোন টাকা নেই। কি করে ?
জাহেদ শিমুল দুজনের কেউ আসেনি। রান্নাবান্নাও হয় নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো ওরা বাসায় ফিরে খাবেটা কি ? সারাটা দিন খাটা খাটনি করে বাসায় ফিরে যদি খাবার না খেয়ে ঘুমাতে হয় তবে এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কিছু নেই।
রান্না ঘড়ে গিয়ে তার মাথাটা একটা চক্কর দিল। মাছ রাখা ছিল। সে মাছ গুলো বিড়াল খেয়ে ফেলেছে। মাছের কাটা গুলো রান্না ঘড়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
এগুলো পরিষ্কার না করলে পচা গন্ধে রাতে ঘুমানো কষ্ট হয়ে যাবে। এরই মধ্যে রান্নাঘরের পাশে বিড়াল বিড়াল ঝগড়া বেধেছে। সেই ঝগড়া কি যে ভয়ঙ্কর না দেখলে বোঝা যাবে না।
দরজায় টোকা পড়তেই দরজা খুলে দিল রিমোন। জাহেদ বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বললো- ভুল হয়ে গেছে রে বন্ধু।
আজ সব ভুলের বন্যা। অফিসে বেতন দিয়েছে। সেখানে লেট হয়ে গেছে। তারপর তুই যে দিয়াশলাই নিয়ে আসতে বলছিলি সেটাও বেমালুম ভুলে গেছি।’
তা তোর খবর কি ? রান্নাবান্না কিছু করলি খেতে পারবো ?
সারাটা দিন বাসায় ছিলাম। রান্না করার জন্য সব কিছু বাসায় ছিল কিন্তু আগুন জ্বালাবার জন্য কোন দিয়াশলাই ছিল না।
কাল রাত থেকে এখনো না খেয়ে আছি। ভেবেছি তুই
এলে রান্না করবো। কিন্তু তা আর হলো কই!
এরই মধ্যে দরজায় আবার টেকা পড়লো । শিমুল এল । বাসায় ফিরে সারাদিনের ক্লান্তির কথা শোনালো।
তারপর বললো—‘খুব খিদে পেয়েছে রে রিমোন কিছু রান্না করলি নাকি ?’
রাত তখন বারোটা। তিনটা মানুষ না খাওয়া। জাহেদের পকেটে পুরো মাসের বেতন।
শিমুলও আজ টিউশনির টাকা পেয়েছে। জড়োসড়ো হয়ে তিন জন জানালার পাশে বসে আছে। চাঁদের আলোতে এক জনের মুখের দিকে আরেক জন তাকিয়ে আছে।
সবাই ক্ষুদার্ত। সব কিছু ছিল, ছিল না শুধু একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি।
সাগর চৌধুরী
প্রকাশক ও সম্পাদক।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।