পাগলাকানাই ও মলুয়া – শাহানা সিরাজী
মানুষ বেঁচে থাকতে কেউ বড়লোক মানে টাকাওয়ালা, কেউ উঁচু পদের
কেউ ভিখারি, কেউ মাঝারি, মরার পরে কোনরারি?
কেউ বলে লাশ
কেউ বলে ডেডবডি!
মরার পরে কেউ যদি স্বজন থাকে দুফোঁটা অশ্রু ফেলে
কেউ যদি বন্ধু থাকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
কেউ যদি সদয় হয় বর্তমানে সোসাল মিডিয়া লিখে।
সিঙ্গেল পরিবারে কান্নার কে থাকে?
যেখানে ক্ষুদ্র স্বার্থে আপনজন বিভাজিত হয়ে পড়ে, যেখানে ইগো – অহংকার চাক বাঁধে সেখানে কার মৃত্যু সংবাদ কাকে নাড়ায়?
ভাই- ভাই, ভাই-বোন, বোন-বোন সম্পর্ক মেঘের মতো, হাওয়ার মতো, রোদের মতো,বৃষ্টির মতো
একের সুখ অন্যের সুখ
একের কষ্ট অন্যের কষ্ট
বিয়োগ ব্যথা এখানেই লাগার কথা বেশি।
কিন্তু যে ভাই ভায়ের সাথে দ্বন্দ্ব করে
যে বোন- ভাই একে অপরের সাথে ইগো-অহংকারে লিপ্ত থাকে
সেখানে আদৌ বিয়োগব্যথা আসার নয়।
জানাজায় যাবে কি-না,অন্দরমহল থেকে অনুমতি আসে কি না সে অপেক্ষায় যখন থাকতে হয় তখন মৃত ব্যক্তি সত্যিই ডেডবডি বা লাশ! এ লাশ থেকে দুর্গন্ধ বের হলেও ইগোর সাথে গুলিয়ে শরবত খাওয়া স্বজনেরা এগিয়ে আসে না। এ বড় ভয়ঙ্কর ব্যাপার!
মানুষের মূল্য যদি মানুষের মতো হতো, অন্তত আমাদের দেশে – তাহলে হাস্পাতালের মর্গ থাকতো পরিচ্ছন্ন, সুবাসিত, আতর-লোবান থাকতো! আহা মানুষ! মায়ার আধার, এ বুকে কত প্রেম ছিলো, মায়া ছিলো, জ্ঞান ছিলো, ভালোবাসা ছিলো, ঘৃণা-হিংসা-দ্বন্দ্ব- রাগ সবই ছিলো! ক্ষমতা ছিলো, সে মানুষ আজ নিঃস্ব, চোখে মুখে কোন কিছুরই এক্সপ্রেশন নেই!
সে মানুষকে কে কেঁদে বুক ভাসিয়ে মায়ার চাদরে আবৃত করবে?
কে করবে?
দুনিয়ায় যদি মায়ার কেউ রেখে যেতে না পারে মানুষ তবে এ কেমন মানব জীবন?
কত অভিমানে, কখনো ভালোবাসার কাঁটায় আহত হয়ে, কখনো সমাজের চোখের আগুনে পুড়ে, কখনো হতাশায় ডিপ্রেশনে মানুষ সুইসাইড করে। তারপর শুরু হয় নারকীয় অত্যাচার ওই নিথর মানুষটির সাথে।
কেউ কেউ আবার এমন রাক্ষুস হয়ে ওঠে যে কেটেকুটে খেয়ে ফেলে, কেউ ডোবায় ঢুবায়, কেউ বা পচা ভাগাড়ে ফেলে দেয়!
কী স্বার্থে মানুষ এসবে প্রবেশ করে?
বাসে-গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ মূলতঃ নিজেকেই অপমান করলো। এতে কী তৃপ্তি পায়?
যে মানুষকে সম্মানের সাথে বরের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে চিরবিদায় দেয়া উচিত সে মানুষকে কেন এতো অত্যাচার করা! একদিকে উকিল- অন্যদিকে আদালত, একদিকে পোস্টমর্টেম অন্যদিকে গলিত দেহ- কাকে কুকুরে টানাটানি!
তবে মানুষ কাকে বলে?
মানুষ হওয়ার জন্য আগেই শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে হবে এবং প্রয়োগ শিখতে হবে।
এই যে চাটাইবাঁধা অপরূপা এক নারীর দেহ পড়ে আছে, তাকে পুলিশ উদ্ধার করেছে পচা ডোবা থেকে। এখন লাশকাটা ঘর-ডাক্তার- আদালত- উকিল মিলে তার জীবনের কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত সকল ঘটনা উন্মোচনের মিথ্যে চেষ্টা করবে। কারণ ঘাতক তো পাওয়ারফুল, টাকাওয়ালা। কেউ তার কথার বাইরে যেতে পারবে না। তাহলে আরো মানুষ লাশ হয়ে যাবে।
এ নারী অপরূপা, বিউটিফুল একী তার দোষ?
কেন তাকে তুলে নিয়ে যেতে হবে? তুলে নিয়ে যদি গিয়েছেই কেন তাকে রক্ষা করার প্রয়োজন মনে করেনি?
যৌনতা আর ভালোবাসা, প্রেম দুটো কী এক?
দেহের তিড়িং বিড়িং এর স্থায়িত্ব কতক্ষণ? এর জন্য কী আস্ত এক নারীকে ধরে এনে ইরেকশান ঘটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আরে হাঁদারাম, তোর তো দুঘন্টা পরেই আবার তিড়িং বিড়িং শুরু হবে তখন কী করবি? তোর এই তিড়িংতিড়িং বেশিদিন স্থায়ী হবে না,জেনেও কেন নারীর প্রতি এতো অবজ্ঞা? যদি মেয়েটিকে ভালো লাগে তবে প্রপোজাল দেয়, সাথে রাখ, মারলি কেন? আইন তোকে ছাড়লেও প্রকৃতি তোকে ছাড়বে না। যে অপরূপাকে বুকের তলে পিষ্ট করেছিস তাকে কেন মেরে ডোবায় ফেললি? তার কোন মূল্য নেই?
পাগলাকানাই একাই চিৎকার করছে-
কোথাও কেউ নেই, সব ধানাই-পানাই,
কিসের নেতা কিসের খেতা!
কিসের ভোট কিসের ইলেকশান!
সব কিছুই কেবল মানুষ মারার ধান্ধা! আমি জানি মলুয়াকে কে মেরেছে?
দর্শকেরা পাগলাকানাইর কথায় মন না দিয়ে অপেক্ষা করছে, মলুয়া আসলে দুশ্চরিত্রা ছিল কি না তার প্রমাণ দেখার জন্য।
হায় মলুয়া! মরেও তোর রক্ষা নেই।
পাগলা কানাই হো হো হো হাসে। মলুয়া দুশ্চরিত্র নাকি ভলগা? আমি জানি-
রাস্তার টাকা লুট করেছে কে?
ব্যাংকের টাকা লুট করেছে কে?
শেয়ারবাজার লুট করেছে কে?
এক বালিশ সাত হাজার টাকা, কে কিনেছে কে?
পাগলাকানাইর গলা উঁচু থেকে উঁচুতে উঠছে, সেই সাথে তার রশি দিয়ে বেঁধে রাখা প্যান্ট কেবল নিচে নেমে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
তার পেছনে ছোট ছোট শিশুরা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো শ্লোগান দিচ্ছে
-মলুয়াকে খুন করেছে কে?
-পাগলাকানাই জানে
-মলুয়াকে ডোবায় রেখেছে কে?
-পাগলাকানাই জানে
-মলুয়ার এখন কী হবে?
-পুলিশ-ডাক্তার-উকিল মোক্তার জানে!
শ্লোগানের স্বর বাড়ছে,মিছিল বাড়ছে
-মিথ্যে সব মিথ্যে
-পাগলাকানাই বলে
– ঢামাঢোলে মরবে মানুষ
-পাগলাকানাই বলে
-যার হবে তার হবে, যার হবে না তার হবে না!
-পাগলাকানাই বলে
– রাস্তায় এতো ভিক্ষুক কেন?
-পাগলাকানাই জানে
শিশু-কিশোরেরা পাগলাকানাই এর পিছু পিছু ছুটছে।
পাগলাকানাই এসে থামলো আলীসান এক বাড়ির গেইটে। দারোয়ান রুখতে না পেরে গেইট খুলে দিলো। পাগলাকানাই হাঁটছে আর হুঁ হুঁ শব্দ করছে। মিছিলের শিশু-কিশোর কী এক উল্লাসে হুঁ হুঁ করছে। তারা মন্ত্রপুতের মতো কানাই এর সাথে সাথে নাচছে,গাইছে,ছুটছে।শোরগোল শুনে বেরিয়ে এলো ধনপতি,বলপতি, পাওয়ারপতি সূর্য।
মিছিলের শব্দ বদলে যাচ্ছে, কে বদলাচ্ছে সে খবর কেউ জানে না
-ধরেছি গো ধরেছি, উড়ালপঙ্ক্ষী ধরেছি।
-পাগলাকানাই বলেছে।
-উড়ালপক্ষী উড়ছে।
-যা যা যা উড়ে যা
-পাগলাকানাই বলে যা
বলপতি সিকিউরিটিকে ফোন দিলো, কী হচ্ছে এ সব? কিন্তু কী আশ্চর্য ফোন বাজেনি! ধনপতি কিছু বলার আগেই মিছিল তাকে পাকড়াও করলো। পাগলাকানাই খোঁচা দেয় আর হাসে মলুয়াকে ফেরত দাও। ধনপতি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো এবং নগদে হার্ট এটাক করে লাশ হয়ে গেলো। শিশুরা তার লাশের উপর প্রস্রাবের নদী বয়ে দিলো। তার লিভিং রুম একটা জলন্ত নরকডোবার চেয়েও খারাপ হয়ে পড়লো।
এ লাশের পোস্টমর্টেম হবে? এম্বুলেন্স আসছে।এখন কার বিরুদ্ধে নালিশ করবে?
পাগলাকানাই মিছিল নিয়ে অন্যপথে চলে গেলো।
মলুয়ার লাশ আর ধনপতির লাশ কী পার্থক্য হলো! দুটোই লাশ এখন মলুয়ার মতোই!ধনপতির লাশও যাবে লাশকাটা ঘরে।
তারপর?
পাগলাকানাই আবার উদিত হয়েছে। লাশের সম্ভ্রম কে হরণ করে? মলুয়াকে কারা লুট করেছে….
এতোক্ষণেও পুলিশ প্রশাসনের টনক নড়েনি।
সবাই ব্যস্ত। দেশময় হইহই রই রই। কোথাও হর্ষ কোথাও বিষাদ। পৌষের শীত মুকবিলা করবে নাকি, ইলেকশনের আয়োজন করবে? নাকি পাগলাকানাইলে সামলাবে!
ধানকাটা মাঠে হাঁটু পর্যন্ত নাড়া। নাড়া পেরিয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে দলে দলে সারে সারে পিঁপড়ার মতো মানুষ কোথায় যাচ্ছে?
পালাচ্ছে নাকি ভোট দিতে যাচ্ছে? আমি না বুঝলেও পাগলাকানাই ঠিকই বুঝেছে। সে কতক্ষণ এদল কতক্ষণ সেদল করতে করতে সদর রাস্তায় উঠে এলো। ট্রাক বোঝাই সেনাবাহিনী যাচ্ছে। আজ থেকে সেনা নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক পরিবেশে আমরা থাকবো! এতে আমাদের সুবিধা। আমচোর, জামচোর, লিচুচোর, ডাবচোর চুরি করতে পারবে না। যদিও পুকুরচুরি বন্ধ হবে না। কারণ পুকুরচুরি তো যেই সেই লোকে করে না! ধম্পতির একজনকে আজ পাগলাকানাই হাসতে লাশ বানিয়ে দিলো।
সেই লাশ এখনো পড়ে আছে। তার আপনজন কেউ নেই। এ আলীসান বাড়িতে একাই তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে থাকে। কাজের লোক কাজ করে। তারা কী আর কাঁদবে? সবাই পালিয়েছে। কে কার জান দেবে? আপন জন ছাড়া কার চোখ থেকে পানি পড়ে? মলুয়ার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। কারণ এতো রূপবতী মেয়ে নিশ্চয়ই একট ভালো লোকের সাথে জীবন কাটাতে পারতো!
পাগলাকানাই আবার চিৎকার দিয়ে উঠলো
যার আপন মানুষ নাই রে কাছে
তার লাশ যদি পড়ে থাকে
কে তারে দেয় যে গোসল
তার লাগি কান্দে কে
হুঁ হুঁ হুঁ
শিশু – কিশোরের দল তার সাথে আবার চিৎকার দিয়ে উঠলো- হুঁ হুঁ হুঁ।
শাহানা সিরাজী
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক।
আরও লেখা পড়ুন।
ঘুরে এলাম বস্টন হারবার দ্য নিউ ইংল্যান্ড একুরিয়াম – শাহানা সিরাজী
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।