ইউএনওদের আরচণের বিষয়টি সারাদেশে সমালোচিত

Picsart_22-07-14_09-04-19-814-3.jpg

ইউএনওদের আরচণের বিষয়টি সারাদেশে সমালোচিত

বিশেষ প্রতিবেদকঃ কক্সবাজারের টেকনাফে উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় এক সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু। এ ঘটনার একটি অডিও প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ঘটনার তিন দিন পর সোমবার ওই ইউএনওকে ওএসডি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকের সঙ্গে ইউএনওর ভাষা ব্যবহারকে ‘মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া সম্প্রতি নোটিস জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য বোয়ালমারীর ইউএনওকে হাইকোর্টে তলব করা হয়। সেবা নিতে গিয়ে কিংবা বিভিন্ন কারণে দায়িত্বে থাকা ইউএনও বা অন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তার অসৌজন্যমূলক আচরণ কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও হয়েছে। গত ২১ জুলাই রাত পৌনে ১০টার দিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার অফিসিয়াল নম্বর থেকে কল করেন কক্সবাজারের সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে। কথা বলার প্রথম থেকেই ইউএনও সাংবাদিককে গালাগাল করেন। এক পর্যায়ে তিনি ওই সাংবাদিককে ‘বেজন্মাও’ বলেন।

গত জুন মাসে নোটিস জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তার স্টাফদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগ তুলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে আদালতের দুই কর্মচারীকে সাজা দেওয়ার হুমকি দেন ইউএনও। একপর্যায়ে ইউএনও তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেন এবং মুচলেকা দিয়ে চলে যেতে বলেন। তারা রোজা আছেন জানালে ইউএনও তাদের বলেন, মুচলেকা ছাড়া তাদের ছাড়বেন না তিনি। একপর্যায়ে পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেন ইউএনও। এরপর জোর করে নির্দেশনামতে মুচলেকা লিখিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া।

গত ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করারও অভিযোগ ওঠে। ইউএনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানজনকভাবে নাম ধরে ডাকা, সরকারি ত্রাণের কম্বল দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশসহ বিভিন্ন অশালীন আচরণের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে লালমনিরহাটের আদিতমারীর ইউএনও মুনসুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্থানীয় দুজনকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে নালা তৈরিতে আপত্তি জানালে ইউএনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে ‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার’ কথা জানানোর পাশাপাশি জমিখাস করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন বলে জেলা প্রশাসকের কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগও জমা পড়ে। অন্যদিকে গত বছরের মে মাসে নারায়ণগঞ্জে সরকারি হটলাইন ৩৩৩-এ কল করে ত্রাণ চাওয়ার পর জরিমানার মুখে পড়েছিলেন একজন সাহায্যপ্রার্থী। দরিদ্র না হয়েও ত্রাণ চেয়েছেন এমন অভিযোগে ১০০ জন দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে হয় তাকে। এই নির্দেশ দিয়েছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা।

সাবেক জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালায় বলা আছে তাকে কর্মকর্তাসুলভ ভদ্র আচরণ করতে হবে। কোনো কর্মকর্তা আচরণবিধি ভঙ্গ করলে বা কারও সঙ্গে অসৌজন্যমুলক আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগী মামলা করা যাবে। তিনি সচিব থাকাকালে আচরণবিধি ভঙ্গ করার কারণে একাধিক বিভাগীয় মামলা করেছিলেন। তিনি বলেন, প্রশাসনে অনেক কর্মকর্তা, সবার কাছ থেকে একই ধরনের আচরণ আশাও করা যাবে না। তবে আচরণবিধি যাতে সবাই মেনে চলে এজন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও বাড়াতে হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে সরকারি আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা আছে। দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা আছে। তবে শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। অবশ্য নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায়। যেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে- অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। এই আচরণবিধি এবং চাকরিবিধির প্রশিক্ষণ নিয়েই কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়ে থাকেন।

কর্মকর্তারা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার অকর্মকর্তা সুলভ আচরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. ফরিদউদ্দিন আহমদ বলেন, সরকারি কর্মচারী বিধিমালায় বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত আছে। সেখানে অসদাচরণকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। কেউ অসদাচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার বা অন্য কোনো অপরাধ করলে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারিত হবে। কোনো অভিযোগ এলে তাকে নোটিস, তদন্ত, বিভাগীয় মামলা সব নিয়ম আছে। কেউ শাস্তি পেলে এর বিরুদ্ধে আপিলও করা যায়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইউএনওদের আরচণ নিয়ে বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে বলেছি, তারা যেসব জেলায় যাবেন, সেখানকার সব কর্মকর্তার সঙ্গে বসে তাদের আচার-ব্যবহার কেমন হবে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সেটা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচনা হবে। কর্মকর্তারা যাতে আচরণবিধিমালা মেনে দায়িত্ব পালন করেন সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। সেবা নিতে গেলে যদি অভ্যর্থনা জানানো না হয়, সেটাই অন্যায়। দুর্ব্যবহারও এক ধরনের দুর্নীতি। আইনের মধ্য থেকে সাধ্যমতো সেবা দিতে হবে। কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে, আপনার আচরণ সরকারের আচরণ।

আরও সংবাদ পড়ুন

টেকনাফের ইউএনও’র ভাষা মাস্তানের চেয়েও খারাপ: হাইকোর্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top