ভোলার মঙ্গলের কবির মৃত্যু দিবস আজ
ইয়াছিন মোহাম্মদঃ কবি সাব নামেই খ্যাত, কবি মোজাম্মেল হক ১৯৭৬ সালের ১ আগষ্ট ৯৬ বছর বয়সে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তখন তারই স্নেহধন্য বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও সেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কবি মোজাম্মেল হকের মরদেহ ঢাকা থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার যোগে ভোলায় এনে, পরাণ তালুকদার বাড়ীতে তার পারিবরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। মহান আল্লাহ কবিকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমিন।
কবি মোজাম্মেল হক তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেন।
১. ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে তিনি
খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। সেই সাথে একটি সোনার মেডেল এবং বিপুল পরিমান ভূ সম্পত্তি
পান।
২. ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্থান সরকারের পক্ষ থেকে
সিতারা ই খেদমত উপাধি লাভ করেন।
৩. ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তিনি
সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার
লাভ করেন।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন কেন তিনি ভিন্ন নামের তিনটি রাষ্ট্র এবং তার সরকার থেকে এরকম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেলেন।
১৯০৯ সালে কবি মোজাম্মেল হকের প্রথম কাব্য গ্রন্থ জাতীয় মংগল প্রকাশিত হবার পর সর্ব মহলে তা ব্যপক
সমাদৃত হয়। এক বইতেই তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। তিনি এ দেশের পশ্চাৎপদ মুসলিম জাতিকে শিক্ষার আলো দেয়ার জন্য ১৯১১ সালে পরান গঞ্জ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি আরো ১২টি হাই স্কুল, ৩টি মাদ্রাসা ও ২টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনিই ভোলার দ্বিতীয় গ্রাজুয়েট এবং এল এল বি ডিগ্রীধারী। যদিও বিচারকদের মাই লর্ড বলবেন না বলে তিনি জীবনে কোনদিন আইন পেশার সাথে সম্পৃক্ত হন নি। জনগনের জন্য কাজ করাতে গিয়ে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। এবং এই অঞ্চল থেকে এম এল এ নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্ষন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। এ সময় তিনি দলের হুইপ পদে অধিষ্টিত ছিলেন।
সমাজসংস্কারক, শিক্ষাব্রতী, ‘জাতীয় মঙ্গলের কবি’ মোজাম্মেল হকের জন্ম ভোলা জেলার বাপতা গ্রামে। ১৯০১ সালে কলকাতা মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আইএ পাস করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ১৯১৫ সালে তিনি গ্রাজুয়েশন অর্জন করেন। তিনি ভোলা জেলার তৃতীয় গ্রাজুয়েট। ১৯১৫ সালে ময়মনসিংহে বঙ্গীয় কৃষক প্রজা পার্টি গঠিত হয়। মোজাম্মেল হক ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদে জমিদারি অত্যাচার ও মহাজনী শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষাদীক্ষায় ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত মুসলমানদের উন্নতির জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ভোলা মহকুমা শহরের বার লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখতে পান, ৬৩ জন আইনজীবীর মধ্যে একজন মাত্র মুসলমান। বিষয়টি তার মনে গভীর রেখাপাত করে। সে সময়ই সমাজজীবনে একটি বিপ্লব সৃষ্টির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। তিনি একক প্রচেষ্টায় ভোলায় ১০টি হাইস্কুল ও তিনটি সিনিয়র মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯১১ সালে কলকাতা ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ এবং লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। মোজাম্মেল হক ছিলেন এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক। ১৯১৮ সালে সমিতির পক্ষ থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯১৫ সালে কবির প্রচেষ্টায় কলকাতা শহরে ‘মুসলমান ছাত্র সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মোজাম্মেল হক দীর্ঘ ২৭ বছর বরিশাল জেলা শিক্ষা বোর্ডের সদস্য, ১২ বছর কলকাতা হজ কমিটি ও কলকাতা টেক্স্ট বুক কমিটির সদস্য এবং তিন বছর বেঙ্গল প্রাইমারি এডুকেশন কমিটির সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া দুস্থ মানবতার খেদমতের জন্য খাদেমুল ইসলাম সমিতি গঠন করেন।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ছোলতান এবং মুন্সী রেয়াজউদ্দিন সম্পাদিত মাসিক ইসলাম প্রচারক ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় কবিতা লিখেছেন। ১৯০৯ সালে তার প্রথম কাব্য জাতীয় মঙ্গল প্রকাশিত হয়। মুসলমানদের কর্মে অনুপ্রাণিত করাই ছিল তার কবিতার লক্ষ্য। সমাজে জাগরণ আনয়নের জন্য কবিতার ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত হয়েছে জাগরণী গান।
কলকাতার পত্রপত্রিকা এবং বিশিষ্ট মুসলিম ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় মঙ্গল কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সমাজ মঙ্গল (৫০টি কবিতার সঙ্কলন), উত্থাপন সঙ্গীত, কুরআনের বঙ্গানুবাদ (১০ পারা) প্রভৃতি। ১৯৭৬ সালের ১ আগস্ট কবি মোজাম্মেল হকের জীবনাবসান ঘটে। আজ তার মৃত্যু বার্ষিকী।