মানুষ এতো বেপরোয়া কেন হয়েছে – শাহানা সিরাজী

PicsArt_11-12-09.27.40.jpg

মানুষ এতো বেপরোয়া কেন হয়েছে – শাহানা সিরাজী

আধুনিক সমাজে নিরক্ষরতার হার কমে এসেছে সেই সাথে দেখি ধর্মীয় চিন্তাধারাও প্রসারিত হচ্ছে। তথাপিও মানুষ কেন এতো বেপরোয়া?

তাহলে কী বলবো মানুষের মনের সেই অংশ বিলুপ্ত হয়েছে যে অংশ দিয়ে ভালো এবং মন্দের পার্থক্য করতে পারে? যে অংশ ব্যথিত হয়? যে অংশ কাঁদে? যে অংশ দিয়ে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন তৈরি হয়? যে অংশ দিয়ে মানুষ মানুষকে মায়া দেয়, ছায়া দেয়, ভালোবাসা দেয়?

কুসুমিত, পল্লবিত মনোহর এ অংশের মৃত্যুর কারণ কী?

সমাজ ব্যবস্থার কোন গভীরে পচন ধরেছে, কেন ধরেছে? এ সব প্রশ্ন করার কিংবা উত্তর খোঁজার বোধ করি সময় হয়েছে।

আব্বা ছোটবেলায় প্রথম সে শিক্ষা দিয়েছেন সেটি হলো সালাম দেবে। সবাইকে। বড়ো ছোটো। বড়োদের সামনে মাথা নত রাখবে। আশির দশকেও পাড়ার মুরুব্বীরা কিছু বললে যুবকেরা মান্যগণ্য করতো। চাচা জেঠা বলে কথা বলতো। বড়োদের সামনে বিড়ি সিগারেট খাওয়া মারাত্মক অন্যায় বলে গণ্য হতো। দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা ছিলো জগন্য অন্যায়। ধীরে ধীরে বড়ো-ছোটো তফাৎ কমতে শুরু করলো। ছাত্রনেতাদের হাতে পিস্তল এলো। ছাত্ররা পড়ার টেবিল রেখে লেগে গেলো বাণিজ্যে। রাজনৈতিক অপশক্তিই এর পেছনে একমাত্র দায়ী।
যে কোন দলের কর্মী,সাপোর্টার, নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা অন্যায় করলে দল নিজের স্বার্থে তা অন্যায় বলেনি। এখন নিজেদের খড়্গ নিজেদের গলায়। এখন কেউ ভালো কিছু করার চেষ্টা করলেও খারাপের জন্য তা হয়ে ওঠে না। বিশাল নেতারা অধিকাংশ অফসাইডে।কিন্তু আমাদের সন্তানেরা বেয়াদবী আর অন্যায়ের সাথে থাকতে থাকতে পিটিয়ে,পায়ু পথে হাওয়া দিয়ে,যৌনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে, ফাঁস দিয়ে,কামড়ে চিমড়ে মানুষকে অনায়াসে খুন করে ফেলে রেখে হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসে।
আমাদের সন্তানেরা এখন মা বাবার সাথে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলতে, মারতে,ভাই-বোনকে মারতে, সম্পর্ক নষ্ট করতে,আত্মীয় প্রতিবেশিকে মারতে, তাদের ঘরবাড়ি পুড়তে দখল করতে তাদের বিবেকে বাঁধে না।

আমাদের সন্তানেরা বাবা-মায়ের ঘুষের টাকায় বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টে খায় ডেটিং করে। তারা ভাবে না টাকা আয়ের সোর্স কোথায়?

আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন রিসার্স নেই। থাকলেও ৯০% নকল। অন্যের জার্নাল থেকে মেরে দেয়া, আমাদের ডাক্তারেরা অধিকাংশ যন্ত্র, মানবতা নেই,ইঞ্জিনিয়ার অধিকাংশ চোর। এমনও নিজের চোখে দেখেছি ব্রীফকেস ভরা টাকা। ক্যারি করতে পারছে না।

গ্রামে গঞ্জে হাডুডু, ফুটবল, জারি গান যাত্রা,নাটক এ সব নিয়ে ছাত্ররা ব্যস্ত থাকতো। এখন যাত্রা পালা, নাটক এসব বন্ধ। গান হলো একটি শক্তিশালী মাধ্যম। যার মাধ্যমে মানুষের মনকে নরম রাখা যায়। কবিতা উৎকৃষ্ট মাধ্যম, যা দিয়ে প্রতিবাদ করা যায় নিজেকে প্রকাশ করা যায়।

গ্রামে গঞ্জে এখন কোন সাহিত্য সংস্কৃতি ভিত্তিক সংগঠন নেই। আমি মারাত্মক রক্ষণশীল পরিবার থেকে বেরিয়ে এসেছি কারণ ছোটবেলায় আমাদের সিরাজপুর কৃষি সমবায় সমিতি শিশু কিশোরদের নিয়ে একটি সংগঠন চালাতো।কিশোর সমবায় সমিতি নামে। প্রতি শুক্রবার সেখানে কালচারাল অনুষ্ঠান হতো। খুব বেশীদিন চালাতে না পারলেও সেটাই ছিলো আমার হাতে খড়ি। আমার পরবর্তী ভাইবোন সে সব দেখেনি।
মনোজগতে তাদের সাথে আমার একটি পার্থক্য একই পরিবার হওয়া সত্ত্বেও রয়েই গিয়েছে।

প্রতিদিন খুন খারাবীর খবর সমাজের মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় স্নাতকোত্তর কবিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আবরারকে বুয়েটে,নুসরাতকে মাদ্রাসায়, তনুর কথাও ভুলিনি,সিলেটে সেই কিশোরকে পায়ু পথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করেছে… এ সব কোন সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। এ হত্যাগুলোর সাথে জড়িতদের তড়িঘড়ি শাস্তি নিশ্চিত করলেও মূলবীজ সমাজ ব্যবস্থায় রয়েই যাবে। যুব সমাজ হারমাইদ হয়ে গিয়েছে। এরা দুটাকার জন্য লুট,খুন সব করতে পারে। এদের অন্তর পচা ডিমের চেয়েও খারাপ হয়ে গিয়েছে। যে যুব সমাজ স্বাধীনতা এনেছে,ভাষা এনেছে সে যুব সমাজ নেই। এখন তারা খুনি। যুব সমাজের চেহারার দিকে তাকালে বাবা বলে ডাকতে মন চায় না। তাদের চোখ লালা,কপাল কুচকানো,চোয়াল শক্ত,হাতে চেইন,কানে দুল,চুলের স্টাইল যেন রাক্ষুস। এক নজরে ওদের দেখলে ভয়ে আত্মা কাঁপে। যুব সমাজকে এক জায়গায় গেদারিং করতে দেখলে পা গুটিয়ে আসে। তারা এগিয়ে এলেও আমি সেঁধিয়ে যাই। ছেড়ে দেয় মা কেঁদে বাঁচি। পালাই পালাই। নৈতিকতা কাকে বলে, এ শব্দটি কী অধিকাংশ হয়তো জানেই না।

পিতামাতারা এ জন্য দায়ী। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছারিতাকে প্রশ্রয় দেয়া,যখন যা চায় তখনই তা হাজির করা প্রজন্মকে খামখেয়ালির ভেতর ঠেলে দিয়েছে। অনেকেই আমাকে বলে আমি সফল মা। কতোটা সফল ছেলেরা যখন আরো এগিয়ে যাবে তখন বুঝতে পারবো।কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পাসের পরও আমার ছেলেদের আমি শাসন করেছি। পারলে এখনো করি। ট্র‍্যাকের বাইরে এখন তারা নিজেরাই যাবে না। পরিপূর্ণ বয়সের পর তাদের জীবনের জন্য সিদ্ধান্ত তারা নিলেও আমি ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নয়। ঠিকই লেগে থাকবো,এখনো লেগে থাকি,আমাকে ফোন করতে দেরী হলেই চিল্লাপাল্লা শুরু করি।

প্যারেন্টিং শেখা লাগে। আমার ট্রেনিং ছিলো।সব মায়ের ট্রেনিং নেই। এ কাজটি এখন সময়ের দাবী। যেহেতু নিত্য নতুন বিষয়াদি সামনে এসে যাচ্ছে সেহেতু মা বাবাদের আগেই ট্রেনিং নেয়া দরকার।

যুব সমাজ এখন মথায় টুপি,গলায় পৈতা, কপালে তিলক দিতেও কম দেয় না কিন্তু সে সবের মর্যাদা কী জিনিস তা তারা জানে বলে মনে হয় না। সাধু হতে বলি না। স্বাভাবিক থাকতে বলি। দয়ামায়া নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলি।

এখন রাত ভর জেগে জেগে চ্যাট, ন্যুড ভিডিও আপলোড এবং দেখা ছাড়া মনে হয় না তারা চার প্রকার সাঁতার দিতেও জানে।

এ সমাজ ব্যবস্থা পালটানো খুব জরুরী। স্কুল কলেজ থেকে রাজনীতি বাদ দিয়ে সেন্ট পার্সেন্ট লেখা পড়া,খেলা ধুলা এবং সোসাল কানেকশানের সাথে ইনভলভ করতে হবে। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সোসাল কানেকশান নামক বিষয় রাখতে হবে। কে কতো মানুষ শুধু দেশ নয় দেশের গণ্ডির বাইরেও কতো জনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। সে সম্পর্কগুলো কেমন, কতো রোগীর সেবা করেছে,কতো দুঃস্থকে সাহায্য করেছে। এলাকায় মান্যগণ্য সিনিয়র যারা তাদের সাথে সম্পর্ক কেমন,ছোটদের সাথে সম্পর্ক কেমন, কী কী সংগঠন তারা চালাচ্ছে, খেলাধূল খেলাধূলায় সক্রিয় কি না, আর্ট কালচারের সাথে সম্পৃক্ততা কেমন এসব যাছাই করে শুধু মাত্র পাস বলেই পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দিতে হবে। কারণ গ্রেড সিস্টেম বলি আর ডিভিশঅন সিস্টেম বলি
অদৃশ্য এক কম্পিটিশনের কারণে শিশুকালেই তাদের ভেতর ভয় আতঙ্ক এবং ঘৃণা জন্ম নেয়। পরবর্তীকালে ক্রোধে রূপান্তরিত হয় ফলশ্রুতিতে সাইকোলজিক্যালি এরা সমাজের গায়ে ক্ষত হয়ে দেখা দেয়।

প্রত্যেক হাসপাতালে,কমিউনিটিক্লিনিকে,প্রত্যেক মহল্লায় সাইক্রিয়াটিস্ট ও সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। মানুষ অসুস্থ প্রতিযোগীতায় ডিপ্রেশনে ভূগে আর নানা রকম অসংগতি মূলক কাজ কারবার করে। যত শিক্ষার্থী প্রতি বছর বের হচ্ছে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক কর্ম সংস্থান করতে হবে।

ভাসমান শিশুদের জন্য সরকারি উদ্যোগ , বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। এতিমখানাগুলোকে কর্মমুখী করতে হবে। আর কতোকাল তারা ভিক্ষুক বানাবে!

ঘুষখোর এক প্রকার ভিক্ষুক। এ ভিক্ষুকেরাই দেশের মূল ক্ষতি করছে। যেহেতু দেশ ডিজিটালাইজড হচ্ছে সেহেতু সিস্টেম আরো স্মার্টলি ডেভেলপ করতে হবে যাতে জনদুর্ভোগ না বাড়ে। এ জি অফিসগুলোকে আগে ঠিক করতে হবে।কারণ এ অফিসেই ভিক্ষুক সংখ্যা এতো বেশী এবং এতো নিম্ন মানের তা প্রকাশের বাইরে।

এনালগ যারা চাকুরি বিশ বছর হলে তাদের ফুল পেনশন দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে,ইয়াং এনার্জেটিক,আইসিটি এক্সপার্ট যুবকদের নিয়োগ নিতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগকে আরো সহজ করে যুব সমাজকে প্রোভাইড করতে হবে। ভূমির যেমন সীমা আছে ব্যক্তিমালিকানায় তেমনি নগদ অর্থেরও সীমা থাকতে হবে। টাকা অলস ফেলে রাখা যাবে না।ইনভেস্ট মেন্ডেটরি করতেই হবে।

যে অপরাধগুলো ইদানিং বেশী হচ্ছে সেগুলোর পরিসংখ্যান বের করে আর্মি, পুলিশ, র‍্যাব সব বাহিনী কাজে লাগিয়ে সান্ধ্য আইনজারি করে মানুষকে আলিফের মতো সোজা রাখতে হবে। তারপর বাধ্যতামূলক খেলাধূলায় সক্রিয় রাখতে হবে। সংস্কৃতির সাথে ইনভলভ রাখতে হবে।

এতো হবের ভেতর কিছুই হবে না তবুও আশা জাগে মনে একদিন ঘুরে দাঁড়াবই। খাতা কলমে নয় বাস্তবে।
সে প্রত্যাশায়

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর, পিটিআই
মুন্সীগঞ্জ
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top