পুলিশে চুক্তি থেকে মুক্তি মিলে না

Picsart_24-02-21_14-48-37-349.jpg

পুলিশে চুক্তি থেকে মুক্তি মিলে না

বিশেষ প্রতিবেদকঃ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, বরখাস্ত হওয়া ও বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা চাকরিতে ফিরছেন। চাকরিচ্যুত ও অবসরে পাঠানো আটজনকে এবং বরখাস্ত হওয়া অন্তত ১০ জনকে ইতিমধ্যে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে।

পুলিশের এসব কর্মকর্তার মধ্যে অনেকে চাকরি ফিরে পেতে আওয়ামী লীগ আমলেই প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলেন। কেউ ট্রাইব্যুনালের রায়ে, আবার কেউ মামলা প্রত্যাহার করার শর্তে পুনর্বহাল হয়েছেন। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ৫১ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

বিগত সরকারের আমলে ২৮ পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয় এবং ২৮ জনকে বরখাস্ত ও ওএসডি করে রাখা হয়।

চাকরিচ্যুতদের একজন হলেন পুলিশ ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজি) এ কে মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর ছিলেন। তাঁকে দিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতি শুরু করে। চাকরিচ্যুত হওয়া ২৮ এবং ওএসডি করে রাখা ২৮ জন সরকার পরিবর্তনের পর তাঁদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে সাময়িক বরখাস্ত, স্থায়ী বরখাস্ত করা হয় অনেককে। তাঁরাও চাকরিতে নিয়মিত হতে চান। তাঁদের দাবির তুলনায় চাকরিতে পুনর্বহালের সংখ্যা খুব কম।

জানা গেছে, যাঁদের চাকরির বয়স নেই, তাঁরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। চাকরিচ্যুত কয়েকজনকে অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে চাকরিতে পুনর্বহাল করেছে। কয়েকজনকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, যাঁরা সত্যিকারের বঞ্চিত তাঁদের মধ্য থেকে যোগ্য কর্মকর্তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, যাঁদের দিয়ে পুলিশ প্রশাসন ও জনগণ লাভবান হবে। তবে অতীতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্যক্তিগত পছন্দের লোককে ফিরিয়ে আনা হয়।

ঘুষগ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক কারণে সাময়িক বরখাস্ত, ওএসডি ও চাকরিচ্যুতির নজির আছে। আগের সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাকে পরবর্তী সরকারের আমলে পুনর্বহালের ঘটনাও ঘটে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অসাধু কর্মকর্তার চাকরি ফিরে পাওয়ার অভিযোগও ওঠে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত ২৭ আগস্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পতিত সরকারের আমলে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পাঁচ কর্মকর্তাকে সেদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পৃথক প্রজ্ঞাপনে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। তাঁদের মধ্যে মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ছিলেন রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমির উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), রংপুরের পুলিশ সুপার মো. আলী হোসেন ফকির, সিআইডির পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন মিয়া, ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান এবং সিআইডির পুলিশ সুপার নাজমুল করিম খান।

এ ছাড়া গত ১০ সেপ্টেম্বর সাবেক পুলিশ সুপার আলী আকবর খানকে, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১-এর রায় অনুযায়ী ১৭ নভেম্বর শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে, ২২ নভেম্বর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মো. মাহবুব আলমকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সাজ্জাত আলী পুনর্বহালের তিন দিনের মাথায় ডিএমপির কমিশনার নিয়োগ হন। সর্বশেষ গত সোমবার পুলিশ সুপার মো. মুনির হোসেনকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।

সূত্র বলেছে, বিভিন্ন সময়ে শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অপেশাদার আচরণের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক নৌ পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আরেফ, রংপুরের পুলিশ সুপার মিলু মিয়া, শিল্প পুলিশ-২-এর সাবেক পুলিশ সুপার সিদ্দিকুর রহমান ও ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলের পুলিশ সুপার শামীমা ইয়াসমিন। ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলশান-১ নম্বর গোলচত্বরে এক কনস্টেবলকে মারধরের অভিযোগে মো. আব্দুল্লাহ আরেফকে সাময়িক বরখাস্ত ও তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছেন। মিলু মিয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছিল ৭ বছরের এক শিশুকে আসামির মতো গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করায়। তাঁকেও বিভাগীয় মামলা থেকে ৬ নভেম্বর অব্যাহতি দেওয়া হয়। সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই বিভাগীয় মামলা করা হয়। সেই মামলা থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি দায়মুক্তি পান। দীর্ঘদিন গরহাজিরের কারণে বিভাগীয় মামলা হওয়া ও গুরুদণ্ড পাওয়া শামীমা ইয়াসমিনকে ২৯ আগস্ট অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

পুলিশ বাহিনীতে চাকরিতে পুনর্বহালের পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের আমলে পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পদ ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের প্রধানদের বছরের পর বছর চুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে রাখা হয়েছিল। এতে পদোন্নতি ও পদায়নে জটলার সৃষ্টি হতো। অনেকে বঞ্চিত হতেন।

বর্তমানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বাহারুল আলম এবং ডিএমপির কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলীকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। র‍্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমানের এক বছরের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে, তাই বলে ধারাবাহিকভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সমর্থনযোগ্য নয়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলেও তা ৬ মাস বা ১ বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। এতে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি কার্যক্রম ব্যর্থ মনে হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top