আবুল হাসেম সরকারি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে কোটিপতি
অপরাধ প্রতিবেদকঃ হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন মো. আবুল হাসেম (৫০)। কিন্তু জেলা প্রশাসক (ডিসি) কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ট্রেসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েই ভাগ্য বদলে যেতে শুরু করে তাঁর। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে হয়ে যান কোটিপতি। সম্প্রতি শুরু করেছেন ফ্ল্যাট-প্লটের ব্যবসাও।
বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়ে হাসেমের নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ মিলেছে। সেই সঙ্গে হঠাৎ করেই বেড়েছে শ্বশুরবাড়ির সম্পদও। অভিযোগ উঠেছে, কৌশলে সরকারি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণযোগ্য জমি নিজ কবজায়, জমির মাপকরণে অনিয়মসহ ভূমিসংক্রান্ত নানা অনিয়ম করে টাকা হাতিয়েছেন তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারী।
ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা হাসেম ডিসি কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার অধীনে আলফাডাঙ্গা উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে সংযুক্ত।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সালের ১৪ আগস্ট তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে রাজস্ব শাখায় ট্রেসার পদে যোগদান করেন হাসেম। তখন তাঁর বেতন স্কেল ছিল ১৭তম গ্রেডে এবং বর্তমানে তা ১৩তম গ্রেডে উন্নীত হয়েছে। ট্রেসার হিসেবে দীর্ঘদিন ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়ও অতিরিক্ত দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন।
ওই শাখায় কর্মরত থাকাকালীন ফরিদপুর-ভাঙ্গা মহাসড়কের চার লেন সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের সময় অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের ২ নভেম্বর সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ দেন তৎকালীন ডিসি কামরুল আহসান তালুকদার।
বর্তমানেও ওই আদেশ জারি রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাইপাস সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য অধিগ্রহণের খবরে জেলা সদরের গোয়ালচামটের খোদাবক্স এলাকার খোন্দকার মঞ্জুর আলী গংয়ের জমি হাসেম ৭টি দলিলের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনের নামে ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে তা অধিগ্রহণ হয়।
এমন অনিয়মসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ করেছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর শহরের কমলাপুরের তেঁতুলতলা মোড় এলাকায় নির্মাণাধীন দুটি বহুতল ভবনে দুটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। যৌথভাবে ওই দুটি ফ্ল্যাট নির্মাণ করছেন ৩০ জনের অধিক ব্যক্তি; যার মধ্যে ড্রিম প্যালেস নামের নির্মাণাধীন ১২ তলা ভবনের পঞ্চম তলায় ১০৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং অপরটি কয়েক গজ দূরেই ছায়াবানী নামের নির্মাণাধীন ভবনেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
ওই ফ্ল্যাট দুটির মধ্যে ফাঁকা জায়গায় দুটি দাগের ৩৫ শতাংশ ও ১৪ শতাংশ জমিতেও শেয়ার রয়েছে তাঁর। ওই এলাকার প্রতি শতাংশ জায়গার মূল্য ৩০ লাখ টাকার বেশি।
এ ছাড়া আলফাডাঙ্গা উপজেলা সদরেও জায়গা কিনে ফ্ল্যাট করে ভাড়া দিয়েছেন। ফরিদপুর নিউমার্কেটে তিনটি দোকান রয়েছে। নিজ গ্রামে ও শ্বশুরবাড়ি বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর গ্রামে কিনেছেন প্রায় দেড় কোটি টাকার জমি। একমাত্র ছেলে ভারতের দিল্লির একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন।
হাসেমের বড় ভাই হাচেন শিকদারের ভাষ্যমতে, বোয়ালিয়া গ্রামে ও আশপাশে প্রায় ৪০ লাখ টাকার জমি বন্ধক রেখেছেন হাসেন। যদিও একটি সূত্র জানিয়েছে, নিজ গ্রামে অর্ধকোটি টাকার জমি কিনেছেন।
হাচেন বলেন, ‘আমাদের বাবার কালের (পৈতৃক) সম্পদ বলতে বাড়ির জায়গাটুকুই ছিল। ছোট ভাই চাকরি করে টাকাপয়সার মালিক হয়েছে। শুনেছি, শহরের তেঁতুলতলায় বাড়ি করেছেন, আমি কখনো যাইনি। আলফাডাঙ্গায়ও বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোয়ালিয়া গ্রামসংলগ্ন নকুলহাটি বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘হাসেম আমার ক্লাসের বন্ধু ছিল। ছোটবেলা থেকেই ওরে চিনি। ডিসি অফিসে চাকরি করে অনেক টাকাপয়সার মালিক হয়েছে। এলাকায় এলে গাড়ি নিয়ে আসে। তবে এর পাশাপাশি কী করে, জানি না।’
শ্বশুরবাড়িতে প্রায় কোটি টাকার জমি ক্রয় করেছেন, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে যাওয়া হয় তাঁর শ্বশুরবাড়ি বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর এলাকায়। এ সময় কথা হয় তাঁর শ্বশুর আনো মাতুব্বরের সঙ্গে।
তিনি দাবি করেন, তাঁর জামাতা এলাকায় কোনো জমি কেনেননি। তবে আলাপকালে জানান, বিগত ৮-৯ বছরে তিনি নিজেই প্রায় ৮ বিঘা জমি কিনেছেন; যার আনুমানিক মূল্য কোটি টাকা। তবে জমি কেনার টাকার উৎস জানাতে পারেননি তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে হাসেমের মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলে কথা বলতে রাজি হননি। একাধিক মাধ্যমে তিনি সংবাদ না প্রকাশের অনুরোধ করেন।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. হাসানুজ্জামান হাসান বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা যারা সেবা খাতে যুক্ত, তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে আর করার কিছু থাকে না। আমি বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বিশেষভাবে শাস্তির দাবি জানাই। আমাদের কেউ অভিযোগ দিলে দুদককে জানানো হবে।’
হাসেমের সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান মোল্যা।
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেওয়া হবে না। এ রকম হয়ে থাকলে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে, তারা খতিয়ে দেখবে।’