সাবেক সংসদ শাওন হেলিকপ্টারে মাদক পৌঁছাতেন! এলজিডি – পাউবো থেকে নিতেন ১০ শতাংশ
অপরাধ প্রতিবেদকঃ দ্বীপজেলা ভোলা -৩ (১১৭) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের সিন্ডিকেটের সদস্যরা মিয়ানমার থেকে মাদক এনে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতেন।
অভিযোগ রয়েছে, শাওন ভোলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজের বিপরীতে ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন। শুধু ঠিকাদারির কমিশন নিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি।
এমপি শাওনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, সরকারি জায়গা প্লট আকারে বিক্রি ও নদী থেকে বালু উত্তোলনসহ ১৮ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার। এক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান দুদকে এ অভিযোগ জমা দেন।
বলা হয়, ২০১০ সালে উপনির্বাচনে এমপি হওয়ার আগে বছরে তার আয় ছিল ১০ লাখ টাকা। এমপি হওয়ার পর ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তার আয় হয়েছে ১৫ কোটির টাকার বেশি।
দুদকের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে শাওনের বিরুদ্ধে দাখিল করা অভিযোগটির অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তি) সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি টিম করা হয়। টিমের সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম, নেয়ামুল আহসান গাজী, আতাউর রহমান সরকার ও মনিরুল ইসলাম। কিন্তু দুদকের ডিজিকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়ায় ইকবাল হোসেন অনুসন্ধানে আগ্রহী হননি। ফলে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ বছর ৩০ এপ্রিল অবসরে যান সৈয়দ ইকবাল। ফলে অনুসন্ধান বন্ধ থাকে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ২২ আগস্ট শাওনের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
দুদকের দাখিলকৃত অভিযোগে বলা হয়, সাবেক এমপি শাওন ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলার টিআরের ২ কোটি ২৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭৯৭, কাবিখা ও কাবিটার ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৬ টাকা, ২৬০ দশমিক ৩৯ টন গম ও ২৩৪ দশমিক ৩৩ টন চাল বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, শাওন এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনে যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন, তাতে বাৎসরিক আয় দেখান ১০ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন। ওই সময় যে হলফনামা দাখিল করেন তাতে বাৎসরিক আয় দেখান ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামায় আয় দেখান ১৫ কোটি ৭২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৬ টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামায় বাৎসরিক আয় দেখান ১ কোটি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর তার আয় কমে যায়।
এমপি হওয়ার পর তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। তিনি ঢাকার গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, মতিঝিল ক্লাব ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ক্যাসিনো ব্যবসার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে তিনি গা ঢাকা দেন। এখন তিনি প্রকাশ্যে আছেন এবং ভোলার লালমোহন-তজুমদ্দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। পাউবোর বাৎসরিক আপদকালীন ফান্ডের ৫ কোটি টাকা তুলে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন তিনি। তার সিন্ডিকেটের সদস্য হচ্ছেন লালমোহনের মহিউদ্দিন, তজুমদ্দিনের আবু তাহের ও সুমন পাটোয়ারী, চাচড়ার রিয়াজ উদ্দিন ও সোনাপুরের ইকরাম পাটোয়ারী।
ভোলা এখন মাদকের স্বর্গরাজ্য। শাওনের সিন্ডিকেটের সদস্যরা ট্রলারযোগে মিয়ানমার থেকে মাদক এনে লালমোহনের বাতির খালে পৌঁছানোর পর সেখানে স্টক করা হয়। পরে মাদকের চালান হেলিকপ্টারযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। মাদক বিক্রি করে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করেন শাওন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
অভিযোগে বলা হয়, শাওন ঢাকা থেকে পাউবোর কাজ কয়েকজন ঠিকাদারের মধ্যে ভাগ করে দেন। বাইরের কাউকে কাজ দেওয়া হয় না। তিনি পাউবোর কাজ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নেন। এলজিইডির কাজগুলো পছন্দের ঠিকাদারদের দেন। তার পছন্দের বাইরের কোনো ঠিকাদার কাজ পেলে তাদের ৫ থেকে ১০ শতাংশ টাকা উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে জমা দিয়ে কাজ শুরু করতে হয়।
শাওন লালমোহন উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন সরকারি পুকুর ভরাট করে তা চান্দিনা ভিটা হিসেবে লোকজনের কাছে পজিশন বিক্রি করে ২০০-৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এলাকার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় জনবল নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। স্থানীয় সরকার মনোনয়নবাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, তিনি মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যারা নদীভাঙনের শিকার তারা ক্ষতিপূরণের পুরো টাকা পান না, বেশিরভাগ টাকা এমপি শাওনের পকেটে যায়। এ ছাড়া উপজেলার টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও জিআর কাজে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার থেকে কমিশন দিতে হয় তাকে। কশিনের টাকা তোলার দায়িত্বে আছেন লালমোহনের পঞ্চায়েত সোহেল এবং তজুমদ্দিনের ইকরাম ও রিয়াজ। লালমোহনে তার এখন শত শত বিঘা জমি। তার সম্পদ হাজার কোটি টাকার ওপর।
এমপি শাওনের সম্পদ : শাওনের আয়কর রিটার্নের কপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দাখিল করেন, সেটিতে তিনি ২৬ দশমিক ৫৪৫ শতাংশ জমির মালিক বলে উল্লেখ করেন, যার মূল্য দেখানো হয় ১ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। সঙ্গে ঢাকায় একটি বাড়ি ও একটি ফ্ল্যাট, লালমোহনে দুটি বাড়ি থাকার তথ্য দেন। যার মূল্য দেখান ২ কোটি ৭২ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ টাকা।
২০১৮ সালে নভেম্বর পর্যন্ত তার জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৪০ শতাংশে। এর মূল্য দেখানো হয় ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকায় দুটি বাড়ি ও লালমোহনে দুটি বাড়ি নির্মাণ করেন, যার মূল্য দেখানো হয় ১২ কোটি ৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা। তার ব্যবসার মূলধন, গাড়ি, স্বর্ণালঙ্কার ও ব্যাংকে জমাসহ মোট ১৭ কোটি ৪০ লাখ ৭০ হাজার ৬০০ টাকা। বছরে তার আয় ১৫ কোটি ৭২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৬ এবং ব্যয় ৫ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৭ টাকা।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে হলফনামা দাখিল করেন। তাতে বলা হয়, তার ঢাকায় ও লালমোহনে ১৬ দশমিক ৬৮৫ শতাংশ জমি আছে, যার মূল্য ৪ কোটি ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ২২০ টাকা। ঢাকায় দুটি ও লালমোহনে একটি আবাসিক বাড়িসহ জমির পরিমাণ ১৪৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যার মূল্য ১৪ কোটি ৮৮ লাখ ৬ হাজার ২৮৫ টাকা। তার ব্যবসার মূলধন, গাড়ি, স্বর্ণালঙ্কার ও ব্যাংকে জমা মোট ৩৩ কোটি ৫৫ হাজার ৭৩২ টাকা। তার ইসলামী ব্যাংকে ১০ কোটি টাকার লোন আছে। তার বছরে আয় ১ কোটি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার এবং ব্যয় ৩ কোটি ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪৫ টাকা।
২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে নামে। এমপি শাওনের বিরুদ্ধে তিনটি ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। শাওন তখন গা-ঢাকা দেন। ওই সময়ে ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী প্রায় ২০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। ওই তালিকায় শাওনের নামও ছিল। অভিযোগের অনুসন্ধান চলাকালে তিনি যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সেজন্য ২০২১ সালের ১৩ জুন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের আদেশে তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক।
ইব্রাহিম হত্যার অভিযোগ : এমপি শাওনের একটি ব্যক্তিগত ৩২ বোর পিস্তল ও একটি ১২ বোর শটগান আছে। দুটি অস্ত্রের মূল্য দেখানো হয় ২ লাখ টাকা। ২০১০ সালের আগস্ট মাসে শাওনের বাসায় গুলিতে নিহত হন তার সহযোগী ইব্রাহিম। ওই খুনে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম. রেজাউল করিম এর অপরাধ নামা; অনুসন্ধানে দুদক
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করবে দুদক
আরও সংবাদ পড়ুন।