জাপানীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় একজন বাঙালি। জাপান সফরের আগেই নামটি শুনেছিলাম। এমন একজন বাঙালিকে সকল জাপানি হৃদয়ে স্থান দিয়ে রেখেছেন, এখনো।
জাপান সফরে গিয়ে টোকিও তে অবস্থিত তাঁর স্ট্যাচুর স্থানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। নিজের চোখে দেখে বিস্মিত হয়েছি! এমন একজন বাঙালি কেন জাপানিদের কাছে এতো আপনজন! কেন জাপানিরা এই বাঙালির নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছেন! জাপানের টোকিও শহরে তাঁর নামে রয়েছে জাদুঘর, রাস্তা, রয়েছে স্ট্যাচু। এমনকি জাপান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রিসার্চ সেন্টার রয়েছে তাঁর নামে । তিনি আইন সম্পর্কিত বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি হলেন বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণকারি বাঙালি বিচারপতি ডঃ রাধাবিনোদ পাল। শুধু বিচারপতি নন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও ছিলেন তিনি।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার “মধুরাপুর” ইউনিয়নের “মৌজা সালিমপুরের” অধীন “তারাগুনিয়া” গ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের ছাতিয়ান গ্রামের গোলাম রহমান পণ্ডিতের কাছে তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। কুষ্টিয়া হাইস্কুলে তিনি মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
১৯২০ সালে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের শুরু।
১৯২৫-১৯৩০ মেয়াদে এবং পরবর্তীতে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে অধ্যাপনা করেন।
পরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগদান করেন। ১৯৪১-৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ১৯৪৪-৪৬ মেয়াদে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ডঃ রাধাবিনোদ পালের সুখ্যাতি
শুধু পাকিস্তান-ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৬-৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাপানের রাজধানী টোকিও মহানগরে জাপানকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে যে বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়, তিনি ছিলেন সেই আদালতের অন্যতম বিচারপতি।
তিনি তাঁর ৮০০ পৃষ্ঠার অধিক যৌক্তিক রায় দিয়ে
জাপানকে “যুদ্ধাপরাধ”-এর অভিযোগ থেকে মুক্ত করেন। এ রায় বিশ্বনন্দিত ঐতিহাসিক রায়ের মর্যাদা লাভ করে। এরপর তিনি জাপান-বন্ধু ভারতীয় বলে
খ্যাতি অর্জন করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে জাপানের আত্মসমর্পণের পর
মিত্রশক্তি তাদের বিবেচনায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধে জাপানের সম্পৃক্ততা এবং বিশ শতকের ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে জাপানে সমরবাদের উত্থানের জন্য যেসব জাপানী নেতা ও জেনারেল দায়ী ছিলেন তাদের বিচারের আয়োজন করে। মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক ডগলাস ম্যাক আর্থার পটস-ডাম ঘোষণা দ্বারা অর্পিত ক্ষমতাবলে দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন।
পরবর্তী সময়ে এই ট্রাইব্যুনালে জাপানের প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় (১৯৪৬-১৯৪৮) এবং তাতে জাপানের আটজন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদন্ড এবং আরো সতেরো জনকে কারাদন্ড দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনে সর্বমোট ১১জন বিচারককে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ সদস্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে জাপানী নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করেন এবং আন্তর্জাতিক আইনে তাদের সাজা দেন। কিন্তু এ ট্রাইব্যুনালের বাঙালি বিচারপতি ডঃ রাধাবিনোদ পাল ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশের রায়ের সাথে একমত হতে পারেন নি। তিনি ভিন্ন মত পোষণ করে একটি রায় প্রদান করেন এবং অধিকাংশ বিচারকের রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করতে অস্বীকৃতি জানান। দীর্ঘ আটশ’ পৃষ্ঠার অধিক রায়ে ডঃ রাধাবিনোদ পাল দেখিয়েছেন যে, বিবাদী পক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো আইনের চোখে টেকে না। তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, সব সাক্ষ্য প্রমাণাদি খুবই দুর্বল এবং তাতে বিজয়ীদের দৃষ্টিভঙ্গী ও খেয়ালখুশির প্রতিফলন ঘটেছে। দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি রাধাবিনোদ প্রদত্ত ভিন্নমত পোষণকারী রায়টি একদিকে আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসে এবং
অন্যদিকে যুদ্ধ ও শান্তির ইতিহাসে অসাধারণ গুরুত্ব বহন করে। এতে যুদ্ধ ও শান্তির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতিহাসের আইনগত ভিত্তির দালিলিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ডঃ রাধাবিনোদের ভিন্নমত পোষণকারী রায়ের মূল প্রশ্ন ছিল, যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করার এবং নিজেদের শর্তানুযায়ী পরাজিত শত্রুদের বিচার করার নৈতিক ও আইনগত এখতিয়ার আছে কিনা!
তাঁর চিন্তা আমাকে খুবই আপ্লুত করেছে! আজ ২৭ জানুয়ারি তাঁর ১৩৮ তম জন্মদিনে একজন বাঙালি হিসেবে আমি তাঁর জন্য গর্ব বোধ করি।
মহসিনুল হক
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ
চাঁদপুর।
সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ
ভোলা।