মধু ডাকছে – শাহানা সিরাজী

Picsart_23-04-20_23-54-40-534.jpg

মধু ডাকছে – শাহানা সিরাজী

আচ্ছা,না হয় আমার পঁচাত্তর হয়েছে!আমার পত্নি-বিয়োগ হয়েছে দশ বছর হয়েছে। ঘরে ঢুকলে কেউ ঝাঁঝালো ভাষাও বলে না এতোক্ষণ কই ছিলে?ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব গেলো না! দুপুর গড়িয়ে বিকেল,আমি যে না খেয়ে বসে আছি খেয়াল নেই? তারপর তেড়ে এসে তোয়ালে হাতে ধরিয়ে বলবে, যাও, দ্রুত স্নান সেরে আসো, অভ্যাস বদলালো না সারা জীবনেও! বাইরে থেকে ফিরে সোজা বিছানায়, এ চাদর পালটানো কতো ভেজালের তাতো আর জানো না, ওঠো যাও, কসকো সাবান গায়ে মেখে স্নান দাও, ডিম আবার ভেজে দিচ্ছি!

কেউ এখন ঝাড়ি দিয়ে বলে না, চশমা ছাড়া পেপার পড়া নিষেধ, ভুলে গেলে? নাও চা খাও। খবরদার চিনি মেশাবে না!

কেউ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলে না রেডমিট খাওয়া যাবে না। রেস্টুরেন্টের খাবার খাওয়া চলবে না। আজ কেবল কালিজিরার ভর্তা, কলাকচুর ভাজি, করলা সেদ্ধ। কোন কথা বলা যাবে না, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কথা মনে নেই!

মধু বেঁচে থাকতে কতই না বিরক্ত হয়েছি, রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছি, ইচ্ছে মতো রেস্টুরেন্টে নাক ডুবিয়ে কালিভূনা খেয়ে বাসায় তার সাথে কাঁচাকলার ভর্তা খেয়ে সাধু সেজেছি।
ময়লা জামা পরে বেরিয়ে গিয়েছি। তার ছিলো শুচিবায়ু। হাত না ধুয়ে একটা চামচ ধরাও বারণ। আমি যে কত হাজার বার হাত না ধুয়ে তাকে ছুঁয়েছি। রাতদুপুরেও আবার স্নান করেছে।
তাকে জ্বালানোটা ছিলো নৈমিত্তিক ব্যাপার।

সে কেঁদে কেটে আম্মার কাছে নালিশ করতো। আম্মা আমাকে চোখ টিপ দিতো আর মুখে মুখে আচ্ছা ধোলাই দিতো।
সারাদিন সংসার বাচ্চা-কাচ্চা সামলিয়েও তার বই পড়া অভ্যাস ছিলো, আমি কোনদিন তাকে একটা বই কিনে দিইনি। তার বইয়ের সাপ্লাই আসতো আমার জমজ ভায়ের থেকে। মধু দেবর অন্তঃপ্রাণ ছিল। এক সাথে জন্ম হলেও আগে দুনিয়ার আলো নাকি আমিই দেখেছি। তাই আমি বড় সে ছোট!

রহিম বাদশাহ রূপবান কন্যা থেকে হিটলার পর্যন্ত সব বই তার পড়া। হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ থেকে সমরেশ মজুমদার, অরুন্ধতী রায়, তসলিমা নাসরিন, কোরআন- হাদিস- বাইবেল -গীতা -ত্রিপিটক সবই তার পড়া লাগবে। সবই সে পড়ে। তাই তার সাথে কথা বলে টিকে থাকা মুশকিল ছিলো।আমিও পালিয়ে পালিয়ে বেডতাম। কে এত কথা বলবে!

একদিন বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর জাগেনি। আমি বিশ্বাস করিনি মধু নেই।সবাই তাকে পুকুরের পাড়ে রেখে এসেছে। আমি আজও বিশ্বাস করতে পারি না,বাজার থেকে বিশাল এক কোরাল মাছ এনেছি। কেটে আনিনি তাই ভীষণ রাগ হলো, আমাকে বললো,বুড়ো হয়েছে বটে জ্ঞানে বুড়ো হওনি। জ্ঞান কোথায় লুকিয়ে রেখেছো। এ মাছ কাটবো কী ভাবে! বললাম, বুড়ী হয়েছো একটা মাছ কাটতে পারবে না! সে কী রাগ! আমি বুড়ী বলেই পারবো না। বললাম, এসো আমি কেটে দিই। এবার তো তার হাসি আর ধরে না! তুমি কাটবে?

আচ্ছা কাটো! আমি সত্যি সেদিন মাছ কাটতে গিয়েছিলাম, পরে বোধ উদয় হয়েছে,দশ কেজি ওজনের মাছটি ওকে দেখানোর জন্য নিয়ে এলাম যে কেটে আনা উচিত ছিলো। আসলে পরদিন ছেলে মেয়েরা আসবে,আনন্দে সত্যি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি!

মধু আমার হাত থেকে দা নিয়ে নিজেই কাটলো, অনেক কষ্ট হয়েছে। তবুও কেটে কুটে, রান্না করেছে। সে বলে কোরালমাছ ভাজতে নেই। তরকারিও দিতে নেই। কষিয়ে মাখা মাখা রান্না করতে হয়। পৌষের শীতে জমে যাবে সকালে খেতে ভালো লাগবে।

আমাকে গরম গরম খেতে দিলো,আমার মাকে নিজের হাতে খাওয়ালো। সন্তানেরা আসবে রান্না করে রাখলো। অনেক রাতে আমাকে চা খাওয়ালো। আমার ঘন ঘন চা খাওয়ার বাতিক। তারপর টেবিল ল্যাম্প জ্বলে ‘দ্য সোল অব রুমি’
বইটি পড়ায় মন দিলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। অন্যদিন তাহাজ্জুদ পড়ি। সেদিন ফজরের আজান হয়ে কখন সূর্য উঠেছে টের পাইনি। আসলে টের পাবো কেমনে,অন্যদিন মধু আগেই ওঠে। চুলায় চা বসিয়ে অজু করে। দুজনে চা খাই। তাহাজ্জুদ-ফজর পড়ি। আমি আবার ঘুমাই,মধু হাঁটতে যায়। তারপর বুয়া আসে সংসারের কাজে মন দেয়।
আজ যে মধু ওঠেনি! ভাবলাম,অনেক রাতে ঘুমিয়েছে তাই জাগেনি। ইজি চেয়ারে হেলানো অবস্থাতেই আছে, আমি ডাকলাম,আজ কী চা হবে না, মধু? আর কতোক্ষণ ঘুমাবে। ওঠে না, হাত দিয়ে ধরতে গেলাম,মধু ওঠো। বইটি পড়ে গেলো, সাথে সাথে মধুও নিথর পড়ে রইল। আজ তার সন্তানেরা আসার কথা। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মধু নেই!
আমার মা লাঠি ভর দিয়ে কী ভাবে যেন এ ঘরে এলো,বউ মার কী হয়েছে?
মা ধীরে ধীরে তার কাছে এলো,শীর্ণ হাত দিয়ে তার কপাল স্পর্শ করলো,মধু মধু আমার মধুবালার কী হয়েছে রে! মধুর গা ধরে ঝাঁকুনি দিতেই কাত হয়ে এক পাশে পড়ে গেলো।
মা মধু মধু ডাকতে ডাকতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আর জ্ঞান ফিরেনি। আমি চুপচাপ বসে আছি। মা আর মধু দুজনই আমাকে ছেড়ে চলে গেলো!
আমাদের সন্তানেরা সেদিন সকাল সকাল বাড়ি এসেছে। মধুকে না পেলেও তার হাতের রান্না করা পাঁচপদ তারা তৈরি পেয়েছে।
মায়ের ঘরে আলো জ্বলে না।কেউ খাবার রেডি করে আর ডাকে না,মা ওমা,মানসিক প্রস্তুতি নিন, গোসলে নেবো এখন। আজ আপনার পছন্দের লইট্টা মাছ রান্না করেছি। মা ফোকলা দাঁতে খিলখিল হাসে। আমি একাই গোসল করতে পারি, এই দ্যাখো- মধু হায় হায় করতে করতে দৌড় দিয়ে ধরে ফেলে,বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না। মাকে গোসল দিচ্ছে মধু, কখনো সুগন্ধি সাবানের ঘ্রাণে সারা ঘর ভুরভুর করছে,কখনো শ্যাম্পুর ঘ্রাণে চারদিক ডুবে আছে। তাদের বাক্য বিনিময় ঘরে অন্য রকম পরিবেশ বিরাজ করতো। মা কোরান পড়া শুনতেন,আবার গান শুনতেন। মধু গাইতেও পারতো। প্রায় চাঁদনী রাতে মধু মাকে উঠানে নিয়ে যেতো। মার লাগানো গন্ধরাজ,হাসনাহেনা,মাধবীলতায় জড়ানো জোছনা দেখতে মা ভালোবাসতো। মধু আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে.. গানটি প্রায়ই গাইতো। মা মন ভরর শুনতো আর তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতো। মার ঘুম যাতে না ভাঙে বায়েজীদ বোস্তামীর মতো ঠাঁয় বসে থাকতো। মা জেগে কপট রাগ করতো।আমাকে আচ্ছা বকা দিতো। হঠাৎ বজ্রপাতে সব শেষ!

তারপর থেকে এ বাড়ি সুনসান। সন্তানেরা তাদের সংসারে। আমি দশ বছর যাবৎ মধুকে বুকে লালন করছি। সেদিন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছি। একা একা মাথায় পানি ঢেলেছি। আমার সন্তানেরা আমাকে যত্ন করে। কিন্তু আমি তো বাড়িতেই থাকি। তারা রুটি রুজির জন্য বাইরে থাকে। চাইলেও সব সময় পাই না।

বললাম,আপনার বিত্ত বৈভবের অভাব নেই। একটা বিয়ে করে ফেলুন।

ভদ্রলোক বললেন, আমার মেয়েরা তা বলেছে।
তারা চায় আমি একটা বিয়ে ক

ভদ্রলোক বললেন, আমার মেয়েরা তা বলেছে।
তারা চায় আমি একটা বিয়ে করি, কিন্তু জানেন,এখন এক জ্বালা তখন সতের জ্বালা হবে। তা ছাড়া এ সংসার মধুর, সে নেই,তাকে ফাঁকি দিয়ে আর একজন নিয়ে আসবো?
সারাজীবন মধুকে জ্বালিয়েছি, তাকে ফেলে রেখে বিদেশ করেছি,এখন সে বিদেশে আমি অপেক্ষায় আছি। চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল ঝরছে। আমি কী বলবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আসলে আমার কী বলা উচিত তাও ভাবছি।

ভদ্রলোকের নামও জানি না অথচ মনে হচ্ছে অনেক দিনের চেনা। চুপচাপ রইলাম,।প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাই।লঞ্চের ভেতরের গুমোট আবহাওয়ার সাথে ভদ্রলোকের হৃদয় নিংড়ানো আহাজারিতে মনে হলো,কেন মানুষ মায়ায় জড়ায় যদি হারিয়ে যায় আবার!

কিন্তু এতো অমোঘ নিয়তি, একে মানা ছাড়া আর উপায় কী! মায়ার জন্য এখনো পৃথিবী টিকে আছে। কেউ অবহেলা করে কেউ আবার কাছে ডাকে ভালোবাসে। সব কিছু নিয়েই মানুষের জীবন। হাসি- কান্না,সুখ-দুঃখ, শান্তি-শৃঙ্খলা, রোগ-শোক সব নিয়েই আমরা। আমাদের অনুভূতি ধারালো তাই সব কিছুকেই আঁকড়ে ধরি।

আবার তার দিকে তাকালাম,দেখি একই ভাবে কেঁদে যাচ্ছে। ভাবলাম,কাঁদুক। কাঁদলে কষ্ট হালকা হয়,বুকটা পাতলা লাগে। দুঃখ নেই কার!

এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ালো হকার। হাতে টুথ ব্রাশ। দুটো ব্রাশ মাত্র বিশ টাকা, নেন ভাই, এতো কম দামে কোথাও পাবেন না, এগুলো মেটাডোর কোম্পানীর। একেবারেই নরম।
হকারের চিৎকারে ভদ্রলোক বাস্তবে ফিরলেন। সুযোগ বুঝে বললাম, দেখুন তো,লোকটি সারাদিন কয়টি ব্রাশ বিক্রি করতে পারে রোজ,তাতে তার সংসার চলে?

মুহূর্তেই তার চেহারা পালটে গেলো। যে দেশ কর্ম সংস্থান করতে পারে না সে দেশ কী ভাবে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে! আমাদের সিস্টেমই পোকায় ধরা! সরকার চাইলেও পারে না,আদমজি জুট মিলের কথা মনে আছে? আচ্ছা ধরুন বিটিসিএল- কত টাকা প্রতিবছর লস দিচ্ছে? আদমজি জুট মিল কেন বন্ধ হয়েছে? পৃথিবীর কয়টা রাষ্ট্রে আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই? বলেই যাচ্ছে একজন সচেতন নাগরিকের মতো। মনে মনে হাসলাম, স্ত্রী বিয়োগ ব্যথায় যতোটা কাতর হয়েছে এখন ঠিক ততোটাই পলিটিশিয়ান। বললাম, জনাব এতো কথা বুঝি না, শুধু বুঝি আপনারা যারা রাজনীতি করেন তারা ঘুষ খাওয়া বন্ধ করুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। মধুকে যেমন আজও ভালোবাসেন তেমনি দেশটাকেও ভালোবাসেন তাহলে দেখবেন কর্মসংস্থানের অভাব হবে না।

দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। বেঁচে থাকার অধিকার সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাটা জীবন দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন আমরা কি আমাদের জায়গা থেকে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দায়িত্ব যথারীতি পালন করতে পারি না? যে দেশের মাটি এত নরম যে দেশের মানুষের মনে এত প্রেম সেই দেশ কি করে পিছিয়ে থাকে? সেই দেশের মানুষের বাঁচার জন্য এত হাহাকার কেন করতে হবে? শুধু সরকারের একার নয় সকলের. এ দায় সকলের সকল নাগরিকের। নাগরিক কেন পারে না তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে,তাদের কর্তব্য সম্পাদন করতে। কর্তব্য সম্পাদন করলে অধিকার আদায় হয়ে যায়। সরকার তো কোন প্রতিষ্ঠান নয় সরকার কোন ব্যক্তিও নয় সরকার হলো সরকার, সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য যে প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে সে কাঠামোতে যারা কাজ করে তারা যদি

নীতিবিরুদ্ধ হয় তাদের যদি কোন ব্যক্তিত্ব না থাকে, তারা যদি নিজেদেরকে দুর্নীতির ভেতর ডুবিয়ে দে তাহলে দেশ কে উদ্ধার করবে? শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের বিনিময়ে দিয়েছেন একটি মানচিত্র যে মানচিত্র তারই রক্তে আবার রঞ্জিত হয়েছে, আমরা সেই মানচিত্র রক্ষার জন্য সেই পতাকার মান সমুন্নত রাখার জন্য কি এমন করছি? আমাদের দায়িত্বটুকু কি আমরা যথারীতি পালন করছি? ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, আমরা সকলেই সকলের স্বার্থে মশগুল, ক্ষুদ্র স্বার্থে মশগুল, বৃহত্তর স্বার্থ দেখার আমাদের সুযোগ কোথায়!
বললাম ,আমার নিজ বাড়িতে যেতে আমি পারি না। আমার বাড়ি দরজায় ঘর করে রেখেছে অন্যায় ভাবে, আমি প্রতিবাদ করতে পারি না। কারণ দীর্ঘদিন ধরে আইনের কাঠগোড়ায় ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত। প্রতিপক্ষ অন্যায় ভাবে ঘর তুলেছে আমাকে ফাঁসানোর জন্য। আমি জুতো খুলে হাতে নিয়ে আমার বাড়িতে প্রবেশ করি, তবুও সেই ঘর কেন তুলল সেজন্য প্রতিবাদ করতে পারি না। ঝগড়া ভালো লাগে না। এই যে অন্যায় না করলেও পারতো। আমার আম্মাকে বাড়িতে রাখতে আমরা সব ভাই-বোন ভয় পাই কারণ প্রতিপক্ষ আমার আম্মাকে খুন করতে পারে, মেরেও খেলতে পারে । এমনি ভাবে ঢাকা থেকে যখন নিজের জেলায় যাই, যে যে জেলার উপর দিয়ে আমার গাড়ি যায় সে জেলার লোকদের ট্যাক্স দিতে হয়, এইতো অন্যায়। আমার নিজের জেলায় যখন আমার কাছে ট্যাক্স চাইলো আমি জিজ্ঞেস করলাম এই টেক্স কাকে দেব? বলল, পৌরসভা কে। বললাম তা হলে রশিদ দাও, রশিদের বিনিময়ে আমি টাকা দেব। আমাকে সেখানেই খুন করতে পারতো বাধ্য হয়ে ড্রাইভার ২০০ টাকা দিল। দেখুন এবার, দুশো টাকার জন্য আমাদের অন্যায়। নিশ্চয়ই আমার জেলার মন্ত্রী, এম পি, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদ সকলেই জানেন। আবার প্রশাসনে সকলেই জানতে পারে এবং জানে কিন্তু প্রতিকার করার কোন সাহস কারো নেই। কারণ দূর্বৃত্তদের পেছনে রাজনীতিবিদ রয়েছেন আপনারা। ভদ্রলোক আমাকে বললেন আপনার অনেক সাহস! বললাম স্ত্রী বিয়োগ হল বলে, যেভাবে কাঁদছেন তাতে মনে হল আপনি অনেক ভালো মানুষ। আপনি কি মনে করেন আমাদের বাড়ির দরজা ঘর তুলে যে অন্যায় করা হয়েছে তা অন্যায় নয় কী? একজনের গাড়ি, ট্রাক, পিকআপ আপনার জেলার উপর দিয়ে যেতে পারে সে জন্য আপনি চাঁদা নেবেন? আমাদের দেশটা তলে তলে এরকম জঘন্য হয়ে আছে যে! বাহিরে আমরা অনেক সাধু ভেতরে আমাদের সব ধুলো -মলিন -ময়লা -আবর্জনায় ভরা! আমাদের মাথা ভর্তি গারবেজ, যারা ভালো কাজ করতে চায় আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করি না, তাদেরকে চিনতেও পারি না আর যারা অন্যায় করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়, তারাই মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট করার জন্য একমাত্র দোষী ব্যক্তি। লোকটি পুরোপুরি এখন পলিটিশিয়ান হয়ে গেল! কান্না ভুলে আমার সাথে জোরসে আলাপ জুড়ে দিলো।

কিছুক্ষণ পর মনে হলো সবাই বিরক্ত হচ্ছে। শান্তিতে থাকার অধিকার সবার আছে। আমার ডান পাশের যাত্রী ছেলেমানুষ। বয়স পনের ষোলো হতে পারে। এক মনে শর্ট ভিড়িও দেখে যাচ্ছে। মনের অগোচরেই তার পা দুটো সামনের সিটের লোকটির গায়ের সাথে লাগিয়ে দিলো। অমনি বিশাল টাকওয়ালা লোকটি চিৎকার শুরু করলো। পেছন থেকে একজন তেড়ে উঠলো,এই খবরদার উনি সম্মানীত মানুষ। উনাকে অসম্মান করা যাবে না। আমি ব্যাপারটি লক্ষ্য করিনি কিন্তু আমার বাম পাশের পলিটিশিয়ান বেশ লক্ষ্য করলেন, কথা থামিয়ে তিনি সামনের লোকটিকে রাগ কমাতে সাহায্য করলো। পেছন থেকে লোকটি বললো,ইনি ডাক্তার। খুব সাবধানে কথা বলবেন! আমি ভাবলাম,ডাক্তার মানেই পীথাগোরাসের উপপাদ্য। ঠা ঠা মুখস্ত করো পরীক্ষার খাতায় লিখ! কোন ক্রিয়েটিভি নেই,রিসার্চ নেই!
টি সটল দিয়ে বসে, মুখস্ত বিদ্যায় প্রেসক্রিপশন লিখে। ভুলভাল তো হতেই পারে তাই বলে এতো শাউট! মানুষের টাকার বিনিময়েই প্রেস্ক্রিপশন লিখে। সম্মানীত হলে মানুষই হবে। ডাক্তারকে কেন আলাদা করে সম্মান করতে হবে! পেশা হিসেবে সবাইকেই সম্মান করাই উচিত। প্রত্যেক মানুষই সম্মানীত। পেটের দায়ে যে ভিক্ষা করে,মানুষ হিসেবে তারও সম্মান আছে। তাকেও বিশ্রী ভাষায় কথা বলা যাবে না।

আবার কথায় ফিরে এলাম, বললাম যাই বলেন নারী পুরুষ সবাই মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সঙ্গী লাগেই। আর কিছু না, শুধু মাত্র ওইটুকু জিজ্ঞেস করার জন্য, এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? অথবা চা খাবে?

ভদ্রলোক এবার বললেন, আপনি ঠিকই বলেন,মধু আর ফিরবে না আমাকেও বাঁচতে হবে! ততোক্ষণে লঞ্চ ঘাটে ভিড়েছে।

আমাকে দাঁড়াতে সাহায্য করে বললো, আপনার যে অবস্থা তাতে সঙ্গী আপনার বেশী লাগে।

একটু হেসে পেছনে ফিরে দেখলাম, ভদ্রলোকের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে এবং অশ্রু ঝরছে,অনেক দিন পর কারো সাথে নিজেকে শেয়ার করলাম বলেই আমার ব্যাগ ধরতে উদ্যত হলেন।

এমন সময় তার জমজ ভাই উপস্থিত হলেন, এখনো দাঁড়িয়ে আছিস,চল সামনে। নামতে হবে।

দু ভায়ের শুভ্র দাড়ি,একই রকম পোশাক। এক ভাই আর এক ভাইকে ধরে এগুচ্ছে। আমি স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কেবল মনে হচ্ছে, শৈশবে আমার দুছেলে এ ভাবে জড়াজড়ি করে চলতো, বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস আমাকে সাইক্লোনের মতো উড়ালো, ধাক্কা খেলাম কঠিন তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক শক্ত করে আমার হাত ধরে আছেন, আপনি জানেন না,লঞ্চ ভীড়লে শেষে এক কঠিন ধাক্কা লাগে। আমি না থাকলে তো পড়েই যেতেন। বললাম, মধু ডাকছে চলুন….

অদূরে লিপি আর সঞ্চিতা হাতছানি দিলো, এই যে আমরা এখানে। আমিও ভীড় ঠেলে এগুতে লাগলাম,ভদ্রলোক,এই ভাই সরুন, পথ দিন,যেতে দিন বলতে বলতে সামনে চলছে বার বার পেছনে তাকাচ্ছে,সাবধান,পড়ে যাবেন…

শাহানা সিরাজী
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

আরও লেখা পড়ুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top