রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জালিয়াতি নাকি কর্মকর্তা কর্মচারীদের দূনীর্তি – বিএমইটির
অপরাধ প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র না পাওয়ায় সিঙ্গাপুর যেতে অনেকে বাধার মুখে পড়ছেন। কারো কারো ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
দেশের চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে সিঙ্গাপুরে প্রায় ৬৬ হাজার কর্মী পাঠানোর অভিযোগ তদন্ত করছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
অবশ্য, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে, তারা বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েই কর্মী পাঠিয়েছে।
বিএমইটির ছাড়পত্র না পাওয়ায় সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট বাতিল হয় রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহির আহমেদের। জমি বিক্রি করে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য ১০ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বিএমইটির ছাড়পত্র না পাওয়ায় সিঙ্গাপুর যাওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের কম্পানিতে আমার নাম এসেছে। টিকিটও কনফার্ম করা। কিন্তু বিএমইটির ছাড়পত্রের জন্য ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। এতগুলো টাকা ধারদেনা করে জমা দিয়েছি। যেতে না পারলে বিপদে পড়ে যাব।’ তিনি আরো জানান, একই কারণে আরো ৬০ থেকে ৭০ জনের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
একই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন ঝিনাইদহের হামিম রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টে টাকা-পয়সা আইন্না বিদেশ যাওয়ার জন্য জমা দিছি। সরকারের কাছে আবেদন, আমার বিএমইটি কার্ডটা যেন তাড়াতাড়ি কইরা দেয়।’
সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে, সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের জন্য বিএমইটির ছাড়পত্র পেতে আগে খরচ হতো কর্মীপ্রতি ছয় হাজার টাকা। এখন লাগছে কর্মীপ্রতি ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এতে বিএমইটি কার্ড পেতে সমস্যায় পড়ছে এজেন্সিগুলো।
তবে খরচ বৃদ্ধির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক শহীদুল আলম।
ছাড়পত্র পেতে সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের জন্য আমরা রিক্রুটিং এজেন্সি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দাঁড় করাচ্ছি। যেকোনো ছাড়পত্র নিতে গেলে কর্মীর পাশাপাশি ওই এজেন্সির সব কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে। এই এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে আগে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না, সেটিও আমরা দেখছি। এসব কার্যক্রম শেষ হলেই ছাড়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকবে না।’
চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ:
২১ নভেম্বর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিএমইটির তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স ওয়েসিস সার্ভিসেস সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে বিএমইটিতে ৩০ লাখ টাকা জামানত দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর জামানতের টাকা তারা প্রত্যাহার করে। সে অনুযায়ী তাদের সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর সুযোগ ছিল না। অথচ একই বছরের ১২ নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন হাজার ৩৭ জন কর্মী সিঙ্গাপুরে পাঠায় তারা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আইন অনুযায়ী গত ২১ নভেম্বর থেকে আগামী বছরের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ওয়েসিস সার্ভিসেসের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্তাধীন চার রিক্রুটিং এজেন্সি হল, আল জান্নাত ওভারসিজ প্রাইভেট লিমিটেড, আরএক্স কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, ওয়েলটেক এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস ও দি গাজীপুর ইন্টারন্যাশনাল।
২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই চারটি রিক্রুটিং এজেন্সি ৬৬ হাজার ৯৫ জন কর্মী সিঙ্গাপুরে পাঠায়। ওয়েলটেক এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস ২৪ হাজার ২১০, গাজীপুর ইন্টারন্যাশনাল ২৩ হাজার ৩৭৪ ও আরএক্স কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ১৫ হাজার ৬১৬ ও আল জান্নাত দুই হাজার ৮৯৫ জন কর্মী পাঠিয়েছে।
গত ১৯ জানুয়ারি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিএমইটির তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যে ওভারসিজ ট্রেনিং সেন্টার ‘ওয়েলটেক কনস্ট্রাকশন পিটিসি লিমিটেড’ থেকে এনওসি নিয়েছিল এই চারটি রিক্রুটিং এজেন্সি।
সিঙ্গাপুরের ট্রেনিং সেন্টার বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অথরিটি (বিসিএ) থেকে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে সংশ্লিষ্ট ওভারসিজ ট্রেনিং সেন্টারের। কিন্তু বিসিএর ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, বিসিএর অনুমোদিত তালিকায় ওভারসিজ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ওয়েলটেকের নাম নেই। নাম না থাকলেও তাদের লাইসেন্স বাতিল অথবা স্থগিত না করে ২০২৩ সালে ২৩ জানুয়ারি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে তাদের শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফেরদৌস আহমেদ বাদল বলেন, ‘আমি যদি তথ্য গোপন করে কর্মী পাঠাই তবে বিএমইটি থেকে আমাকে কিভাবে ছাড়পত্র দিল? তারা অনুমতি না দিলে তো আমি কর্মী পাঠাতে পারতাম না।’ একই ধরনের কথা বলেন আরএক্স কেয়ারের মালিক নূরে আলম সিদ্দিকি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের শ্রমবাজারে সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক অনেক বেশি। এসব শ্রমবাজারে যদি আমাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারি, তবে সেখানকার কম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ হারাবে। এমনিতেই করোনার সময়ে আমরা একটা ধাক্কা খেয়েছি। এখন কিছুটা এগোতে পেরেছি আমরা। এটা রক্ষা করতে হলে কোনো জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়া যাবে না।’
অভিযোগের সুষুম তদন্ত হচ্ছে জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনাগুলো আমি পর্যবেক্ষণ করছি। এটা নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা এর সঙ্গে জড়িত, তাহলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।’