ঢাকা ও চট্টগ্রামে বন্ড কমিশনারেটে দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া
অপরাধ প্রতিবেদকঃ বন্ড কমিশনারেট দফতরগুলোতে দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বন্ডের কাপড় বিক্রি নিয়ে একাধিক তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ায় ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে উল্টো তারা ঘুষের রেট বাড়িয়ে দিয়েছেন।
যে কারণে বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, চিহ্নিত চোরাকারবারিরা আরও আঁটসাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছে। অথচ যারা বন্ডের নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাপড় আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয় তাদের নামধাম সবই জানা আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বন্ড কমিশনারেট দফতরের।
কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বরং কাপড় রাকারবারিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে চোখ-কান বন্ধ করে রাখার কৌশল তাদের।
অভিযোগ আছে, বিপুল অঙ্কের মাসোহারা নিয়ে দেশের বস্ত্র খাত ধ্বংসকারী এ চক্রকে আরও আশকারা দিচ্ছেন তারা। এজন্য ইসলামপুরে বন্ডের কাপড় বিক্রির এখন মহোৎসব চলছে।
মাঝে মধ্যে লোক দেখানো দু-একটি অভিযান করলেও পর্দার আড়ালে তারা চোরাকারবারিদের লালনপালন করে আসছে। বন্ড লাইসেন্সের অপব্যবহারের ফলে দেশীয় শিল্প অস্তিত্ব সংকটে পড়লেও বন্ড কমিশনার অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবস্থা পোয়াবারো।
এই ঘুষ কারবারে বিপুল মাসোহারা পেয়ে এখানে সবাই এখন কোটিপতি। বড় কর্তাদের সম্পদের হিসাব মেলানো ভার। এজন্য টাকার নেশায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং পেতে অনেকে মরিয়া হয়ে মাঠে নামেন।
এদিকে বন্ড কমিশনারেট দফতরগুলোর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এরপর এক ধরনের অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ আছে, এ পর্যন্ত বন্ড কমিশনারেট দফতরের বিরুদ্ধে দুদকসহ অন্যান্য সংস্থার যত তদন্ত হয়েছে সবই রহস্যজনক কারণে মাঝপথে থেমে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের স্বার্থবিরোধী এই চক্রকে এখনই রুখে দিতে না পারলে বস্ত্র খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় অনিবার্য। কারণ বন্ডেড সুবিধায় আনা বিভিন্ন শ্রেণীর কাপড় রাজধানীর ইসলামপুরের মার্কেটে দেদারসে ঢুকে পড়ায় দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কাপড় অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। ফলে দেশের বস্ত্রশিল্প বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, শুল্ক ও করমুক্ত এবং মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি হওয়া সুতা কাপড়সহ বিভিন্ন পোশাক পণ্য অবাধে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের রফতানিমুখী স্পিনিং ও উইভিং মিলগুলোতেও।
সূত্র জানায়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত হিসেবে বিভিন্ন সময় সাড়ে চার শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট থেকে এ জাতীয় ৪৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল ও ব্যাংক হিসাব জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে প্রক্রিয়া বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। বরং এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই পুনরায় আমদানি ছাড়পত্র পেতেও সক্ষম হয়। এছাড়া বন্ড মাফিয়া হিসেবে পরিচিত ৬৭ জন চোরাচালানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মামলাও করা হয়। কিন্তু সেসব মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।
জানা যায়, নিয়মানুযায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা বন্ডের কাপড় শতভাগ রফতানিমুখী গার্মেন্টে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু তা চোরাচালান হয়ে খোলাবাজারে ঢুকে পড়ায় সরকার একদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয় বস্ত্র খাত মুখ থুবড়ে পড়ছে। চোরাই বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তাদের হাজার হাজার টন কাড়প অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। অথচ রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন বন্ড কমিশনারেট দফতরের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।
জনৈক সরকারি কর্মকর্তা দু’দকের দু’জন মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের পুরো তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেন। সেখানে জনৈক আবুল বাশার রিপন, আক্তার হোসেন, হালিম, ওমর ফারুক, জয়নাল আবেদীনসহ আরও অনেকের নাম রয়েছে। এ চক্রের বেশ কয়েকজনের অঢেল অর্থসম্পদের গোপন তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয় দুদকে।
এছাড়া সেখানে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও ঢাকা বন্ড কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজন কমিশনার, ডেপুটি কমিশনারের নামও রয়েছে। ওই পদস্থ কর্মকর্তা দুদককে আরও জানিয়েছেন, এসব তথ্য গোপন রেখে একশ্রেণীর গণমাধ্যমকর্মী বন্ড কমিশনারেট দফতর থেকে বড় অঙ্কের মাসোহারা নিয়ে থাকেন। যে কারণে বন্ড চোরাকারবারিদের নিয়ে মাঝে মধ্যে রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়ে কোনো কিছু লেখা হয় না।
এদিকে এই কর্মকর্তার দেয়া বিশদ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রায় এক মাস ধরে দুদুকের কয়েকটি টিম বিশেষ অনুসন্ধানে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। সূত্র বলছে, ইতিমধ্যে কয়েকজনের বিষয়ে তারা ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে। যাদের যথাসময়ে নোটিশ করা হবে।
সূত্র বলছে, রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে থান কাপড় ও ডেনিমসহ বস্ত্রশিল্প খাতের নানা কাঁচামালের মার্কেট গড়ে উঠেছে। কয়েকটি বহুতল ভবনের কারপার্কিং থেকে শুরু করে ৫ তলা পর্যন্ত পুরোটাই কাপড়ে ঠাসা। প্রকাশ্যে দরদাম করে বিক্রি হলেও এর বেশির ভাগই শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা বন্ডের কাপড়। প্রতিদিন রাত ১২টার পর অবৈধ কাপড় বোঝাই ট্রাক বিভিন্ন কোম্পানির ওয়্যারহাউস থেকে সরাসরি ইসলামপুর ও সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে চলে আসে। এর মধ্যে সদরঘাটের বিক্রমপুর সিটি গার্ডেন মার্কেট অন্যতম। এখানে প্রায় ৬০ শতাংশ কাড়পই বন্ডেড সুবিধা নিয়ে আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
এছাড়া ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, কে হাবিবুল্লাহ মার্কেট ও ইসলাম প্লাজাতে এভাবে আনা ৮০ শতাংশ সুতা ও কাপড় বিক্রি হয়। ঢাকার বাইরে নরসিংদীর মাধবদী ও বাবুরহাটেও বন্ডের কাপড় বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বন্ড পণ্যের বড় মাপের চোরাকারবারির সংখ্যা দেড় শতাধিক। এদের নিয়ন্ত্রণে আবার একাধিক চোরাকারবারি গ্রুপ কাজ করে। যাদের প্রত্যেকটি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন করে। এসব গ্রুপের কাছে নিজস্ব কনটেইনারবাহী লরি, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রথম সারির কাপড় আমদানিকারক বলেন, কাপড়ভেদে কয়েকটি এসএস কোডে শুল্ক দিয়ে কাপড় আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে পেন্টিং ও শুটিং এসএস কোডে কাপড় আনতে প্রতি কেজিতে ডিউটি বা শুল্ক দিতে হয় ৩ ডলার ৭৫ সেন্ট। এই আইটেমকে উদাহরণ হিসেবে ধরলে একটি কনটেইনারে অফিসিয়ালি ২৫ টন কাপড় আনা যায়। ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা ডলার রেট ধরলে যার শুল্ক আসবে প্রায় ৮০ লাখ টাকা। যদিও আনঅফিসিয়ালি ৩০ টন করে কাপড় আনা হয়। কিন্তু এই কাপড় বন্ড সুবিধায় আনলে শুল্কের পুরো টাকা সাশ্রয় হয়। মূলত যার সুযোগ নিচ্ছে বন্ড অপব্যবহারকারী চক্র।
সূত্র জানায়, বন্ড অপব্যবহারকারীরা প্রতি কনটেইনার কাপড় ছাড়ানোর সময় কাস্টমস ও বন্ড কমিশনারেটের পেছনে ঘুষ বাবদ খরচ করে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এরপর ইসলামপুর পর্যন্ত আনতে ঘাটে ঘাটে আরও কিছু খরচ হয়। এভাবে সব খরচ বাদ দিলেও তারা প্রতি কনটেইনার কাড়প বিক্রি করে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা লাভ করে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু ইসলামপুরেই বছরে অন্তত ১০ হাজার কনটেইনার কাপড় আসে। এই কাপড়ে যে পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয় তাতে অন্তত দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এ কারণে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিষয়টি মনিটর করার জোর দাবি জানান তারা।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি এনবিআরের সার্ভার হ্যাক করে কয়েক হাজার কনটেইনার পণ্য খালাসের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ছাড় করা প্রায় ৪ হাজার বিল অব এন্ট্রি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ৪ হাজার কনটেইনার জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করা হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় দায়েরকৃত আসামিদের পক্ষে প্রভাবশালী মহল থেকে নানামুখী তদবির হচ্ছে। বিশেষ করে চাকলাদার সার্ভিসের মালিক অপু চাকলাদার ও এমআর ট্রেড ইন্টা লিমিটেডের মালিক মিজানুর রহমান চাকলাদার ওরফে দিপু চাকলাদার ছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অঘোষিত ডন। এদের মধ্যে মিজানুর রহমান চাকলাদারকে গ্রেফতার করা হলেও বেশিদিন কারাগারে আটকে রাখা যায়নি।
এখন তাদের বিরুদ্ধে যাতে চার্জশিট দেয়া না হয় তার জন্য প্রভাবশালী মহলে ব্যাপক তদবির চলছে। বিশেষ করে আসামি মিজানুর রহমান অপুর নাম যাতে কোনোভাবেই চার্জশিটে দেয়া না হয় সেজন্য সিআইডির একজন কর্মকর্তাকে কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাবও দেয়া হয়। সেই চেষ্টা সফল না হওয়ায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়। এরপর যা হওয়ার তাই হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি ডিপফ্রিজে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, বন্ডের কাপড় চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের হাত অনেক লম্বা। সমাজের অনেক প্রভাবশালীকে তারা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে রাখে। বিপদে পড়লে এসব মুখোশধারী প্রভাবশালী চোরাকারবারিদের পক্ষে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নামেন।