র্যাবে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনছে সরকার
বিশেষ প্রতিবেদকঃ মতপার্থক্য দূর করে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে ঢাকা ও ওয়াশিংটন। দু’পক্ষই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে ভিত্তি করে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রস্তুত। আর এর শুরুটি হবে র্যাবকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে সরকার। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, অবশ্যই আমরা সংস্কার করব, র্যাবের উৎকর্ষ অর্জনের জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আমরা। র্যাবের যে রুলস অব এনগেজমেন্ট- সেগুলো তো যুক্তরাষ্ট্রই আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে দিয়েছিল। যদি রুলস অব এনগেজমেন্টে পরিবর্তন চায় যুক্তরাষ্ট্র, তাহলে তাদের বাংলাদেশকে জানাতে হবে।
তিনি বলেন, বলতে হবে- এ জিনিসটি খারাপ, এ জিনিসটি ভালো। র্যাবকে বাংলাদেশের মানুষ পছন্দ করে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, র্যাব যদি কোনো অন্যায় করে, তবে তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অনেককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, র্যাবের বহু কর্মকর্তা শাস্তি পেয়েছেন, এমনকি ফাঁসির আদেশও হয়েছে।
মার্কিন পক্ষ থেকে গঠনমূলক প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ বিচার-বিশ্নেষণ করবে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, প্রস্তাবগুলো যদি মনে হয় আমাদের দেশের ও জনগণের জন্য মঙ্গল, তাহলে আমরা অবশ্যই সেটি গ্রহণ করব।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে গতকাল শনিবার দিল্লি থেকে ঢাকায় এসেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। এর আগে সফর করে গেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লাউবেখার। লাউবেখারের কাছে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য ঢাকার পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। এ সময় লাউবেখার র্যাবের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাহিনীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আরও যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন মার্কিন পরামর্শগুলোর বিষয়ে বেশ ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলে সূত্র জানায়।
আগে বিদেশিদের সমালোচনা করে বক্তব্য দিলেও সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের অনেক দুর্বলতা ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বক্তব্য দিয়েছিল। আমরা দেখেছি, সেখানে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আমরা সেগুলো সংশোধন করেছি।
এ সময়ে মানবাধিকার বা গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমরা খুবই ইতিবাচক। গত তিন বছরে আমার জানামতে, কোনো গুম হয়নি। এক সময় র্যাবের কিছু বাড়াবাড়ি ছিল। যার জন্য র্যাবের কয়েকশ লোকের প্রমোশন হয়নি বা তাদের শাস্তি হয়েছে। আমাদের পাঁচ আঙুল সমান নয়। কোনো কোনো লোক অসুবিধার সৃষ্টি করে। তবে এ বিষয়েও আমরা সজাগ।
গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে যে দূরত্ব ও উদ্বেগ রয়েছে, তা আমলে নেওয়া হচ্ছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক কূটনীতিক বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকারের মূলনীতি হচ্ছে বিশ্বে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের উন্নয়ন করা। এ নিয়ে বাংলাদেশে যে সমস্যা বিদ্যমান, তা দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকারের ধারায় ছিল ঢাকা। তবে নির্বাচনের আগে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র উন্নয়নের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত হয়েছে বাংলাদেশ। যা দুই দেশের সম্পর্ককে মসৃণ পথে এগিয়ে নেবে। এখন বাংলাদেশ তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এইলিন লাউবেখারের সঙ্গে বৈঠকে র্যাবের প্রসঙ্গে তাঁর ইতিবাচক মনোভাব সামনে এসেছে। আর এটি হচ্ছে ফলাফল। ফলাফল পেতে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে। আর সেই প্রতিশ্রুতির একটি হচ্ছে র্যাবের সংস্কার। এ কারণেই র্যাবের বিষয়ে মার্কিন পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব পাওয়া গেছে। ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বৈঠকে র্যাবের সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
ডোনাল্ড লুর সফর বেশ ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ হবে বলে প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। কারণ, এর আগে সদ্য সমাপ্ত মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লাউবেখারের সফর বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। লাউবেখারের সফরই ইঙ্গিত দেয়, ডোনাল্ড লুর সফর ফলপ্রসূ হবে। দু’দিনের সফরে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করবেন তিনি।
ডোনাল্ড লুর সফর নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, যে সমস্যার জায়গাগুলো রয়েছে, তা আরও গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিচ্ছি। যেমন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি আমরা প্রতি বৈঠকেই তুলে ধরি। সেই সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই সঙ্গে শ্রম অধিকারের বিষয়ে মাকির্নিদের সঙ্গে আমাদের একটি বোঝাপড়া হচ্ছে। এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র তার অগ্রাধিকার বিষয়গুলো তুলে ধরবে। আর বাংলাদেশও তার অগ্রাধিকার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবে।
লাউবেখারের সফর নিয়ে সচিব আরও বলেন, যে কোনো সম্পর্কে কিছুটা অমসৃণ পথ থাকতে পারে, তবে আমাদের যোগাযোগের মধ্যে থাকতে হবে বলে লাউবেখার তাঁর সফরে বলে গেছেন। সম্পর্ক উন্নয়ন ও অংশীদারিত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সাময়িক কিছু উদ্বেগ থাকতে পারে, এগুলো যাতে কোনোভাবেই মূল সম্পর্ককে প্রভাবিত না করে, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ডোনাল্ড লুর সফরে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও গণতন্ত্রের মতো বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আর ঢাকার পক্ষ থেকে র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার (জিএসপি) সুবিধা পুনর্বহাল, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীকে ফেরত নিয়ে আসাসহ একাধিক বিষয় আলোচনায় রাখা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা হচ্ছেন ডোনাল্ড লু। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিলেন তিনিই। পাকিস্তানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে ডোনাল্ড লুর হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এ অভিযোগ প্রকাশ্যে করেছিলেন ইমরান খান।