চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই লোকসান প্রায় ১৩ কোটি টাকা দূরদর্শিতার অভাবে লোকসান ডুবতে বসেছে বিআইডব্লিউটিসি
বিশেষ প্রতিবেদকঃ অর্থনৈতিকভাবে ডুবতে বসেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশন’ (বিআইডব্লিউটিসি)। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এ সংস্থার নিট লোকসান প্রায় ১৩ কোটি টাকা। প্রতি মাসেই লোকসানের বোঝা বাড়ছে। বিদায়ী অর্থবছরেও এ সংস্থাটির লোকসান ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। যদিও এর আগের বছর লাভ করেছিল প্রায় ২১ কোটি টাকা।
এদিকে লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকায় গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ঐতিহ্যবাহী নৌরুট ঢাকা-বরিশাল-মোড়েলগঞ্জে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি। ফেরি চলাচলও সীমিত করা হয়েছে। বেশ কিছু নৌযান বেসরকারি পর্যায়ে ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দূরদর্শী পরিকল্পনা নেওয়া ও বাস্তবায়নের অভাবে সংস্থাটির এমন করুণ অবস্থায় পড়েছে। ২৬ জুন পদ্মা সেতুতে গাড়ি চালুর পর ফেরি ও যাত্রীবাহী নৌযান কোথায় স্থানান্তর করা হবে সেই ব্যবস্থা আগে নেওয়া হয়নি। সংস্থাটির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ কার্যকরভাবে কাজে লাগানো হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সংস্থাটিকে আবার লাভে ফেরাতে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল ও বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজীর দ্বন্দ্ব ক্রমেই প্রকাশ্যে চলে আসা। এতেও সংস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সুরাহা হচ্ছে না।
সংস্থাটিতে প্রকৌশল অধিক্ষক হিসাবে নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এম মনিরুল ইসলামের নিয়োগ, গুলশান হাউজের জমিতে নির্দিষ্ট সময়ে ভবন নির্মাণে ব্যর্থ হওয়ায় মাল্টিপ্ল্যান লিমিটেড নামক ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল ও তিনটি বার্জ বিক্রি করাসহ কয়েকটি বিষয়ে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিসি পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া আহমদ শামীম আল রাজীর বেতনস্কেল গ্রেড-১ পাওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকায় আরও তিক্ততা তৈরি হয়েছে। এসব ঘটনার প্রভাব সামগ্রিকভাবে সংস্থাটির কার্যক্রমেও পড়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে ফোন করেও নৌসচিব মো. মোস্তফা কামালের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী জানান, নৌসচিবের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নেই।
প্রকৌশল অধিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের দুই ধরনের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কাছে মনে হচ্ছে সঠিক প্রক্রিয়ায় ওই নিয়োগ দিয়েছি। মন্ত্রণালয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসাবে আইনানুগ সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এর জবাবে আমরা কাগজপত্র পাঠাব। আশা করছি, তারা তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন।
তবে দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে বিআইডব্লিউটিসি লোকসানের মুখে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন আহমদ শামীম আল রাজী। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে ফেরি ও নৌযান বিকল্প কোন রুটে চলবে, সংস্থার আয় কিভাবে ঠিক রাখা যাবে সে বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়া যেত। দুঃখজনক হলেও সত্যি সেই কাজটি আগে করা হয়নি।
লোকসানের মুখে বিআইডব্লিউটিসি: নিজস্ব আয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় বহন করে আসছে বিআইডব্লিউটিসি। আয়ের সিংহভাগই আসত সংস্থাটির ছয়টি রুটের ফেরি সার্ভিস থেকে। ২৬ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ওই রুটে সংস্থাটির ১৮টি ফেরি চলাচল করত।
এছাড়া পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে গাড়ি চলাচল প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এ দুটি ফেরি রুটই মূলত সংস্থাটির আয়ের বড় অংশের জোগান দিত। এছাড়া ঢাকা-বরিশাল-মোড়েলগঞ্জ নৌরুটে যাত্রী সংখ্যা কমে প্রতি ট্রিপে একশর নিচে নেমে যায়। লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকায় ২২ সেপ্টেম্বর থেকে এ রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও সংস্থাটির বারো আউলিয়া, এলসিটি কাজলের মতো অনেক জাহাজ ভাড়া নিয়ে লাভে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত ব্যয়, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ার কারণে একদিকে খরচ বেড়েছে। অপরদিকে আয় কমেছে। ফলে লোকসান বাড়ছে। এছাড়া সংস্থাটিতে অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরেই সংস্থার আয়ের টাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খরচ বহন করা সম্ভব হবে না। তারা জানান, গাড়ি না থাকায় সংস্থার অনেক ফেরি বসে আছে। রোটেশন পদ্ধতিতে ফেরি চালানো হচ্ছে। এসব ফেরির জনবল অলস বসে থাকেন।
আরও জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংস্থাটি আয় করেছে ৮৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অপরদিকে জ্বালানি তেল ক্রয়, বেতন-ভাতা, জাহাজ মেরামত ও অফিস খরচ বাবদ ব্যয় করেছে ৯৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এ তিন মাসেই লোকসান ১২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ সাত কোটি ১১ লাখ টাকা লোকসান গুনে এ সংস্থাটি। অথচ এর আগে বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা লাভ করেছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯ কোটি ৯১ লাখ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা লাভ করে। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান গুনেছিল।
যদিও আয় বাড়াতে ৮টি রুটে ফেরি চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি রাজবাড়ীর ধাওয়াপাড়া-পাবনার নাজিরগঞ্জ রুটে ফেরি চালু করতে যাচ্ছে বিআইডব্লিউটিসি। সড়ক ও জনপথ এ রুটটি বিআইডব্লিউটিসিকে হস্তান্তর করেছে।
এছাড়া রৌমারী-চিলমারী (কুড়িগ্রাম), বামনা-বদনিখালী (বরগুনা), বগীবাজার-চালিতাতলী (বরগুনা), চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ, পানপট্টি-কোড়ালিয়া, নাজিরপুর-কালাইয়া এবং নোয়াখালী-ভোলা রুটে ফেরি চালু করতে সমীক্ষা করেছে।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী বলেন, নতুন ফেরি রুট চালুর পাশাপাশি হাওড় এলাকার উপযোগী নৌযান আনার পরিকল্পনা করছি। একইসঙ্গে বিদেশে কনটেইনার জাহাজ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঝুলে আছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় : জানা গেছে, নৌসচিব ও বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঝুলে আছে। এর একটি হচ্ছে-প্রকৌশল অধিক্ষক হিসাবে নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এম মনিরুল ইসলামের নিয়োগ। তাকে ১৩ নভেম্বর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সংস্থাটির পর্ষদ। ৮ ডিসেম্বর ওই নিয়োগ বাতিল করার জন্য সংস্থাটিকে চিঠি দিয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়।
পৃথক আরেক চিঠিতে এখতিয়ার ও বিধিবহির্ভূতভাবে ওই নিয়োগ দেওয়ায় সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ওই নিয়োগের ছাড়পত্র কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন থাকাবস্থায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনপত্র আহ্বান, যাচাই-বাছাই ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি।
আরও জানা গেছে, ৮ ডিসেম্বর ওই দুই চিঠি নৌমন্ত্রণালয় দিলেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বাতিল করেনি সংস্থাটি। উলটো ২১ ডিসেম্বর বিআইডব্লিউটিসির পর্ষদ বিশেষ সভা করে ওই নিয়োগ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একইসঙ্গে কর্মচারী চাকুরি প্রবিধানমালা, ১৯৮৯ এর ৯(২) ধারা অনুযায়ী সঠিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়কে জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, নির্ধারিত সময়ে সংস্থাটির গুলশানের অবস্থিত জমি উন্নয়ন ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে মাল্টিপ্ল্যান লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন বর্তমান চেয়ারম্যান। ওই প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে নৌসচিব সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবার বৈঠকও করেন। ওইসব বৈঠকে কিছু শর্তসাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতার সিদ্ধান্ত দেয় মন্ত্রণালয়। তবে বিআইডব্লিউটিসির শর্ত না মানলে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ সংস্থাটি।
এছাড়া বিবি-১১৩৫, বিবি-১১৪৬ ও বিবি-১১৪৮ নামক তিনটি পণ্যবাহী নৌযান দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির বিষয়ে সম্মতি দেয় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। একাধিক বৈঠকে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানকে এ জাহাজ দুটি নিলাম দেওয়ার জন্য তাগাদা দেওয়া হলেও তাতে সম্মতি দেননি চেয়ারম্যান। টেন্ডার ছাড়া ওই জাহাজ বিক্রি করা যাবে না বলেও সিদ্ধান্ত দেন তিনি। এ প্রক্রিয়ায় একটি জাহাজ বিক্রি হয়েছে। বাকি দুটি পড়ে আছে। একইভাবে আরও কয়েকটি বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিসির মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।