জনপ্রশাসনে ডিও লেটারের ছড়াছড়ি; বিধিবহির্ভূত ভাবে সবাই প্রমোশন চায়
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির সুপারিশ
ডিও লেটারের ছড়াছড়ি ‘এ ধরনের আধাসরকারিপত্র চালাচালি বিধিসম্মত নয়’ -আলী ইমাম মজুমদার
বিশেষ প্রতিবেদকঃ ডিও লেটারের ছড়াছড়ি প্রশাসনে। বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করে থাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)।
পদোন্নতি বিধিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে এ সুপারিশ করা হয়। এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পদোন্নতি চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এই সুপারিশের আগেই সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদ-সদস্য আধাসরকারিপত্র (ডিও বা ডামি অফিসিয়াল লেটার) দিচ্ছেন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মরত সচিবও এমন সুপারিশ করে থাকেন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অথবা একই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে দেওয়া হয় এসব ডিও লেটার। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ ধরনের আধাসরকারিপত্র চালাচালি সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত-এমন মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এতে প্রশাসনের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। নিরপেক্ষতা বাধাগ্রস্ত হয়। যোগ্য কর্মকর্তার পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে দেশপ্রেমিক দূরদর্শী কর্মকর্তাদের সেবা থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেন, ডিও লেটার তারা দিতেই পারেন। তাদের করা সুপারিশ রাখব কিনা-তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার।
সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য যেসব ডিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-গত ২১ এপ্রিল রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ওই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমানকে সচিব করার জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে আধাসরকারিপত্র দেন।
গত ৭ জুলাই পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান প্রধান নিয়ন্ত্রক আমদানি ও রপ্তানি শেখ রফিকুল ইসলাম, ১৮ মে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী এবং ২০ মে মো. মিজানুল হক চৌধুরীকে সচিব করার জন্য ডিও দিয়েছেন। গত বছর ২২ আগস্ট আবু বকর সিদ্দিক এনডিসিকে সচিব হিসাবে নিয়োগের জন্য আধাসরকারিপত্র দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।
গত ১ জুন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সাবেক চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারকে গ্রেড-১ (সচিব) পদমর্যাদা দেওয়ার জন্য আধাসরকারিপত্র দিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম। গত ৬ মার্চ মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মুহাম্মদ আব্দুল হান্নানকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য আধাসরকারিপত্র দিয়েছেন।
এছাড়া গত ৮ মার্চ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. আলিম উদ্দিনকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজমকে পত্র দিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। গত ১ আগস্ট প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের উপসচিব কাজী মোখলেছুর রহমানকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য ডিও দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার গণমাধ্যমে বলেন, এ ধরনের আধাসরকারিপত্র চালাচালি বিধিসম্মত নয়। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, এ ধরনের আধাসরকারিপত্র চালাচালি প্রশাসনে খারাপ নজির। এগুলোর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এতে প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। ফলে নিরপেক্ষতা বিনষ্ট হয়। মেধাবী, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ ধরনের পক্ষপাতমূলক আধাসরকারিপত্র দেওয়া ঠিক নয়। দলকানা অফিসারদের জন্যই এ ধরনের সুপারিশ করা হয়। এতে নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। প্রশাসন নানাভাবে প্রভাবিত হয়।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে পদোন্নতির জন্য পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২ কার্যকর আছে। এটি অনুসরণ করেই এসএসবি পদোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে থাকে। এছাড়া সম্ভাব্য পদোন্নতির জন্য প্রাথমিক ভাবে তালিকায় স্থান পাওয়া কর্মকর্তাদের চাকরি জীবনের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত নানা মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যাপারে নেতিবাচক কোনো কিছু থাকলে অথবা বিভাগীয়সহ অন্য কোনো মামলা চলমান থাকলে, ওই কর্মকর্তাকে বিবেচনায় আনা হয় না। এক্ষেত্রে পদোন্নতি বিধিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সব ধরনের যোগ্যতা থাকলেও তাকে বাদ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২-এ বলা হয়েছে, সচিব পদে পদোন্নতি পেতে হলে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে কমপক্ষে দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে অতিরিক্ত সচিব পদে কমপক্ষে এক বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো কর্মকর্তার ওই পদে দুই বছর পূর্তির আগেই তার বয়স ৫৯ বছর হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তার ক্ষেত্রে দুই বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা শিথিলযোগ্য হবে।
সচিবালয়ে কোনো পদে পাঁচ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে অতিরিক্ত ও যুগ্মসচিব পদে দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলে তার ক্ষেত্রে এই শর্ত শিথিলযোগ্য হবে। মূল্যায়ন নম্বর কমপক্ষে ৮৩ হতে হবে। তবে শূন্য পদে পদোন্নতির জন্য উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে ৮৩ নম্বর পাওয়ার শর্ত শিথিলযোগ্য হবে।
বিধিমালা অনুযায়ী, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য প্রত্যেক কর্মকর্তার মূল্যায়নের নির্ধারিত মোট নম্বর ১০০। এক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়, সেগুলো হচ্ছে-শিক্ষাগত যোগ্যতার নম্বর ২৫, গত পাঁচ বছরের বার্ষিক বা গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় ৩০, চাকরির শুরু থেকে গত পাঁচ বছরের পূর্ব পর্যন্ত সব বছরের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় ২৫, সামগ্রিক চাকরি জীবনে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকার জন্য বোনাস ১০ এবং সামগ্রিক চাকরি জীবনে কোনো শাস্তি না থাকার জন্য ১০ নম্বর।
এছাড়া বিধিমালায় আছে, উপসচিব পদে ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পাবে। অন্যান্য ক্যাডারের সিনিয়র স্কেলপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ২৫ শতাংশ উপসচিব পদে পদোন্নতি পাবে। যুগ্মসচিব পদে ৭০ শতাংশ কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পাবেন। অন্য সব ক্যাডারের উপসচিব পদে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৩০ শতাংশ যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পাবে।
অনুরূপভাবে অতিরিক্ত পদে ৭০ শতাংশ কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পবে। অন্যান্য সব ক্যাডারের যুগ্মসচিব পদে কর্মরতদের মধ্য থেকে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পাবে।