অনিয়ম ও দূর্নীতি বরপুত্র নির্বাহী প্রকৌশলী! কাজ না করেই ১৭ কোটি টাকা বিল,অবহেলা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের
বিশেষ প্রতিবেদকঃ চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করলেও ঠিকাদারকে ১৭ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। আর বিল পরিশোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আয়কর, ভ্যাট ও জামানত বাবদ তিন কোটি ১৮ লাখ টাকা কর্তন দেখানো হলেও সংশ্লিষ্ট খাতে জমা না করে ব্যাংক থেকে উত্তোলনের মাধ্যমে তা আত্মসাৎ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পাদন না করায় কাজ বাতিল করা হলেও চুক্তির শর্ত মোতাবেক অবশিষ্ট কাজের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় না করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাত কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
বাতিল করা কাজের জন্য আরোপ করা লিকুইডেটেড ড্যামেজেস ও অতিরিক্ত খরচের টাকা আদায় না করায় ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটি বিষয়টি যাচাইবাছাই করছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জয়নগর আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের ২ নং ভবন এবং ১০০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের ভবন নির্মাণ করার জন্য মেসার্স প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু উক্ত ঠিকাদার চুক্তি মোতাবেক যথাসময়ে কাজ না করায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চুক্তি বাতিল করে। চুক্তি বাতিলের পর ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সম্পাদিত ও অসম্পাদিত কাজের চূড়ান্ত পরিমাপ ও হিসাব নির্ধারণ করা হয়।
সেই প্রকল্পের ক্যাশবুক ও ব্যাংক বিবরণী থেকে দেখা যায় যে, উক্ত ঠিকাদার কোনো প্রকার বিল দাখিল করেননি ও কাজ সম্পাদনের সপক্ষে কোনো মেজারম্যান্ট বুক (এমবি) সংরক্ষণ করা হয়নি। অথচ কাজ সম্পাদন ব্যতীত নির্বাহী প্রকৌশলীর একক স্বাক্ষরে হিসাবরক্ষকের স্বাক্ষর ছাড়াই চেকের মাধ্যমে ঠিকাদারকে ১৭ কোটি ১৯ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৭ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
বিল পরিশোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আয়কর, ভ্যাট ও জামানত বাবদ তিন কোটি ১৮ লাখ টাকা কর্তন দেখানো হলেও সংশ্লিষ্ট খাতে জমা না করে ব্যাংক থেকে উত্তোলনের মাধ্যমে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ফলে কাজ না করেই সরকারের ২১ কোটি ২৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাশ বুকে প্রত্যয়ন রয়েছে, বেসিক ব্যাংক লিঃ, মিরপুর শাখা হিসাব নং এসএনডি ২২১৬-০১-০০০০৮৪৮-এর জন্য এই ক্যাশবুক খোলা হলো। চেকের টাকা বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের উক্ত হিসাব থেকে ডেবিট হয়েছে। কিন্তু ইস্যু করা চেক উক্ত বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের ছিল না। এই চেকের টাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকার প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চ এসএনডি ০০২৩২০০০০০০৯২ হিসাব থেকে ডেবিট হয়েছে। এই হিসাব বর্তমানে চালু নেই। এই ব্যাংক হিসাবটি কেন খোলা হলো এ সব তথ্য নিরীক্ষা দলকে সরবরাহ করা হয়নি। এই ব্যাংক হিসাবের সমর্থনে ক্যাশ বুক, চেক রেজিস্টার মেইনটেইন করা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে বেসিক ব্যাংকের হিসাব ডেবিট করে কোনো কারণ ব্যতীত কমার্স ব্যাংকের হিসাব ক্রেডিট করা হয়েছে। এই লেনদেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিফ আহমেদ এককভাবে সম্পাদন করেছেন। কাজ সম্পাদন ও বিল দাখিল ব্যতীত অর্থ প্রদান করায় ট্রেজারি রুলের সাবসিডিয়ারি রুলস (এস,আর) ২৪৯ ও ৪২৯ লঙ্ঘিত হয়েছে।
এ বিষয়ে জবাব চেয়ে ২০২১ সালের ১৮ মার্চ অডিট বিভাগ থেকে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে তাগিদপত্র পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কাজ সম্পাদন ব্যতীত অতিরিক্ত অর্থ ঠিকাদারকে প্রদান করায় এই সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে আদায় করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধীন নির্বাহী প্রকৌশলী, ঢাকা ডিভিশন-১, মিরপুর, ঢাকা অফিস কর্তৃক স্বপ্ননগর আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প কাজের জন্য ঠিকাদার মেসার্স কনসোডিয়াম অব জেভিইএল-এসএসএলের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তিমূল্য ২৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। চুক্তি মোতাবেক ঠিকাদার যথাসময়ে কাজ সম্পাদন না করায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি চুক্তি বাতিল করা হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য অসমাপ্ত কাজের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে এডিশনাল কস্ট ঠিকাদারের কাছ থেকে আদায়যোগ্য। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদন মোতাবেক কাজের চুক্তি বাতিলকালীন মাত্র ১ শতাংশ কাজ সম্পাদিত হয়েছিল। ফলে ঠিকাদারের কাছ থেকে সাত কোটি ৫৯ লাখ টাকা আদায় করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
একই ভাবে নির্বাহী প্রকৌশলী ঢাকা ডিভিশন-২-এর অধীনে মোহাম্মদপুরে সীমিত আয়ের লোকদের জন্য ১০২০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে ঠিকাদাররা চুক্তি মোতাবেক কাজ সম্পাদন না করায় চুক্তি বাতিল করলেও লিকুইডেটেড ড্যামেজেস ও এডিশনাল কস্টের অর্থ আদায় না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি রুস্তম আলী ফরাজী জানান, সংসদীয় কমিটিতে এ ধরনের অনেক আর্থিক অনিয়মের তথ্য সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা প্রতিবেদন এসেছে। এগুলো যাচাইবাছাই করে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জড়িতদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের সুপারিশ করা হবে।