বরিশালে অবৈধ ইটভাটা – পরিবেশ দূষণ; উর্বরতা হারাচ্ছে কৃষিজমি; ঝুঁঁকিতে খাদ্যনিরাপত্তা
অপরাধ প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশের প্রায় ৮ হাজার ইটভাটায় বছরে পোড়ানো হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ কোটির বেশি ইট। এর মধ্যে ২ হাজারের মতো ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। বিপুল পরিমাণ কাঠের জোগান দিতে গিয়ে বিলীন হচ্ছে বনভূমি। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ। দূষিত হচ্ছে বায়ু। একই সঙ্গে এসব ইটভাটায় মাটির জোগান দিতে গিয়ে উর্বরতা হারাচ্ছে কৃষিজমি। হুমকির মুখে খাদ্যনিরাপত্তা। সারাদেশের মত বরিশালেও অবৈধ ইটভাটার বিস্তার ঘটেছে; যার সাথে সরাসরি প্রশাসনের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বর্তমান সরকার ইটের ব্যবহার কমিয়ে ব্লকের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও তা গতি পাচ্ছে না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে সরকারি নির্মাণকাজে শতভাগ ব্লক ব্যবহার নিশ্চিত করা ও পর্যায়ক্রমে বেসরকারি নির্মাণকাজেও ব্লকের ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার। সে কারণে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ইটভাটা স্থাপনে নানা বিধিনিষেধ দেওয়ার পাশাপাশি ব্লক নির্মাণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে প্রচারণার অভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না ব্লক। কমছে না ইটভাটার সংখ্যা।
উল্টো আইনকে পাশ কাটিয়ে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে ইটভাটা। ইট প্রস্তুতকারকদের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে ৭ হাজার ৯০২টি ইটভাটার কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ২০০ ইটভাটাই অবৈধ। এর মধ্যে ২ হাজারের বেশি ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
সহজলভ্যতার কারণে কাঠের ব্যবহার এখনো বেশি হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের ইটভাটাগুলোয়।
এর মধ্যে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী, ঘাটাইল; ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে রসুলপুর; চট্টগ্রামের রাউজান, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, চকরিয়া ও হাটহাজারী উপজেলা; রাজবাড়ীর খানখানাপুর, গোয়ালন্দ, পাংশা ও কালুখালী; ফরিদপুরের মধুখালী, আলফাডাঙ্গা; ঢাকার সাভার ও আশুলিয়া এবং গাজীপুর জেলার অনেক ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
বরিশাল বিভাগের প্রায় প্রতিটি জেলায় অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এসব অবৈধ ইটভাটার সাথে জড়িত সরকারী কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যাক্তি, স্থানীয় অসাধু ইটব্যবসায়ী।
সারাদেশের বিভিন্ন ইটভাটার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটা ভাটায় ইট পোড়াতে দৈনিক ২০০ মণ কাঠ দরকার হয়। সেই হিসাবে সারা দেশে ২ হাজার ইটভাটায় দৈনিক ১৬ হাজার টন কাঠের প্রয়োজন হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আর্কাডিসের যৌথ গবেষণার তথ্য বলছে, বিশ্বের ৭৫ শতাংশ ইট এশিয়ার পাঁচটি দেশ তৈরি করে।
চীন ৫৮ শতাংশ, ভারত ১২ শতাংশ, পাকিস্তান ২.৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম ১.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ১ শতাংশ ইট উৎপাদন করে থাকে।
এদিকে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অধিকাংশ দিন ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরীর তালিকায় শীর্ষে থাকছে। এর পেছনে ইটভাটাকে দায়ী করা হচ্ছে। গত ৩১ অক্টোবর ব্র্যাক সেন্টারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা সিমেন্টের ব্লক ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, ঢাকা শহরের ৫৬ শতাংশ বায়ুদূষণ হচ্ছে ইটভাটার কারণে। এ ছাড়া রাস্তার ধুলাবালির কারণে ১৮ শতাংশ ও যানবাহনের কারণে দূষণ হচ্ছে ১০ শতাংশ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১৫ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ইটখোলা থেকে নির্গত হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশছে।
বাংলাদেশের মোট কালো ধোঁয়ার সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ নির্গমন করছে ইটভাটা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ কালো ধোঁয়া নির্গমন করছে যানবাহন। পরিবেশ দূষণের কারণে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারও ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ করেছে ২০১৩ সালে। ২০১৯ সালে এই আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করে ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক কারখানাকে উৎসাহিত করা হয়।
আইনে বলা হয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা অর্থাৎ জিগজ্যাগ ক্লিন, হাইব্রিড হফম্যান ক্লিন, ভার্টিক্যাল শফট ক্লিন, টানেল ক্লিন বা অনুরূপ উন্নততর কোনো প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে।
তাছাড়া আবাসিক, জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকার বনভূমি ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা করা যাবে না। এ ছাড়া সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে করতে হবে। পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বা লাইসেন্স না নিয়ে ইটভাটা চালু করা যাবে না। আর এ আইন অমান্য করলে ১০ বছরের কারাদ ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
তবে অধিকাংশ ইটভাটা মালিক এসব আইনের তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দেদার তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ইটভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। বরিশাল বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। গতমৌসুমেও তিনি অবৈধভাবে লেনদেন এর মাধ্যমে অনেক নিবন্ধন দিয়েছেন। যা সরকারি এবং বেসরকারি তদন্তে উঠে আসে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সনাতন ইটভাটা কেবল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এর ফলে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে।
ইট তৈরিতে প্রতি বছর ১২৭ কোটি সিএফটি মাটি প্রয়োজন হচ্ছে। আইনে বিধি-নিষেধ থাকলেও কৃষিজমি, জলাশয় এবং নদী থেকেই নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাটি।
উপরিভাগের মাটি দিয়ে ইট তৈরি করায় উর্বরতা হারাচ্ছে কৃষিজমি। এতে হুমকিতে পড়ছে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা। একইভাবে নির্বিচারে গাছ কাটার কারণে বন উজাড় হচ্ছে, হচ্ছে ভূমিধস, ভাঙন ও মাটি ক্ষয়।