চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি, রাঘব-বোয়ালরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে – টিআইবি
বিশেষ প্রতিবেদকঃ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নামে শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। আর রাঘব-বোয়ালরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। কারণ প্রভাবশালীদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দুর্নীতির মূল হোতারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। এসবের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) এক ভার্চুয়াল সভায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সদস্যদের ঘোষণাপত্রে এসব বক্তব্য উঠে আসে।
সভায় সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চলমান বন্যায় বিশাল মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারের প্রত্যাশিত প্রস্তুতি ও সাফল্য দেখাতে না পারা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের জীবন-মানের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা পালন না করে উল্টো গণমাধ্যমের ওপর চাপ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ‘প্রেস কাউন্সিল আইন-২০২২’ এর খসড়া তৈরি, বিনা শর্তে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার সুযোগ দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি।
ভার্চুয়াল সভায় টিআইবির সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪৭ সদস্য অংশগ্রহণ করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন টিআইবির সাধারণ পর্ষদে সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী।
ঘোষণাপত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনের পাশাপাশি সম্প্রতি ‘প্রেস কাউন্সিল (সংশোধন) আইন, ২০২২’-এর খসড়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তথা সব নাগরিকের বাক স্বাধীনতা চর্চার ক্ষেত্রে দেশে অভূতপূর্ব উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
বলা হয়, খসড়ায় ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ইত্যাদি ক্ষুণ্ণ বা ভঙ্গের দায়ে অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে’। এর ফলে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের জীবন-মানের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা পালন না করে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে আরো সংকুচিত করার ভূমিকায় প্রেস কাউন্সিল তৎপর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অন্যদিকে, রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মের খসড়ার কয়েকটি ধারা সংবিধান পরিপন্থী। যেখানে আইনের কয়েকটি ধারা ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় জনগণের কণ্ঠরোধে ব্যবহৃত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এছাড়া, খসড়া ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২’ নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে, যা ব্যক্তি-তথ্য গোপনীয়তা ও সুরক্ষার নামে ব্যক্তির নিরাপত্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সর্বোপরি প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যম (চাকরির শর্তাবলী) আইন, ২০২১’ এ গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সদস্যরা।
নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক করা, সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র, আচরণ, আকার এবং গঠন কী হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সদস্যরা।
দেশের অর্থনীতি সচল রাখা, সরকারি ব্যয়ে সংকুলান এবং বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করার যুক্তিতে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে ফেরত আনতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান সংযোজনের অভূতপূর্ব অনৈতিক এক প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক, সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। এ জাতীয় দুর্নীতি-সহায়ক সুযোগ দেওয়া বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের মূলনীতি পরিপন্থী। অবিলম্বে এ সুযোগ বাতিল করে অর্থপাচারকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান তারা।
করোনাকালে ও পরবর্তী সময়ে পরিবার-সমাজে অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অর্থাৎ ধর্ষণ, বিবাহবিচ্ছেদ, পারিবারিক সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, পাচার, অপহরণ ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। নারী নির্যাতনের বেশিরভাগ ঘটনায় দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব বা ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মামলার বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের বিপরীতে ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের অঙ্গীকারকে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে দুর্নীতি। ঘোষণাপত্রে এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সদস্যরা নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানান।