প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গোয়েন্দা প্রতিবেদন
পাইলট নিয়োগে ফের কেলেঙ্কারি বিমানে –
নিয়োগ পেলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি পরিবারের এক সদস্য, বিদেশি এয়ারলাইন্সের ট্রেনিংয়ে ফেল করা অযোগ্য ও অনভিজ্ঞরা।
অপরাধ প্রতিবেদকঃ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ১৪ পাইলট নিয়োগের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছে বিমান। অভিযোগ উঠেছে-মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নিয়োগকৃত এসব পাইলটের অধিকাংশেরই বিমান চালানোর ভালো অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা নেই। আট পাইলটের মধ্যে দুইজনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। ১৪ জনেরই বিরুদ্ধে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ট্রেনিংয়ে ফেল, দুর্ঘটনা ঘটানো এবং চাকরিচ্যুত হওয়ার অভিযোগ আছে। নিয়োগকৃত এক কো-পাইলট (ফার্স্ট অফিসার) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি পরিবারের সদস্য। যাত্রী কেবিনে কার্গো পণ্য বহন করে বিমানের ৮ এয়ারক্রাফটের ভয়াবহ ক্ষতির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের এক প্রভাবশালী সদস্য নিয়োগ পেয়েছেন কো-পাইলট হিসাবে।
কার্গো পণ্য পরিবহণের জন্য সিন্ডিকেট যে কোম্পানি গঠন করেছিল তার অফিসিয়াল সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ছিলেন ওই কো-পাইলট। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এসব ভয়াবহ তথ্য। এ ঘটনায় বিমানের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকেও এ ঘটনায় বিমানের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের নিয়োগ যে কোনো এয়ারলাইন্সের জন্য বিশেষত রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার-যেখানে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ভ্রমণ করেন, সেই বিমানের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, বিশ্বের ৯৫ শতাংশ ক্র্যাশের জন্য দায়ী পাইলটরা। টেকনিক্যাল কারণে নয়। কাজেই পাইলট নিয়োগে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজের সুযোগ নেই। বিমানের এই নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট তদন্ত করে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সঠিক দিক বিবেচনা করে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। ২৫০ থেকে ৩০০ টনের একটি বিমান যাত্রী নিয়ে আকাশে উড়ছে, সেখানে অদক্ষ পাইলট নিয়োগ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
এদিকে চূড়ান্ত নিয়োগের আগেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ আট পাইলট ও ছয় কো-পাইলট মিলিয়ে ১৪ জনকে প্রশিক্ষণের (সিমুলেটর) জন্য থাইল্যান্ড পাঠিয়েছে। বিমানের প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রশিক্ষণে পাঠানো নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, পাইলট ও কো-পাইলট পদে প্রাথমিক ভাবে ১৪ জনকে চূড়ান্ত করা হয়। তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। বর্তমানে বিমানের অর্থে ব্যাংককে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে চূড়ান্ত ভাবে নিয়োগ পাবেন। তিনি বলেন, এ নিয়োগ নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিমানের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বিমানবহরে বোয়িং ৭৭৭-এর ক্যাপ্টেন হওয়ার যোগ্য অনেক পাইলট থাকলেও তাদের প্রমোশন না দিয়ে বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাছাড়া বোয়িং ৭৭৭-এ ফার্স্ট অফিসার সংকট থাকলেও পাইলট সংকট নেই।
বিমানের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক ভাবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা একসময় বিমানে কর্মরত ছিলেন। অর্থের লোভে তারা বিমানের চাকরি ছেড়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে চলে যান। এরপর সেসব এয়ারলাইন্সের ট্রেনিংয়ে পাশ করতে না পেরে বহিষ্কার হয়ে ফের বিমানে নিয়োগ নেন। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে-অফার লেটারে নিয়োগকৃতদের আগের (আগে যখন বিমানে কর্মরত ছিলেন) সিনিয়রিটি অনুযায়ী যোগদান করতে বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যদি কোনো কারণে তারা চলে যেতে চান তাহলে মাত্র তিন মাসের নোটিশে চলে যেতে পারবেন বলেও অফার লেটারে বলা আছে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে আসা গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়োগকৃত শাহ নাসিমুল আউয়াল ১২ বছর ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজে কো-পাইলট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে কয়েকবার ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেননি। পরে ক্যাপ্টেন হতে পারবেন না মর্মে মুচলেকা দিয়ে কো-পাইলটের কাজ চালিয়ে যান।
সাদিয়া আহমেদ নাতাশার চাকরি শুরু হয় জিএমজি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু হিসাবে। পরে ইউএস-বাংলা ও রিজেন্ট এয়ারলাইন্সে ফার্স্ট অফিসার হিসাবে নিয়োগ পান। বিমান চালনায় নানা ত্রুটির কারণে তিনি চাকরিচ্যুত হন। ২০১৬ সালে রিজেন্ট এয়ারলাইন্সে ফার্স্ট অফিসার থাকাকালে পজিশনে গিয়েও যথাসময়ে টেকঅফ করতে পারেননি। অথচ ওই অবস্থায় টেকঅফ করা বাধ্যতামূলক। টেকঅফ করতে না পারায় রানওয়ের কার্যক্রম দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকে। অভিযোগ রয়েছে, ইস্তাম্বুলে ইনিশিয়াল সিমুলেটর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। পরে সিমুলেটর সেন্টার জাকার্তায় পরিবর্তন করে তাকে কোয়ালিফাই করিয়ে আনা হয়।
ক্যাপ্টেন হারুন ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজে কো-পাইলট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। গত ৫ বছর তিনি কোনো ফ্লাইট পরিচালনা করেননি। পাইলট হওয়ার জন্য কয়েকবার পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হন। তার বয়স ৬০ বছরের বেশি।
ক্যাপ্টেন হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন আরেক বৈমানিক মারুফ। দীর্ঘদিন এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ফার্স্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত থাকলেও তিনি ক্যাপ্টেন প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
ক্যাপ্টেন হিসাবে নিয়োগ পাওয়া আরেক বৈমানিক এরফানুল হকও কাতার এয়ারওয়েজে ক্যাপ্টেন প্রশিক্ষণে তিনবার অকৃতকার্য হন। তাকেও ক্যাপ্টেন হিসাবে অযোগ্য ঘোষণা করে স্থায়ীভাবে ফার্স্ট অফিসার হিসাবে রাখে কাতার এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ।
ক্যাপ্টেন হোসেন মো. শওকত জাহান কাতার এয়ারওয়েজ ক্যাপ্টেন প্রশিক্ষণে তিনবার ব্যর্থ হন। তাকে ক্যাপ্টেন হিসাবে পদোন্নতি না দিয়ে স্থায়ীভাবে ফার্স্ট অফিসার হিসাবে রাখে কাতার এয়ারওয়েজ। এমনকি প্রশিক্ষণে তিনবার অকৃতকার্য হওয়ায় ভবিষ্যতে ক্যাপ্টেন হিসাবে পদোন্নতির জন্য আবেদন করার সুযোগও হারান এই বৈমানিক।
জানা যায়, নিয়োগ পাওয়া সাদিয়ার স্বামী বিমানের একজন প্রভাবশালী ক্যাপ্টেন। তার নাম সাজিদ আহমেদ। নিয়োগকালীন তিনি বিমানের চিফ অব টেকনিক্যাল ছিলেন, বর্তমানে তদবির করে চিফ অব ট্রেনিং পদ বাগিয়ে নেন। এতে নিয়োগ পাওয়া স্ত্রীকে সব ধরনের ট্রেনিংয়ে পাশ করাতে সুবিধা হয়। এছাড়া তিনি পাইলট নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানের এই নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বিমানের সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) জিয়া উদ্দিন আহমেদ, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল, পরিচালক (প্ল্যানিং) মাহবুব জাহান খান, সাবেক পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন ইসমাইল ও চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদ।
অভিযোগ আছে ক্যাপ্টেন সাজিদ চিফ অব ট্রেনিং নিয়োগ পেয়েই অনৈতিক ভাবে অবসরে যাওয়ার পরও ২ কোটি টাকা খরচ করে ক্যাপ্টেন ইসমাইল ও ক্যাপ্টেন তোফায়েল আহমেদকে ট্রেনিং করিয়ে আনেন। পুরস্কার হিসাবে ক্যাপ্টেন ইসমাইল নিজে সাজিদের স্ত্রী সাদিয়াকে সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে পাশ করিয়ে আনেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একজন পর্যদ সদস্য বলেন, সিন্ডিকেট কৌশলে নিয়োগ বোর্ডের কয়েকজন সদস্য ও পরিচালনা পর্যদকে ভুল তথ্য দিয়ে ও পাইলট সংকটের অজুহাত দেখিয়ে এই নিয়োগ চূড়ান্ত করে নেয়। এটা কেউ টের পায়নি তখন।
জানা যায়, এর আগেও পাইলট নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। ওই অভিযোগে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ ও তৎকালীন ডিএফও ক্যাপ্টেন জামিল আহমেদ চাকরি হারান।