সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

PicsArt_08-29-04.09.54.jpg

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
জড়িত অন্যদেরও আইনের আওতায় আনা হবে

সাগর চৌধুরীঃ বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) ও তার ভাই অনন্ত কুমার সিনহার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার বা প্রায় ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা (১ ডলার ৯০ টাকা ধরে) ক্যাশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে (১৭৯, জ্যাপার স্ট্রিট, প্যাটারসন নিউ জার্সি ০৭৫২২) তিনতলা বাড়ি কেনায় এ মামলাটি করা হয়। মানি লন্ডারিং আইনের এ মামলায় এসকে সিনহা ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন অবৈধভাবে ওই অর্থ অর্জন এবং তা যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) এ মামলাটি করা হয়। দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

মামলার পর দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি থাকাকালে বিভিন্নভাবে অবৈধ টাকা অর্জন করেছেন। আর ওই টাকা তিনি হুন্ডিসহ বিভিন্ন কায়দায় যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন। তিনি তার ছোট ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে (হিসাব) টাকা স্থানান্তর করেন। এ অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলাটি করা হয়েছে। মামলায় সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও তার ভাইকে আাসমি করা হয়েছে। তদন্তে আরও যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

তিনি বলেন, ‘দুদকের মামলার আসামি পলাতক থাকলেও মামলার তদন্তে ও বিচারের ক্ষেত্রে কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা নেই।’ এসকে সিনহাকে দেশে ফেরতের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, ‘মামলা করা হলো। তদন্ত কর্মকর্তা প্রয়োজন অনুসারে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।’

মামলার এজাহারে বলা হয়, অনন্ত কুমার সিনহা বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছোট ভাই। অনন্ত কুমার সিনহার যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যালি ন্যাশনাল ব্যাংক, প্যাটারসন, নিউজার্সির অ্যাকাউন্ট নং ৮৫৮০৩৩৭৫-এ (২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ২০ জুন পর্যন্ত সময়ে) ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৮ ডলার জমা হয়। ওই অর্থ রয় এ গ্রুপের থেকে পেয়েছে। ওই গ্রুপের কানাডার টরেন্টোর যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেটি একটি বার্গারের দোকান, যা প্রকৃতপক্ষেই একটি সেল কোম্পানি। বিএফআইইউ-এর গোয়েন্দা প্রতিবেদনসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার রেমিটেন্ডি এশিয়া মানডিরি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ মে পুনরায় অনন্ত কুমার সিনহার হিসাবে কিছু অর্থ ক্রেডিট হয়। ওই রেকর্ডে অনন্ত কুমার সিনহার নন রেসিডেন্সিয়াল ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে এবং যিনি ডলার প্রেরণ করেছেন, তার ঠিকানাও সন্দেহজনক। প্রকৃতপক্ষে সন্দেহজনক আন্তর্জাতিক ট্রানজেকশন থেকে অনন্ত কুমার সিনহা মোট ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৭ দশমিক ৮৬ ডলার তার নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে সংগ্রহ করেন। ওই অর্থ থেকে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৯০ ডলারের ক্যাশিয়ার চেক সংগ্রহের জন্য অনন্ত কুমার সিনহা তার বড় ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যালি ন্যাশনাল ব্যাংকে আসেন। ভ্যালি ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ওই অর্থের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটারসন এলাকায় একটি বাড়ি ক্রয়ের জন্য তিনি বন্ধুর কাছ থেকে ফান্ড পেয়েছেন। অর্থাৎ, বন্ধু তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্যাটারসন এলাকায় বাড়ি ক্রয়ের অর্থ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো বন্ধু কেন তাকে ফান্ড দিল, সে বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

বিএফআইইউ-এর গোয়েন্দা প্রতিবেদনসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে আরও জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ডিপোজিটরি প্রতিষ্ঠান অনন্ত কুমার সিনহার ওই অর্থ লেনদেন সন্দেহজনক মর্মে রিপোর্ট করেন। অনন্ত কুমার সিনহা ইন্দোনেশিয়া থেকে আন্তর্জাতিক বার্তা পান যে, ২০১৮ সালের ৫ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত সময়ে মোট ৬০ হাজার ১০ ডলারে অফিশিয়ার ব্যাংক চেক (ওবিসি) ক্রয়ের জন্য ফান্ড দেওয়া হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট করা পর্যন্ত ওই ব্যাংক চেক নেগোসিয়েট হয়নি এবং ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ফান্ডটি আটকিয়ে রাখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক সিস্টেম বিশ্লেষণে দেখা যায়, অনন্ত কুমার সিনহা একজন ডেন্টিস্ট এবং তার ব্যক্তিগত চেকিং হিসাব নম্বর ১৩৩১৭৮০৬৮০। এটি ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ খোলা হয়। আর সেফ ডিপোজিট বক্স হিসাব নম্বর ০১০১০০৭২০০০৩৪১১২২। এটি একই তারিখে খোলা হয়। ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২৫ মে পর্যন্ত সময়ে লেনদেনের তথ্যাদি বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুটি অফিশিয়াল ব্যাংক চেক (ওবিসি) অ্যাকাউন্ট নং ১৩৩১৭৮০৬৮৯ থেকে ক্রয় করা হয়, যেটি অনন্ত কুমার সিনহার নামে প্রদেয়। একটি ওবিসি ২০১৮ সালের ৫ মার্চ ৫০ হাজার ডলারে এবং অপরটি একই বছরের ২১ মার্চ ১০ হাজার ডলারে ক্রয় করা হয়।

ওই ওবিসিগুলো ডেবিট কার্ড, সুইপ ও পিন এন্ট্রি দ্বারা ক্রয় করা হয়। অনন্ত কুমার সিনহা ওই ফান্ডগুলো উইথহেল্ড করে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি কেন ইচ্ছাকৃত উই ফান্ডগুলো উইথহেল্ড করেছেন, তা সন্দেহজনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। অনন্ত কুমার সিনহার ব্যক্তিগত চেকিং অ্যাকাউন্ট নং ১৩৩১৭৮০৬৮০-এ ইন্দোনেশিয়া থেকে ক্রেডিট হয়েছিল এবং ব্যাংক চেক ক্রয়ের জন্য এসএসএ ট্রিয়াসের ব্যাংক হিসাব থেকে সরাসরি ডিপোজিট হয়েছিল। অনন্ত কুমার সিনহার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের ক্যাশ উত্তোলনের লিমিট ছিল ২০ ডলার থেকে ৩ হাজার ডলার, যা সিটিজেন ব্যাংকের পূর্বনির্ধারিত অথরাইজেশন ছিল। সেইফ ডিপোজিট বক্স ০১০১০০৭২০০০৩৪১১২২-এ কোনো নেতিবাচক তথ্য ছিল না। ফলে এটা নিয়ে সন্দেহ করার কোনো বিষয় তখন ছিল না। কিন্তু অনন্ত কুমার সিনহা তার অ্যাকাউন্ট নং ০৯৯৯৮০৭৪৯২০ থেকে ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ ১৩ হাজার ডলার ক্যাশ উত্তোলন করেন, যা তার লিমিটের বাইরে ছিল।

ওই ট্রানজেকশনটি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট বোস্টনে সংঘটিত হয়েছিল। ২০১৮ সালের ১২ জুন অনন্ত কুমার সিনহা ১৭৯ জ্যাপার স্ট্রিট, প্যাটারসন নিউ জার্সি-০৭৫২২তে ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার ক্যাশ দিয়ে একটি বাড়ি ক্রয় করেন। সুতরাং, অনন্ত কুমার সিনহা যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডেন্টিস্ট হিসাবে কর্মরত থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার ডলার দিয়ে একটি বাড়ি ক্রয় করেন এবং ২০১৮ সালের ১২ জুন ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার ক্যাশ দিয়ে অপর একটি বাড়ি ক্রয় করেন। মূলত সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি থাকাকালে বিভিন্নভাবে অবৈধ টাকা অর্জন করে তা হুন্ডিসহ বিভিন্ন কায়দায় যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করে তার ছোট ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে ওই টাকা ট্রান্সফার করেন এবং তা দিয়েই ১৭৯, জ্যাপার স্ট্রিট, প্যাটারসন নিউজার্সি-০৭৫২২তে ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার ক্যাশ দিয়ে একটি বাড়ি কেনন।

সুতরাং ওই বাড়িটি পরোক্ষভাবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নিজের বাড়ি। অর্থাৎ সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও তার ভাই অনন্ত কুমার সিনহা অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এসকে সিনহা বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে ওই অপরাধলব্ধ অর্থ নিজেদের ভোগ-দখলে রেখে তার অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান গোপন করে বা এর ছদ্মাবরণে পাচার করেছেন। ওই অর্থ বিভিন্ন সময় নিজ ভাই অনন্ত কুমার সিনহার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসামিরা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২), ৪(৩) ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর দুর্নীতির এক মামলায় এসকে সিনহার ১১ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে এসকে সিনহাকে এক ধারায় সাত বছর এবং আরেক ধারায় চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুটি ধারায় দেওয়া সাজা একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। এতে এসকে সিনহাকে সাত বছরের সাজা ভোগ করতে হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে চার কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাতের এ মামলায় ১১ আসামির মধ্যে রায়ে এসকে সিনহা ছাড়া অপর আট আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও দুই আসামি খালাস পেয়েছেন।

বিচারপতি এসকে সিনহা বিদেশে পাড়ি জমানোর পর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন। এরপর তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। তদন্ত শেষে দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ১১ জনকে আসামি করে মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) আদালতে দাখিল করেন।

এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর করা আরও একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top