পুলিশ বিভাগে পদায়ন, পদোন্নতি: অভিজ্ঞতার চেয়ে ঘুষের প্রাধান্য বেশি! রুখবে কে!
অপরাধ প্রতিবেদকঃ পুলিশ বিভাগে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা নয়, ঘুষই প্রাধান্য পায়। এতে যোগ্যরা বঞ্চিত হন। আর যার খুঁটির জোর বেশি, তিনিই লাভবান হন। পুলিশে এই পরিস্থিতি বাড়ছে দলবাজির কারণে।
বিগত সরকারের আমলে ঘুষের পাশাপাশি দলীয় লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেও তা অব্যাহত আছে। এতে লাভবান হচ্ছেন ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। এ কারণে মাঠ পর্যায়ের অপরাধ দমনে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের মনিটরিংয়ের অভাবে দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন কর্মকর্তারা।
একটি জেলার দায়িত্বে থাকেন এসপি। তার সঙ্গে দুইয়ের অধিক জন অতিরিক্ত এসপি থাকেন। আর রেঞ্জে, অর্থাৎ বিভাগীয় পর্যায়ের প্রধান হলেন ডিআইজি। তার সঙ্গে থাকেন তিন থেকে চার জন অতিরিক্ত ডিআইজি। এছাড়া আরো অনেক কর্মকর্তা থাকেন। আর দুই-তিনটা থানা মিলে যে সার্কেল গঠিত হয়েছে, সেখানে একজন অতিরিক্ত এসপি থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সঠিকভাবে মনিটরিং করেন না। এ কারণে রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম ও ওয়ার্ড পর্যায়ে হত্যাকাণ্ড, গুম, অধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ ও মাদকের কারবার চলছে। আর এসব কর্মকাণ্ডে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতাকর্মী জড়িত। মাদক নিয়ে রাজনৈতিক লোকদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তবে মাদকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে খুনখারাবি হয়। এছাড়া চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজি বাড়ছে। এসব অপরাধ দমনে থানায় মামলা হলেও সঠিক তদন্ত হয় না। থানায় মামলা দায়েরের পর বাদী-বিবাদী উভয়ের কাছ থেকে টাকা নেন। এই অবস্থা চলে মাসের পর মাস।
স্থানীয় গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশির ভাগ থানায় এমন চিত্র। আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। যিনি ক্ষমতাসীন দলের, তার জন্য একধরনের আইনি ব্যবস্থা, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জন্য অন্য ধরনের, আবার টাকা দিলে আরেক ধরনের আইন, নিরীহ মানুষের জন্য ভিন্ন ধরনের আইন প্রয়োগ হচ্ছে। অর্থাৎ, থানায় মামলা ও জিডির ক্ষেত্রে ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে অনেকটা খেজুরগাছের রস খাওয়ার মতো।
একাধিক থানার ওসি বলেন, পুলিশে আগের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। যানবাহনসহ সক্ষমতাও বেড়েছে। তবে সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। কিন্তু থানার ওসিদের কিছু করার থাকে না। ওসিরা বসে বসে টোল কালেকশন করেন। কারণ একজন ওসির পোস্টিং নিতে ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো কোনো থানায় পোস্টিং নিতে কোটি টাকাও ঘুষ দেওয়া লাগে। কারণ ঐ সব থানা এলাকায় মাদকসহ অন্যান্য আয়ের উৎস অনেক বেশি। আবার কোনো কোনো এসপি ও রেঞ্জের কর্মকর্তারা বলে দেন, প্রতি মাসে ওসিদের কত টাকা দিতে হবে। যে টাকা দিয়ে পোস্টিং নিয়েছি, সেই টাকা তুলতে হবে। আবার প্রতি মাসে স্যারদের ঘুষের টাকা দিতে হবে। তাহলে ওসিরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন কীভাবে? ঘুষের টাকা দিতে পারলে ভালো অফিসার আর না দিতে পারলে খারাপের শেষ নেই। সিনিয়র অফিসাররা ঘুষ দিতে বাধ্য করেন। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে এলেই মাঠ পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেক গুণ উন্নতি হবে। অর্থাৎ, মাঠ পর্যায়ের অপরাধ একেবারেই কমে আসবে বলে ওসিরা জানান। প্রতিটি মামলার চার্জশিট এসপি ও ডিআইজি পর্যন্ত যায়। চার্জশিটে এসপিরা স্বাক্ষর করেন। কিন্তু কী দিলাম তা পড়ে দেখেন না বেশির ভাগ এসপি। শুধু দেখেন ঘুষের প্যাকেটটি ঠিকমতো আছে কি না।
করোনাকালে মানবিক ভূমিকা পালন করে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে পুলিশ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার পাশে কেউ ছিল না। শুধু পুলিশ তাদের পাশে ছিল, দাফন পর্যন্ত করে দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু একশ্রেণির ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে পুলিশের বিশাল বাহিনী দায়ী হতে পারে না।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আর যা-ই করুক, পুলিশে অপরাধ করলে ছাড় নেই। প্রতি বছর আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার পুলিশ সদস্যের চাকরিচ্যুতি হয়। অন্য কোনো প্রশাসনে এ ধরনের সততার পরিচয় দিতে পারে না। ঘুষখোর কিংবা অভিযুক্তদের আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
একটি জেলার পুলিশ সুপার গণমাধ্যমে সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমার জেলায় অপরাধ হলে আমি এসপি থাকব কেন? দায়দায়িত্ব আমার। আমি সৎ, আমার অফিসাররাও সৎ। এ ধরনের এসপি ও ডিআইজিও আছেন অনেক। সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করলে যেকোনো জেলার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
এদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে জেলার এসপি ও মহানগরের ডিসিদের পদায়নের জন্য যে তালিকা দেওয়া হয়, তা বেশির ভাগই পরিবর্তন হয়ে যায়। তদ্বিরকারী ও ঘুষখোরেরা সেখানে জায়গা করে নেন। শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, জেলার এসপি ও অতিরিক্ত এসপিরা সঠিকভাবে মনিটরিং করলে দেশ থেকে মাদকসহ সব ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশে পদায়ন ও পদোন্নতি হওয়া উচিত। অন্যদিকে ঘুষখোরদের তিরস্কার করা উচিত।
পুলিশের সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, পুলিশে তদারকি ও মনিটরিং খুবই জরুরি। প্রতিদিন থানায় যে মামলা হয়, তা এসপি ও রেঞ্জের দপ্তর পর্যন্ত পাঠানো হয়। মনিটনিং হলে কোনো ধরনের আইনের ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। থানার ওসিরা এখন ক্লাস ওয়ান অফিসার। এ কারণে ওসিদের কারোর জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত।
পুলিশের সাবেক আইজি শহীদুল হক বলেন, এখন পুলিশে প্রচুর অফিসার আছে। জনবল ও সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। এসপি-ডিসি আছেন, তাদের স্ব-স্ব থানা এলাকায় নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। শহীদুল হক আইজিপি থাকাকালেও হঠাৎ থানায় তদন্তে যেতেন। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতেন। তিনি বলেন, অপরাধ দমনে এলাকার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিংকে কাজে লাগাতে হবে। প্রতিটি থানায় মামলা ও জিডিসমূহ সঠিকভাবে তদন্ত হচ্ছে কি না, তা জেলার এসপি ও মহানগরের ডিসিরা সঠিকভাবে মনিটরিং ও তদারক করলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকবেই।