অচল মাঠপ্রশাসন; শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভুল সিদ্ধান্তেই জটিলতা
বিশেষ প্রতিবেদকঃ টানা তৃতীয় দিনেও কার্যত অচল ছিল সারা দেশের মাঠপ্রশাসন। মঙ্গলবার থেকে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও ইউএনও অফিসে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে আছেন। বেতন গ্রেড উন্নীতকরণ ও পদবি পরিবর্তনের দাবিতে এ কর্মবিরতি চলছে।
এতে রীতিমতো ভেঙে পড়েছে প্রশাসনের শৃঙ্খলা। ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের। সরকারের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী তহশিলদারদের গ্রেড পরিবর্তন হলেও অন্যদের তা হয়নি।
অথচ এর আগে শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের গ্রেড পরিবর্তন করা হলে কেন্দ্র ও মাঠ প্রশাসনে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে। সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এমন অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই মূলত এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একদফা বৈঠকে কর্মচারীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হলেও কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়নি। কর্মচারীদের নেতারা বলছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপ আগেও ছিল। কিন্তু অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা তা আটকে দিয়েছে। ২৪ মার্চ পর্যন্ত কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়েছে কর্মচারীরা।
তহশিলদারদের গ্রেড উন্নীতকরণ হলেও মাঠপ্রশাসন কর্মচারীদের কেন হচ্ছে না এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ব্যয় ব্যবস্থাপনা) সুলেখা রানী বসু কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) নবীরুল ইসলাম বলেন, মাঠপ্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের গ্রেড উন্নীতকরণ এবং পদনাম পরিবর্তনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে।
কর্মবিরতির নেপথ্যে : ভূমি অফিসের তহশিলদারদের বিভিন্ন কাজে ইউএনও এবং ডিসি অফিসে যেতে হয়। এক্ষেত্রে ডিসি ও ইউএনও অফিসের কর্মচারীদের মর্যাদা বেশি ছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে তহশিলদারদের পদোন্নতি দিয়ে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে ইউএনও, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার অফিসের কর্মচারীদের বড় আঘাত লেগেছে। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্ম বিরতিতে নেমেছেন কর্মচারীরা।
২০১৩ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের পদোন্নতিসংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন আদেশ, সিদ্ধান্ত ও বৈঠকের কার্যবিবরণী হয়েছে। এসব কাগজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-ইউএনও, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এবং ভূমি অফিসের তহশিলদারদের গ্রেড উন্নীতকরণ ও পদনাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলমান আছে। সরকারের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উভয়ের গ্রেড উন্নীতকরণ ও পদনাম পরিবর্তন একসঙ্গে হবে।
কিন্তু তহশিলদারদের গ্রেড উন্নীতকরণ আগে হয়ে যাওয়ায় বর্তমান জটিলতা তৈরি হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে ভূমি মন্ত্রণালয় তহশিলদারদের পদোন্নতির বিষয়ে সম্মতি পেতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠায়।
৯ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (মাঠ প্রশাসন-১) মমতাজ বেগম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠান। ১৭ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সওব্য-৭) ফারাহ্ গুল নিঝুম স্বাক্ষরিত চিঠিতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে উত্তর দেওয়া হয়।
উত্তরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের পদনাম এবং বেতনগ্রেড পরিবর্তনের বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাই ভূমি মন্ত্রণালয়ের একই মর্যাদার কর্মচারীদের গ্রেড ও পদনাম উন্নীতকরণের বিষয়ে মতামত প্রদান করা সমীচীন হবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন মতামতের পরও ৩১ জানুয়ারি তহশিলদারদের গ্রেড পরিবর্তন করে আদেশ জারি করা হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই কর্মবিরতির কর্মচসূচি ঘোষণা করে দেশব্যাপী থাকা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মচারী সমিতি (বাবিককাকস) মহাসচিব কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুই বিষয়ে একসঙ্গে সমন্বয় করে অগ্রসর হওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু তহশিলদারদের সিদ্ধান্ত আগে হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।
অর্থ বিভাগের প্রত্যাখ্যান : মাঠপ্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নীতকরণে নীতিগত সম্মতি দেন। এসব সিদ্ধান্তের সারসংক্ষেপ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বিভাগে পাঠানোও হয়। কিন্তু অর্থ বিভাগ থেকে জনপ্রশাসনকে জানানো হয়, মাঠপ্রশাসনে কর্মরত অর্থাৎ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, ডিসি অফিস ও ইউএনও অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের বিদ্যমান পদবি পরিবর্তন করে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং বেতন উন্নীতকরণ হলে মাঠপর্যায়ে অন্যান্য কার্যালয় ও সচিবালয়ের কর্মচারীদের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা ও ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানানো হয়।
এমন কারণ দেখিয়ে এসব কর্মচারীদের দাবির প্রতি অসম্মতি জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ বিভাগের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-৩ শাখার উপসচিব রিপন চাকমার স্বাক্ষরে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে এসব কর্মচারীর বেতন গ্রেড উন্নীতকরণ ও পদবি পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিভিন্ন যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। ৩০ জুন অর্থ সচিব বরাবর পাঠানো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তুলে ধরা যুক্তিতে বলা হয়েছে, সচিবালয়ের প্রধান সহকারী, শাখা সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও বাজেট পরীক্ষককে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ হিসাবে এবং সাঁটলিপিকারকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসাবে পদবি পরিবর্তন ও বেতনগ্রেড উন্নীত করা হয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের প্রধান সহকারী, শাখা সহকারী, উচ্চমান সহকারী পদকে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের উচ্চমান সহকারী পদকে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ হিসাবে পদবি পরিবর্তন ও বেতন গ্রেড উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও ইউএনও অফিসের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সচিবালয় বা হাইকোর্ট বিভাগের অনুরূপ না করে নিম্ম ধাপের ১৩তম গ্রেডে ‘সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ হিসাবে পদবি পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে কোনো অসমঞ্জস্যতা আসবে না বলে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ কালেক্টরেট সহকারী সমিতি (বাকাসস) সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা সরকারের নীতি বাস্তবায়নে একনিষ্ঠভাবে কাজ করি। অথচ আমাদের ন্যায্য দাবির জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যদি আমাদের বেতনগ্রেড পরিবর্তন করলে অসামঞ্জ্যতা তৈরি হয়, তাহলে একই পর্যায়ের তহশিলদারদের বেতন গ্রেড হলো কিভাবে, এই প্রশ্নটাই আমরা রাখছি।
অর্থ বিভাগে পাঠানো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় যুক্তিতে বলা হয়েছে, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও ইউএনও অফিসে অর্থাৎ মাঠ প্রশাসনে কর্মরতরা সরকারের নীতি বাস্তবায়নে সচিবালয়ের মতোই কাজ করে। তাই মাঠ প্রশাসনের অন্যান্য অফিসের কর্মচারীদের মতো বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও ইউএনও অফিসের তুলনা করা চলে না।
জনপ্রশাসন তৃতীয় যুক্তি অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ এ বিষয়টি পর্যালোচনা করে এসব কর্মচারীদের পদবি পরিবর্তন ও বেতনগ্রেড উন্নীতকরণে সম্মতি দিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন।
জনপ্রশাসন থেকে এমন যুক্তি দেওয়ার প্রায় ১০ মাস হতে চললেও এসব কর্মচারীর কোনো আশার চিহ্ন দেখছেন না। অন্যদিকে ৩১ জানুয়ারি একই পর্যায়ের ভূমি অফিস কেন্দ্রিক মাঠপ্রশাসনের কর্মচারী তহশিলদার ও সহকারী তহসিলদারদের বেতন গ্রেড উন্নীতকরণ ও পদবি পরিবর্তন হয়েছে। তহশিলদার এবং মাঠপ্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের উল্লিখিত দাবির বিষয়টি প্রায় এক দশক আগে থেকে অমীমাংসিত। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে জনপ্রশাসন, অর্থ ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত চার সদস্যের কমিটি এর সমাধানও দিয়েছিল।
কিন্তু সেই পথ না মাড়িয়েই তহশিলদার ও সহকারী তহশিলদারদের বেতন গ্রেড ১৬ ও ১৭ থেকে যথাক্রমে ১১ ও ১২তম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বাকাসসের সভাপতি আকবর হোসেন বলেন, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও ইউএনও অফিসে চাকরি করেও আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনাটুকু পাচ্ছি না। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মানটুকু চাই।