একটি কমিউনিটি ক্লিনিক – হোসেন আবদুল মান্নান
প্রজাতন্ত্রের কর্মের শেষ দিকে এসে আমি জন্মভূমির সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীন তৃণমূলের মানুষের জন্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার নিমিত্ত মূলতঃ মহতী উদ্যোগের কথা মাথায় রেখে ছোট্ট একটি কাজে হাত দিই। নিজ গ্রামের পৈত্রিক ভিটা সংলগ্ন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এক খন্ড নির্ভেজাল জমি সরকারের কাছে হস্তান্তর পূর্বক এমন একটা প্রতিষ্টান গড়ে তুলতে পেরে আজ বেশ আত্মতৃপ্তি বোধ করছি। যদিও এর জন্য শত প্রতিকূলতা, বিপন্নতা ও বিপত্তির সাথে লড়তে হয়েছে আমাকে। এমনকি দিবালোকে, জনারণ্যেই নিজের জীবন নাশের কারণ হয়ে উঠেছিল এর জন্য । যা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাখায় ভর করে উড়েছিল সারা পৃথিবীর নীলাকাশে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবা প্রদানের মূল চিন্তক ও বাস্তবায়নকারী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদ্দুর জানি, তাঁর মস্তিষ্ক-প্রসূত (brain child) তথ্য-উপাত্ত নিয়েই দেশব্যাপী এমন এক অদৃশ্য বিপ্লব সাধিত হয়ে চলেছে। নিম্নবিত্ত গণমানুষের নজরে এর অস্তিত্ব থাকলেও সর্বস্তরে তা এখনও উপনীত হয়নি। তবে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি ও বিত্তবানরা এর অভ্যন্তরীন ব্যবস্হাপনা তথা সামাজিক গুরুত্ব বিষয়ে আগ্রহ প্রদর্শন না করার পেছনে রয়েছে নানাবিধ কৌশল ও কারণ।
বলা ছিল, স্হানীয় সরকারের অধীনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ এর দৈনন্দিন কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন। এ দিকটাও অদ্যাবধি যথেষ্ট পরিমাণে অবহেলিত থেকে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে
দেখা গেছে, একে তাঁরা সহযোগিতা না করে উল্টো বাঁধাগ্রস্ত করে চলেছে। এমন বাস্তবতায় তাঁদের গ্রামীণ রাজনীতির (village politics) দুরূহ পাঠশালার সিলেবাস সম্পর্কে আমরা অনেকেই অজ্ঞাত। অথচ তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত সংশ্লিষ্টতা ও নিবিড় সাহচর্যে এ কার্যক্রম হতে পারতো দুনিয়ায় সাড়া জাগানো স্বাস্থ্যসেবার এক অনন্য কালোত্তীর্ণ মডেল। তারপরও আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, একদিন এ সেবার সচিত্র প্রতিবেদন বিশ্বায়নের যুগের হালনাগাদ প্রযুক্তির আওতায় চলে আসবে। এবং আমার দেশ
বিপুলভাবে প্রশংসায় অভিষিক্ত হবে।
২.
উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট’ নামে একটি আইন হয়। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে সংসদে উত্থাপিত হয়ে ৮ অক্টোবরে আইনটি পাস হয়। ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে বর্তমানে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৭-২০২২ সালের মধ্যে ১৪০০০ হাজারের বেশি ক্লিনিক নির্মাণের টার্গেট নিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও ইতোমধ্যে প্রায় ৯২% সম্পন্ন হয়েছে। তবে মাঝে সরকারের পরিবর্তনে এ কার্যক্রম মুখথুবড়ে পড়ে গিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বশেষ অনুশাসনে ক্লিনিকের জন্য চার কক্ষবিশিষ্ট নতুন মডেল অনুমোদন করেছেন। এখন ৮ শতক জমির ওপর নির্মিত আধুনিক ভবনে সেবার মানও আগের তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে ৩১ প্রকার ঔষধ দেওয়া হয়, প্যারাসিটামল, ও আর এস, এন্টাসিড, ভিটামিন, পরিবার পরিকল্পনার কিটসহ নানা নিত্য প্রয়োজনীয় আইটেম রয়েছে এতে।
এগুলোর মাধ্যমে বছরে ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার ঔষধ বিনামূল্যে দেয়া হয়। প্রতি ৬০০০ হাজার মানুষের বিপরীতে দেশে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবন নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কাজ এইচ, ই, ডি, করে থাকে। ট্রাস্টের আওতায় জনবল, পদ সৃজন, চাকরি- বিধিমালা, নিয়োগ ইত্যাদি প্রনয়ণ প্রক্রিয়াধীন আছে।
তথ্য মতে, গড়ে একদিনে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩৮ জন ভিজিট করে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এতে ভিজিট সংখ্যা হয় প্রায় ৮৬ কোটি ৫০ লক্ষ। এর ৮০% এর অধিক নারী। এ সময়কালে ক্লিনিক গুলোতে ৭৭০০০ হাজারের কাছাকাছি নিরাপদ প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আপাততঃ স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারীগণ যুগপৎভাবে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সি,এইচ,সি,পি গণ (community health care provider) নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এরা শিক্ষিত ও দক্ষ। এদের অনেক যৌক্তিক দাবি ও অধিকার রয়েছে। যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুরাহা করার অবকাশ আছে।
৩.
চলমান অতি মারি করোনা কেড়ে নেয় আমার স্ত্রীকে। তাঁর নামটি গ্রামের মানুষের কাছে সামান্য স্মরণীয় করে রাখার প্রচ্ছন্ন বাসনা থেকেই জমি দান এবং সরকারি অর্থায়নে ক্লিনিকটি প্রতিষ্ঠা করা। কেননা গ্রামের সাধারণ মহিলাদের সঙ্গে মায়াবী এক আত্মিক বন্ধন ছিল আমার স্ত্রী’র। এখন এ ক্লিনিক থেকে প্রতিদিন শত শত গরীব সহায় সম্বলহীন, স্বামী বা পুত্রহীন নারী সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নানা প্রকার ঔষধ-পথ্য নিয়ে যাচ্ছেন। ক্লিনিকে প্রবেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা জেনেও তারা রাত পোহাতেই দূর-দূরান্ত থেকে হাজির হচ্ছেন এর নিরাপদ ছায়াতলে। গ্রাম থেকে ধারনকৃত ভিডিও ক্লিপগুলো আমি নিভৃতে প্রসারিত করে যেন নিজেকেই খুঁজে বেড়াই , আমার শৈশব, আমার বালক বেলার পাড়া-মহল্লার সেই চেনা মুখগুলোকে খুঁজি। এই তো রহিম, করিম, মোমেনা, সালেহা প্রমুখকে দেখছি। লাইনে অপেক্ষমান তারা। সরকারি ঔষধ নিতে এসেছে সকলই । এখন টাকা পয়সা যোগাড় করে স্হানীয় ডিসপেনসারিতে যেতে হচ্ছে না তাদের। তারা যেন অনায়াসে এক অকৃত্রিম সরকারি আশ্রয় পেয়ে গেছেন। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক হিসেবে এ-ই তো তাদের প্রাপ্য।
৩.
আজ সকালে আমাদের কটিয়াদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক কর্মচারীর প্রেরিত তথ্য পেয়ে আমার আনন্দের সীমা নেই। আমি অভিভূত। আমার দু’চোখের পাতায় আনন্দাশ্রু। অতি মারির এ নিষ্ঠুর বিশ্বেও মানুষের পাশে থাকার নূন্যতম একটু সুযোগ দিয়েছে আমার এ দেশ। আমার মাটি ও মাতৃভূমি।
গত ১২ জুলাই ২০২১ সালে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ ক্লিনিকটি সন্তপর্ণে চালু করে দিয়েছিলেন। সেদিন থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ অবধি ০৭ মাস ০৫ দিনে সেবাভোগীদের আজকের পরিসংখ্যান হল
পুরুষ – ৩৩২৮ জন
মহিলা- ৫৭২০ জন
গর্ভবতী নারী- ৩৬০ জন
শিশু — ৭৮৬ জন
মোট ১০,১৯৪ জন প্রান্তিক মানুষ।
৪.
একথা জোর দিয়ে– আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলা যায় যে, কমিউনিটি ক্লিনিকের অভূতপূর্ব সেবাদান পদ্ধতিতে
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসহায় ছিন্নমূল নারীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন। তারা বিনা খরচে,
বিনা বাধায় হাতের নাগালের ভেতরে এখন বাঁচার এক টুকরো অবলম্বন পেয়েছেন। এ যুগান্তকারী ও মানবতাবাদী পরিষেবা খাতকে সবার উপরে স্থান দেয়া হোক। সবার উপরে মানুষ সত্য।
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ খ্রিঃ
একটি কমিউনিটি ক্লিনিক –
হোসেন আবদুল মান্নান
সাবেক সচিব স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়।
বাংলাদেশ সরকার।