ইলিশ কথা – মওদুদ আহমেদ
এরশাদ সরকারের শেষের দিকে । তখন বাবার চাকরি সুবাদে আমরা ছিলাম ভোলা জেলার তজুমদ্দিন থানায়। মেঘনা নদীর তীরবর্তী এই থানা। অধিকাংশ মানুষের জীবীকা মাছ ধরা। আমাদের বাড়ি ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর থানায়। আমি তখন খুব ছোট। সেইসময় আমরা সাধারণত বছরে ২ বার বাড়ি যেতাম।তজুমদ্দিন থেকে বাড়ি যেতে প্রায় ১৪/১৫ ঘন্টা লাগতো।মাঝেমধ্যে আরো বেশি সময় লাগতো। তজুমদ্দিন থেকে ভোলা এসে লঞ্চে করে থেকে রওয়ানা দিয়ে রাতে বরিশাল থাকতে হতো। সেখান থেকে লঞ্চে করে ঝালকাঠি গিয়ে নৌকায় করে বাড়ি যেতে হতো। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ ছিলো।
সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে নদীতে প্রচুর মাছ পড়তো ।কোন একদিন রাতে আব্বা বাসায় ৫/৬ হালি মাছ নিয়ে আসতেন। প্রত্যেকটার ওজন ২ কেজির বেশি। দাম হালি প্রতি দাম ১২০ টাকা বা তার বেশি কম। তখন মাছ বিক্রি হতো হালিতে অথবা ঠিকামূলে। তখন তজুমুদ্দিনে কারেন্ট ছিলোনা। সেই মাছ আম্মা আর আব্বা মিলে সারারাত ধরে হেরিকেন কিংবা কপির আলোতে কেটে ধুয়ে লবন দিয়ে আলকাতরার জেরে সুন্দর করে সাজিয়ে পলিথিন দিয়ে সিলগালা দিয়ে রাখতো। একটা জেরে পাঁচ হালি মাছ ধরতো। বছরের পর বছর রাখলেও মাছের কোনো ক্ষতি হতোনা। লোকে বাড়ি গেলে কতকিছু নিয়ে যায়। আর আমরা যখন বাড়িতে যেতাম লবন দিয়ে সংরক্ষিত মাছ নিয়ে যেতাম। সেই মাছ বাড়ি বাড়ি বিলি করা হতো। গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে রসুন মাখিয়ে এই মাছ রান্না করা হতো, মনে হতো যেন তাজা মাছ খাচ্ছি। সেই সময় মাছ ভাজি করলে আশেপাশের ঘর থেকে টের পাওয়া যেত অমুক বাড়িতে আজ ইলিশ রান্না হচ্ছে। ইলিশ খেতে খেতে অরুচি ধরে যেত।
সেই সময় ধনী গরীব সবাই মাছ খেতে পারতো। তখন তজুমদ্দিনে দেখছি ছোট ছোট ঝাটকা মাছের দাম ছিলো দুই টাকা থেকে পাচ টাকা। ১৯৯৫ সালে বরিশালে আব্বা বাজার থেকে ১৫০ টাকা দিয়ে একটা ইলিশ মাছ কিনে কাঁচাবাজারে গিয়ে মেপে দেখলো ওজন দুই কেজি নয়শত পঞ্চাশ গ্রাম! এখন আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ গরীবতো দূরের কথা মধ্যবিত্তের ক্রয় সীমার বাইরে। কেজি সাইজের একটা মাছ হাজার টাকার নীচে চিন্তাও করা যায়না!হোটেলে ভালো এক পিছ মাছের দাম সাড়ে তিনশত টাকা!
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। বহুকাল থেকে বাঙ্গালীর ইলিশ প্রীতির কথা সুবিদিত। সর্ষে ইলিশ, ইলিশ পোলাও, ইলিশ দোপেয়াজা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ ভাজা, ভাপা ইলিশ, স্মোকড ইলিশ, ইলিশের মালাইকারী – এমন নানা পদের খাবার বাংলাদেশে জনপ্রিয়। কিন্তু এত ভালোবাসার পরেও ইলিশের ভালো-মন্দ নিয়ে ধন্দে থাকেন কম বেশি সবাই। মানে কোন ইলিশ ভালো, কোন ইলিশের স্বাদ বেশী, কোন ইলিশ নদীর আর কোনটাই বা সমুদ্রের ইলিশ। ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকে। শুধু ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে।
দুইটি ইলিশই টর্পেডো আকারের। কিন্তু নদীর ইলিশ একটু বেঁটেখাটো হবে, আর সাগরের ইলিশ হবে সরু ও লম্বা।সেই সঙ্গে নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল। নদীর ইলিশ চকচকে বেশি হবে, বেশি রুপালী হবে রং। সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল।”
এছাড়া নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার ইলিশ মাছের আকার হবে পটলের মতো অর্থাৎ মাথা আর লেজ সরু আর পেটটা মোটা হতে হবে।
পৃথিবীর মোট ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে।এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্মার ইলিশ। পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায় যে ধরণের খাবার খায় ইলিশ, এবং পানির প্রবাহের যে মাত্রা তার ফলে এর শরীরে উৎপন্ন হওয়া চর্বিই এর স্বাদ অন্য যেকোন জায়গার ইলিশের চেয়ে ভিন্ন করেছে। ইলিশ সমুদ্র থেকে এসে নদীতে ডিম ছাড়ার পর বাচ্চা ইলিশ আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। এবং তার যখন আবার প্রজনন মৌসুম আসে, অর্থাৎ ডিম ছাড়ার সময় হয়, সে তখন যেখানে তার জন্ম সেখানে ফিরে যায়। ফলে বছরের পর বছর ধরে পদ্মার ইলিশের সুখ্যাতি বজায় রয়েছে।
সাধারণত অগাস্ট মাসের পর থেকে শুরু হয় ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম, চলে সেপ্টেম্বর অক্টোবর পর্যন্ত।
একটি মা ইলিশ এক প্রজনন ঋতুতে আড়াই থেকে ষোল লক্ষ পর্যন্ত ডিম দেয়। পরিযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ইলিশ পদ্মা, যমুনা ও মেঘনাসহ কতকগুলি বড় বড় নদীর উজানে গিয়ে স্রোতপ্রবাহে ডিম ছাড়ে। ভাসমান ডিম থেকে রেণু বেরিয়ে এসব এলাকায় কিছুদিন থাকে এবং এখানেই খায় ও বড় হয়। ছয় থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে পোনা দৈর্ঘ্যে ১২-২০ সেমি লম্বা হয়, তখন এদের জাটকা বলে। আরও বড় ও পরিণত হওয়ার জন্য জাটকা এ পর্যায়ে সমুদ্রের উদ্দেশে ভাটিতে নামতে থাকে।এই সময় ঝাঁকে ঝাকে জেলেদের জালে জাটকা মাছ ধরা পড়ে। বাংলাদেশি আইনে জাটকা ধরা দন্ডনীয় অপরাধ।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৭ সালে ইলিশ মাছ স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী এই মূহুর্তে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে।
বাংলাদেশে গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে রসনা তৃপ্তির সাথে সাথে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে ইলিশ।
এছাড়া ইলিশ মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী ইলিশ মাছে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়াম। এই মাছ খেলে হৃদযন্ত্র ভালো থাকে, মস্তিষ্কের গঠন ভালো হয়, রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাক, এবং বাত বা আর্থারাইটিস কম হয়। ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারও কম হয়।
ইলিশের অনেক নাম -ইলিশ, চন্দনা, জাটকা, খয়রা; চট্টগ্রামের দিকে বলে চিটা। কুমিল্লা, নোয়াখালীতে আবার বিল্লি, খাল্লিশ, বাম, পাইটে, সকড়ি। নদী থেকে বিলে এসে কুল হারানো ইলিশ হয়ে যায় বিলিশ।ওডিশার মানুষ বলে ইলিশি। আসামে সেটা আবার হিলসা। বিহারে ইলসা। মারাঠিদের কাছে পাল্লো। গুজরাটে স্ত্রী আর পুরুষ ইলিশকে পৃথক নামে ডাকা হয়। স্ত্রী মাছ মদেন আর পুরুষ মাছ পালওয়া।উড়িয়াদের কাছে মাছ মানে ইলিশ। চাকরি মানে পুলিশ। তাই তো উড়িয়ারা ছড়া কাটে -মাছ খাইবি ইলিশি, চাকরি করিবি পোলিসি।
পদ্মার ইলিশ আসলেই অনেক সুস্বাদু। এই ইলিশের সুখ্যাতি সারা বিশ্বজুড়ে। আমার এক আত্মীয় ইন্ডিয়ায় ডাক্তার দেখাতে গিয়ে আসার সময় ডাক্তার কানে কানে বলেছিলেন, আবার আসলে বাংলাদেশ থেকে আমার জন্য পদ্মার ইলিশ নিয়ে আসবেন। এই সুস্বাদু মাছ এখন আমাদের অনেকেরই কপালে জোটেনা। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অনলাইন ভিত্তিক “ইলিশ লাভার ” নামে একটা গ্রুপ পদ্মার পাড়ে ইলিশ উৎসব করে আসছে। দিন দিন এই উৎসবের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আমার বিশ্বাস, এই উৎসবের সুনাম সারা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়বে।
মওদুদ আহমেদ
বিচারক, কবি ও লেখক।