‘দুর্নীতির পাইলট’ মোতালেব তবুও বহাল তবিয়তে
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ‘মাস্টার পাইলট’ সুপারভাইজার আব্দুল মোতালেব। অপ্রদর্শিত আয় আর অঢেল সম্পদ গড়ে বিআইডব্লিউটিএ’তে পরিচিতি পেয়েছেন দুর্নীতির পাইলট হিসেবে। চট্টগ্রামে কর্মরত থাকলেও তার অর্ধমাসই কাটে ঢাকায়। প্রধান দফতরে তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়লেও বহাল তবিয়তে এ কর্মকর্তা।
শহীদ উল্যা নামে এক মাস্টার পাইলট আবদুল মোতালেবের বিরুদ্ধে সচিব, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেন। সে অভিযোগপত্রের একটি কপি এসেছে প্রতিবেদকের হাতে। সেখানে জাহাজের কুপন আত্মসাৎ ও চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ মালিকদের কাছ থেকে নানা ভয়-ভীতি দেখিয়েও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ করা হয়েছে।
এছাড়া চাকরি দেয়ার নামে টাকা আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারে কর্মস্থলে না থাকা, অনিয়ম করে মাস্টার পাইলট ইউনিয়নের সভাপতিও হয়েছিলেন আবদুল মোতালেব।
শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি’র ফিরিস্তির অভিযোগ এসেছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে হয়েছে কমিটি। এতোকিছুর পরও মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন ক’জন কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে বহাল তবিয়তে থাকায় ক্ষুব্ধ সংস্থার সাধারণ কর্মচারীরা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিআইডব্লিউটিএর মাস্টার পাইলট এন্ড স্টাফ ইউনিয়নের (চট্রগাম) সাবেক সভাপতি আবদুল মোতালেবের সম্পদের তালিকায় রয়েছে স্বনামে-বেনামে বাড়ি ও ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি। আত্মীয়-পরিজনকে চাকরি দিয়ে বিআইডব্লিউটিএতে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বলয়। নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করেও গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
গত ২০১৭ সালের ৭ মে মিজানুর রহমান গাজী নামে এক ভুক্তভোগী বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করেন, বিআইডব্লিউটিএ এর অধীনে উর্দ্ধতন মাস্টার পাইলট নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তৎকালীন সময়ে আব্দুল মোতালেব উর্দ্ধতন মাস্টার পাইলট ও সভাপতি মাষ্টার পাইলট ইউনিয়নের পরামর্শে তিনি উর্দ্ধতন মাস্টার পাইলট পদে চাকরির জন্য আবেদন করেন। তার রোল নাম্বার ১। তিনি চাকরি পাওয়ার জন্য আব্দুল মোতালেব এর সাথে ১০ লক্ষ টাকার চুক্তি করেন।
লিখিত পরীক্ষার পূর্বে তাকে ব্যাংক রশিদের মাধ্যমে ০১০০০২৪৮৩৮০১৮ চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার জনতা ব্যাংকের শাখায় ২টি রশিদের মাধ্যমে ৪লাখ টাকা প্রদান করেন। মৌখিক পরীক্ষার কার্ড পেয়ে নগদ ৬ লাখ টাকাসহ মোট ১০ লাখ টাকা প্রদান করেন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি মিজানুর রহমান গাজী। এরকম অসংখ্য ভুক্তভোগী ঘুরছেন বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে, তবে ফলাফল শূন্য।
এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর বিভিন্ন পদে কর্মচারী নিয়োগ, কর্মচারীদের ঢাকার বাইরে বদলির ভয় দেখিয়ে এবং অনেককে সুবিধাজনক স্থানে পোস্টিং করিয়ে অন্ততঃ ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
মার্কম্যান পদে চাকরি দেয়ার কথা বলে চরগজারিয়া পাইলট হাউজের বাবুর্চি আব্দুল মান্নানের কাছ থেকে তিন লাখ ৭৫ টাকা হাতিয়ে নেন। একইভাবে মৃত মফিজুর রহমানের ছেলে হারুনকে চাকরি দেয়ার কথা বলে নেন চার লাখ টাকা। চট্টগ্রামের সুলেমান মজিবরের কাছ থেকে ৫০ হাজার নেন। প্রেসণে থাকা মাস্টার পাইলট আব্দুর রবের ছেলে আব্দুর রহিমকে পিয়ন থেকে নিম্নমান সহকারি পদে পদোন্নতির কথা বলে দুই লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যে সমস্ত লাইটার জাহাজ মালামাল লোড করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। যেমন বরিশাল, চাঁদপুর, খুলনা, বাঘাবাড়ী নগরবাড়ী, আশুগঞ্জ, ভৈরব, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, দেশের বিভিন্ন রুটে যায়। এই জাহাজ গুলো থেকে আবদুল মোতালেব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সরকারের রেভিনিউ জমা না দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
আবদুল মোতালেব বিরুদ্ধে শহীদ উল্যা নামের মাস্টার পাইলটের করা অভিযোগে বলা হয়, আমরা সব সময় বিআইডব্লিউটিএ’র মাস্টার পাইলট সার্ভিস গ্রহণ করে চট্টগ্রামে চর গজারিয়া (জনতা বাজার) রুটে জাহাজ নিয়ে যাতায়াত করি। সে অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ’র নিকট থেকে নির্ধারিত টাকা দিয়ে কুপন সংগ্রহ করি। কিন্তু এরবাইরে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে আবদুল মোতালেব ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ৩০ হাজার টাকা ও ৩১ জানুয়ারি ৪৫ হাজার টাকা ভাউচারের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। প্রভাব খাটিয়ে একই কায়দায় সকল জাহাজ মালিকদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে। টাকা নেওয়ায় ব্যাপারে টেলিফোনে কথোপকথনের রেকর্ডও রয়েছে ।
চলতি বছরের গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিআইডব্লিউটিএ’র অডিট টিম পরিদর্শনে আসলে পতেঙ্গা বিচে এমভি আল ফারুক ১-২, এবং ভোরের আলো জাহাজ লোড অবস্থায় দেখতে পায়। ঐ সময় পরিদর্শক টিমকে বন্দর থেকে ছেড়ে আসার বুকিং এর কুপন দেখাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট জাহাজকর্তৃপক্ষ। এসংক্রান্ত বিপুল অর্থ লোপাটের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আবদুল মোতালেব জাতীয়তাবাদী নৌযান শ্রমিক দলের কার্যকারী পরিষদের সদস্য ছিলেন। পরে তিনি শ্রমিক লীগের শীর্ষ এক নেতাকে অর্থ দিয়ে জাতীয় শ্রমিকলীগের অন্তর্ভূক্ত শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন বিআইডব্লিউটিএ চট্রগ্রাম বিশেষ শাখার সভাপতি হন। সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
আবদুল মোতালেবের বিরুদ্ধে দুদকে করা অন্য একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি ডিউটি না করে ক্ষমতাবলে ডিউটি দেখিয়ে থাকেন। শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন বিআইডব্লিউটিএ সভাপতিকে চেকের মাধ্যমে ঘুষের অফার করেছেন জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে তাকে মাস্টার পাইলট সুপারভাইজার বানিয়ে দিতে। মাস্টার পাইলটদের বিশ্রামাগার অগ্রিমকৃত ৮০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মদ্যপানে আসক্ত মোতালেব সাধারণ মাস্টার পাইলটদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কারনে-অকারণে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং চরম দুর্ব্যবহার করেন।
পদ্মা সেতু নির্মাণ সামগ্রী বহন করা (Tug) জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে পদ্মা সেতু যাওয়া-আসার পথে মাস্টার পাইলট বুকিং বাবদ প্রত্যেকটি থেকে আদায় করেন লাখ টাকা। যার প্রমাণ বিভিন্ন (Tug) জাহাজ মালিক বিভিন্ন সময় উত্থাপন করেছেন। একই ঘটনার সাক্ষি সাধারণ মাস্টার পাইলটগণ।
অসাধুপায়ে ও অপ্রদর্শিত আয়ে ঢাকায় গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি ও একাধিক গাড়ী। রাজধানীর ঢাকার বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকায় কোটি টাকায় প্লট কিনে চার তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেছেন। রয়েছে একাধিক প্রাইভেটকার। চট্টগ্রামে স্টেশন রোডের কাছেই রয়েছে তার বিলাসবহুল বাসা। সেখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তিনি।
অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়লেও দুদকের মামলা-মোকদ্দমা থেকে বাঁচতে চতুর মোতালেব সম্পদের বেশিরভাগই করেছেন বেনামে। বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনসহ ঘনিষ্ঠদের নামেই এসব অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল মোতালেব সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার প্রতিপক্ষ ফায়দা হাসিলের জন্য অহেতুক আমার বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিযোগ আনছে।
এই বিষয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেকের মুঠোফোনে অসংখ্য বার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।