বন্দিনী – শাহানা সিরাজী

PicsArt_09-04-11.36.00.jpg

বন্দিনী – শাহানা সিরাজী

সুরাইয়া রাত বারোটায় বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সারা দেহে ক্লান্তি আর শ্রান্তির ছাপ। ক্লান্ত দেহে শুতে না শুতেই তন্দ্রা আসে তারপর ঘুম।

কোমর অবধি চুল বালিশ ছাপিয়ে খাটের নিচে ছড়িয়ে পড়ে খোলা জানালায় অমবশ্যার আঁধার কু ডেকে যাচ্ছে। সুরাইয়া হাত-পায়ে লাফ দিয়ে ওঠে,তার ঘুম পাতলা হয়ে আসে এবং কান্নায় চোখ ভেসে যায়…
কী ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য!

এক পাশে একাই এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করছে অন্য পাশে দুশোমানুষের বেশি তাকে আক্রমণ করছে!
সুরাইয়া থরথর কেঁপে ওঠে

থামো, থামো,থেমে যাও! চলো চলো তোমাকে বদর উদ্দীন ডাকছে। সমস্ত শরীর তার পাথর হয়ে গিয়েছে,জিহবা শুকিয়ে কাঠ, ঠোঁট নাড়াতে পারছে না। হাত দিয়ে কেবল ধাক্কিয়ে যাচ্ছে থেমে যাও!

উত্তেজিত মানুষগুলো সুরাইয়ার দিকে ধেয়ে আসে। কে? কে তুমি?

সুরাইয়ার সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে সবার সম্মুখ হতে মানুষটিকে আড়ালে নিয়ে যেতে চায়। এক একটি মানুষ এগিয়ে আসে আর তার চোখের সামনে এক একটি আকাশের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দরজায় প্রবেশের যতোই চেষ্টা করুক সিরাজ উদ্দৌলার মতো ক্রমশ সে হারিয়ে যেতে থাকে। বাকরুদ্ধ সুরাইয়া কেবল এ দরজা থেকে ও দরজায় ছুটে যায়। তন্ত্রের এতো শক্তির সাথে তার পারার কথা নয়।

মানুষগুলোর মুখ তার কাছে শিকারে ব্যর্থ বন্য জানোয়ারের মতো বিভৎস মনে হয়। ওদের নখের আছড় তাকে রক্তাক্ত করে,ওরা দাঁতালো কামড় বসায়। সুরাইয়া জীবন্ত লাশের মতো চলতে থাকে। কোথাও কেউ নেই!

নবীন তাহলে কোথায়? তাকে আরশের কোন টর্চার সেলে বন্দী করেছে? সে কী প্রকাশ করেছে সে বিবিসির সংবাদ প্রযোজক? সে কী প্রকাশ করেছে সে একটি বার্তা সংস্থার সম্পাদক ও প্রকাশক? না মনে হয়। আজ তো সে সাংবাদিকতায় আসেনি। সে তো এসেছে সুরাইয়ার ডাকে। নিতান্তই আটপৌরে ভাবনায়, অসুস্থ সুরাইয়াকে আগলে রাখার জন্য।

আজ তার সাথে তার কার্ড থাকার কথা নয়,তার প্রেস ক্লাবের মেম্বারশিপ কার্ড থাকার কথা নয় কিংবা ছয় ডিজিটের নাম্বারটিও মনে থাকার কথা নয়।

তবে তাকে নিয়ে তন্ত্রের মালিক, প্রভুরা কী করছে? উদ্বিগ্ন সুরাইয়া জমে যায় এন্টার্কটিকার মতো। বিশালকার মহাদেশ শূন্যতায় ঢাকা। সেখানে কারো চিৎকার পৌঁছে না। হালাকু খান কতো আর ভয়ঙ্কর!কতো আর বাগদাদ ধবংস করেছে তারচেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতম বিধবংসী কাজ তো আজকের তান্ত্রিক হালাকু খানেরা করে যাচ্ছে। এরা দিনকে রাত করছে। জনগনের ট্যাক্সের টাকায় সরকার এদের লালন করে জনগনকে যাতে সরকার সেবা দিতে পারে।

আচ্ছা সরকারি সেবা জনগনের কাছে কে পৌঁছায়? তন্ত্রের প্রভুরা নাকি ফিল্ডে যারা ঘাম ঝরাচ্ছে,জনগনের সাথে যারা সরাসরি সম্পৃক্ত তারা? তবে এ সব প্রভুরা, আরশের মালিক কী ভাবে হয়! সুরাইয়া চিন্তা করতে পারছে না। তার রক্তের প্রবাহ থেমে গেছে যেন! যেন সময় দেখতে পাচ্ছে আজরাইল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, লোমশ হাত,ধারালো নখ তার দিকে এগিয়ে আসছে,কে তুমি? কে? এ কে? কেন এসেছো এখানে?

জবাব দিতে পারছে না কারণ তার রুটি এখানে জিম্মি! তার ভাত এখানে জিম্মি! তার কাপড় এখানে জিম্মি! পৃথিবীতে একদিনও বাঁচতে হলে দরকার ভাত-কাপড় -রুটি। সুতরাং স্থির থাকো,ভেঙে পড়ো না। জমে যাও প্রবাহিত হইও না।

সুরাইয়া নিজেকে আবিষ্কার করে টয়লেটে। আশ্চর্য! এখানে এলো কেন? কী ভাবে এলো? তার সমস্ত দেহ শ্রাবণে ভেসে যাওয়া রক্ত জবার মতো নিঃস্ব, স্থবির। কাকে সে ডাকবে? কেউ কী তাকে ডাকতে পারে না?

সপ্ত আসমান থরথর কাঁপছে। কোথাও ফাঁক ফোকর পাচ্ছে না সে। হঠাৎ আরশের মালিক দুস্থ এক সিপাহীকে পাঠালো, “তোমাকে একান্ত রুমে ডাকছে। ” সুরাইয়ার আত্মা তখন বেরোবার জন্য পথ খুঁজছে। চারতলা থেকে তিনতলা তিনতলা থেকে চারতলা সুরাইয়া ছুটছে।

আসমানের একটি মাত্র দরজা কিছুক্ষণের জন্য খুলে গিয়েছে। সুরাইয়াকে সেখানে স্কট করে নেয়া হয়- সুরাইয়া পৌঁছেই ডাহুকের মতো কেঁদে উঠলো,সরি স্যার। বুঝিনি এমন পরিস্থিতি ক্রিয়েট হবে,আমিই দায়ী! আমি এসেছি চারতলায়। আমার পাওনা বুঝে নিতে।

সিংহ যেন গর্জন করলো কিসের পাওনা?
-কোভিড পরিস্থিতিতে শিখন নিয়ে প্রভুদের প্রজেক্টে কাজ করেছি। যখন লক ডাউনে রাস্তায় কুকুরও ছিলো না। তখন পায়ে হেঁটে,সাইকেলে চড়ে,অতিরিক্ত টাকা খরচ করে আমরাই, আমিই কাজ করেছি নীরবে।

মাননীয়,আপনারা সে জন্য আমাদের ঝুঁকি ভাতা তো দূরে প্রাপ্য ন্যায় হিসস্যা দিতেও দেরি করেছেন। মহোদয় যুগ এখন ডিজিটাল। আপনারা লেনদেন কেন ডিজিটালি করেননি? আমার একাউন্টে পাঠিয়ে দিলে আমাকে তো এই আরশের মালিকদের কাছে আসতে হতো না!- কথাগুলো সুরাইয়া বলতে পারেনি। কারণ পেটতো! বার বার সিগন্যাল দিচ্ছে ক্ষুধা লেগেছে! ক্ষুধা অব্যাহত থাকবে!

আরশের মালিকেরা বাজখাই গলায় আবারো সাউট করছে। সুরাইয়ার বার বার টয়লেটে যাবার তাগিদ অনুভূত হচ্ছে।

পেছন থেকে একজন ডাকলো,এই সুরাইয়া এ দিকে আসুন। খুব পরিচিত কন্ঠ খুব চেনা বাতাস। সুরাইয়ার চোখের তারা নড়ে উঠলো। এবার নিশ্চয়ই নবীনের খবর মিলবে!

সুরাইয়া সাহস করে বললো,পুরো ব্যাপারটি আসলে কী আমার জানা নেই। কিন্ত দিপ্তি বললো, নবীনের বিন্দুমাত্র দোষ ছিলো না। তাকে বারংবার উত্যক্ত করা হয়েছে।

আরশের মালিকের আশেপাশে যে সব সিপাহী থাকে তারা মালিকের চেয়ে শক্তিশালী। একজন কম্পিউটার অপারেটর নবীনকে সাঁড়াশী আক্রমন করেছে কারণ সে পায়ের উপর পা তুলে বসেছে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সে জবাব দিয়েছে।

খোদাপ্রদত্ত তার ভলিউম বেশি। তাতেই পুরো তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ সপ্তম আকাশ একাকার হয়ে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

সুরাইয়া গড়গড় আউড়ে যায়,নবীন অমুক… অমুক…অমুক..। পরিচিত স্বরটি খানিকটা থতমত খেয়ে বললো,তাহলে সে এতো চেঁচাচ্ছে কেন? সুরাইয়া বললো,আমি কিছুই জানি না। সে তো এতো চেঁচানোর কথা নয়! চেনা স্বরটি কাগজ হাতে দিয়ে বললো, যান,লিখে নিয়ে আসেন। সুরাইয়া স্তম্ভিত হয়ে যায়। কী বলে? নবীন আন্ডার টেকেন দেবে? আমার সামনে? ছিঃ লজ্জা! এ পুরো তন্ত্রের লজ্জা! এ পুরো আরশের লজ্জা। বদর উদ্দীন না হলে হয়তো সুরাইয়ার আজ চাকুরীই যেতো। কিন্তু দোষ কোথায় তা খুঁজে পাওয়া গেলো না!

এর নাম ক্ষমতা যার জমিও তার! সুরাইয়ার ইচ্ছা হলো ধরণী দ্বি-ধা হও আমি সীতা হবো!

পায়ের উপর পা তুলে বসা অন্যায় কী? শিষ্টাচারের কথা বলবেন? নবীনের তো তোমরা প্রভু!

নয়! প্রভু আমার। আমি তো পাথর,নতজানু,বন্দিনী! আমি তো বলতে পারি না আমরা যারা মাঠে আমরা কী মানুষ নই? ইনোভেশন নিয়ে কাজ করছো,কই তোমাদের দরজার সামনে ফকিরের মতো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া তো আমাদের উপায় থাকে না!

আমি তো চিৎকার করতে পারছি না- তোমাদের গেস্ট রুম নেই কেন? আমাকে কেন করিডোরেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে? আমার সাথে, এমন কী যে কোন ভিজিটরের সাথে গেস্ট থাকতে পারে সে গেস্ট কোথায় বসবে? কোথায় অপেক্ষা করবে প্রভুর ডাক শোনার জন্য? আমি তো বলতেই পারছি না, আমাকে কেন ব্যক্তিগত আক্রমন করা হচ্ছে? গেস্ট আমার কে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার গেস্টকে তোমরা অপমান করেছো,আমি তো সপ্তর্ষিজালে বন্দি।

আমার হাত- পা- চোখ -কান বাঁধা। আমি মাকড়সার মতো চারদিকের চাপে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছি। আর কী চাও?পাঁচ নাম্বার প্রভুর সাক্ষাৎ পেয়ে প্রাণে প্রবাহের ক্ষীণ ধারা দেখা দিলো।

নবীনের দেখা পেলাম। তাকে কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না…চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার জন্য শুধু আমারই জন্য তাকে অহেতুক ঝামেলায় পড়তে হলো!

টকটকে ফর্সা মুখটি ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। সারাদিন আমারো পেটে দানাপানি পড়েনি নবীন খাবে কোথা থেকে! অভূক্ত আমি অভুক্ত সে। কতোগুলো দানবের মিথ্যাচারে ক্লান্ত নবীন ক্লান্ত আমি। কোন রকমে বললাম, শুধু আমার জন্য… লজ্জায় নুয়ে গিয়েছি। আমারই সহকর্মী অথচ কেউ প্রভু কেউ ভৃত্য! কেউ বরযাত্রী কেউ মিসকিন! আমারই সহকর্মী একযোগে আমার দিকে তীর নিক্ষেপ করছে। প্রতিটি তীর অর্জুনের ভীমের চেয়ে কঠিন। যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ! একে একে লাশ হচ্ছে গান্ধারী পুত্র। কৌরব বংশ ধবংস হয়ে গেলো।

মন্ত্রণালয় অধিদপ্তর কেন রেখেছে? দপ্তর সঠিকভাবে পরিচালনা করা নাকি ফিল্ডের মানুষদের অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করা। অপমান করা? তাদেরকে ঘোরানো? তাদের ন্যায্য পাওনা যথাসময়ে বুঝে না দেয়া? তুই তোকারি করা? সহকর্মী কী ভাবে আরেক সহকর্মীকে তুই তোকারি করে? মহাপ্রভু অপারেটরে ফিল্ডেই ফিরে আসো।

তোমরা আসলে আমাদের হাত পা শীতল হয়ে যায়। আমরা স্টোভ জ্বালিয়ে উষ্ণ করি,তোমাদের জন্য আমরা আমাদের বেনারসি শাড়ির আঁচল দিয়ে চেয়ার মুছে দিই।
আমাদের জন্য একটি গেস্টরুমের ব্যবস্থাও করতে পারো না?

তোমরা ব্রাহ্মণ্ আমরা শূদ্র
তোমরা নবাব আমরা ফকির আবার
তোমরা শোষক আমরা শোষিত….

আমাদের দীর্ঘশ্বাসের উপর তোমরা আরামে ঘুমাও… হ্যাঁ, আমি বন্দিনী তাই নবীনকে বলতে পারিনি তুমি প্রফেশনাল হলে না কেন? সেও পারেনি নিজেকে প্রকাশ করতে। কারণ ক্ষুধা যে…তীব্র ক্ষুধা… বাঁচার আকুল ইচ্ছা এবং আমি যে.. আমাকে যে সে ভক্তি করে, সম্মান করে, আগলে রাখতে চায় পৃথিবীর দেয়া আঘাত হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়।

আমার একান্ত নির্ভরতা যে… সুরাইয়া আর ভাবতে পারে না।

রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে” এটা স্বাধীন দেশের প্রশাসন নাকি পরাধীন! এটা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নাকী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভের খঞ্জর!

ডাক্তার বার বার জানতে চায় সুরাইয়ার লাইফস্টাইল। তা না হলে তাকে সঠিক ট্রিটমেন্ট দেয়া যাবে না,কেন সে ট্রমায় আক্রান্ত হলো…. কেন সে চমকে উঠেই অস্থির হয়ে যায়..

শাহানা সিরাজী / ইন্সট্রাক্টর(সাধারণ)/ পিটিআই মুন্সীগঞ্জ/ কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top