বাংলাদেশে নতুন ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি
অপরাধ প্রতিবেদকঃ দেশজুড়ে বিভিন্ন রকম মাদকের ছড়াছড়ি হলেও দেশে এ প্রথম নতুন মাদকের সন্ধান মিলেছে।
এলএসডি’র (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড) নামের এ মাদকের ভয়াবহতা অন্যান্য মাদকের চেয়ে কয়েকগুন বেশী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন আশির দশকের প্রথম দিকে এমন মাদকের সন্ধান পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে দীর্ঘ সময়ের পর আবারও আলোচনায় আসে এটি।
পুলিশ বলছে, উচ্চবিত্তদের তরুণ-তরুণীরাই এ মাদক সাধারণত সেবন করে থাকে। মাদকটি সেবনে দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, একটি সেবনকারীকে সাময়িক আনন্দ দেয় অন্যটি হ্যালুসিনেশন ও ইলুনেশন দুইটাই তৈরি হয়। আর হ্যালুসিনেশনটা যখন দীর্ঘায়িত হয় তখন সৃষ্টি হয় বড় সমস্যা। এমনকি ব্যক্তি পাগল পর্যন্ত হয়ে যায়। চিকিৎসকরা বলছে মাদকটি অতিমাত্রায় গ্রহণে অনেক সুইসাইড পর্যন্ত করে বসে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, ডি-লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ যা বিভিন্ন ধরণের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরণের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয়।
এটি স্বচ্ছ, গন্ধহীন একটি পদার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়।
এলএসডি’কে ‘সাইকাডেলিক’ মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধরণের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশেপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনো কখনো ‘হ্যালুসিনেট’ বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষও করে থাকে।
ডিবি বলছে, এই মাদকগুলোর ছদ্মনাম MDMA, N, M-Dimethyltryptania, psilocybin mushroom সহ LSD-25, Acid, Delysid ইত্যাদি নামের হয়ে থাকে। সাধারণত এই মাদকের ভয়াবহতার কারণে এই মাদককে LSD (Last State of Drug) বলা হয়।
নতুন এ মাদক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত যুগ্ম কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, আশির দশকের প্রথম দিকে এ এলএসডি মাদকদ্রব্যটির প্রচলন হয়েছিল। সারা পৃথিবীতে এ মাদকদ্রব্যটি অবৈধ এবং নিষিদ্ধ। এ মাদকটি খুবই ছোট আকারের। এটি গ্রহণের পর সেবনকারী এক ধরণের কল্পনার জগতে চলে যায়। তবে এ মাদক গ্রহণে দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, একটি হলো সাময়িকের জন্য আনন্দ পাওয়া যায় আবার আরেকটা দিক হলো হ্যালুসিনেশন, যার কারণে গ্রহণকারী কলল্পনার জগতে থাকবে সারাক্ষণ। আবার এর ফলে ইলিউশন হয় যেটি হ্যালুসিনেশন থেকে আলাদা একটি বিষয়। আপনি যেটি দেখছেন মূল বস্ত্রটি আসলে সেটা নয়। যেমন সামনে একটি রশি পরে আছে কিংবা ঝুলে আছে কিন্তু গ্রহণকারী সেটাকে সাপ ভাবছেন এবং চোখে সাপ দেখছেন। ফলে এ মাদক গ্রহণে বিভিন্ন রকম খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ মাদক গ্রহনে হ্যালুসিনেশন যদি কোন কোন ব্যাক্তির জীবনে দীর্ঘায়িত হয় তাহলে মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং মানসিক রোগী ব্যাক্তি পাগল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পুলিশের গোয়েন্দা এ কর্মকর্তা আরও বলেন, এ সকল মাদক বিপনণ, গ্রহণ এবং ক্রয় তিনটির যে কোনও একটির সঙ্গে জড়িত এমন কোন তথ্য পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে যারা কোন মাদক গ্রহণ করে না এবং তাদের কাছে তথ্য আছে যেসব তরুণ-তরুণীরা এসব মাদক গ্রহণ করছে এমন কোন তথ্য থাকলে আমাদেরকে দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করবো। বিশেষ করে অবিভাবকের এ বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে। যেন ছেলেমেয়ারা মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক (ঢাকা গোয়েন্দা) মো. শামিম আহম্মেদ বলেন, ২০১৯ সালের জুলাই মাসের ১৫ তারিখে রাজধানীর কাফরুল থানায় একটা মামলা হয়েছিল যার মামলা নং ২১। যেখানে এলএসডির ৪৬টি স্ট্রিকসহ দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ মামলটির তদন্ত শেষে ইতিমধ্যে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়ে গেছে। এর পরে সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন করে আবার সামনে আসলো এ মাদকদ্রব্যটি।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, এলএসডি সাধারণত অন্যান্য মাদক থেকে অনেক ক্ষতিকর একটি মাদক। এটি ব্যবহারে এক ধরণের উত্তেজনা তৈরি হয় যেটি তাকে ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। এটি গ্রহণের ফলে ব্যাক্তির চোখের সামনে অনেক কিছু ভাসবে তবে সেটির বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। যেমন সে ঘরে বসে দেখছে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে কিংবা উড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত হ্যালুসিনেশনের কারণে এমনকি আত্মহত্যাও করতে পারে। এসব মাদক সাধারণত অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েরা গ্রহণ করে থাকে। যেটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভয়ানক।
এর চিকিৎসা বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, এলএসডি মাদক যারা নিচ্ছেন বা যারা এ মাদক গ্রহণে অতিরিক্ত আশক্ত হয়ে যাচ্ছে এদের চিকিৎসা অন্যান্য মাদক সেবনকারীর মতোই। তবে এলএসডি এমন ভয়ানক মাদক যেটি বেশি মাত্রায় গ্রহণের ফলে হিংস্রতা বেড়ে যায়। অনেক সময় গ্রহণকারীর অতীত মনে পড়ে যায়, কখনো কখনো নিজেকে অতিমাত্রায় শক্তিশালী মনে করে। রাগান্বিত হয় ও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং ডিপ্রেশন বেড়ে যায়। প্রথমতো এসব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। সাধারণত ধীরে ধীরে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে হয় অথবা একেবারে সম্পূর্ণরূপে মাদক থেকে বিমুখ রাখতে হয়। আর সে জন্য আমরা কিছু এন্টিবায়োটিক দিয়ে যাবো যেন শারীরিক কোন নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। এ রোগী ওষুধ নেয় আবার মাদক নেয় একসঙ্গে তাহলে কোন কাজ হবে না রোগীর ডাবল ক্ষতি হবে। কারণ ওষুধ নেওয়ার পর তার সাময়িক সময়ের জন্য হ্যালুসিনেশন কিছুটা কমবে কিন্তু আগের মতোই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ নতুন মাদক এলএসডি’র (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড) সন্ধান পায় পুলিশের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ। পরে এলএসডি মাদক বিক্রির অভিযোগে হাফিজুরের ৩ বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার (২৬ মে) রাতে রাজধানী থেকে তাদের গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগ।
গ্রেফতার হাফিজুরের ৩ বন্ধু হলো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুপল ও তুর্জ এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব। গ্রেপ্তার তিন তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে মাদক বিক্রি করতো। তারা ‘আপনের আব্বা’ ও ‘গ্রেট ব্রাইনি এন্ড বিয়ন’। এই দুটির মাধ্যমে মাদক বিক্রির কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। এগুলোর মাধ্যমে তারা এলএসডি ও গাঁজার নির্যাস দিয়ে তৈরি এক ধরণের ‘গাঁজার কেক’ বিক্রি করতো। এই ‘গাঁজার কেক’ নতুন উদ্ভাবন বলে দাবি তাদের।
বৃহস্পতিবার (২৭ মে) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার সংবাদ সম্মেলনে করে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।