চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরবেই – সাবেক পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন

PicsArt_02-10-11.31.38.jpg

চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরবেই – সাবেক পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন

বিশেষ প্রতিবেদকঃ জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্স থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরানো হবেই বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমানের কবর প্রতিস্থাপনকে ‘ইডিয়টিক’ সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে সাবেক পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরবেই। একদিন না একদিন এটা সরানো হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবরস্থান এখান থেকে সরিয়ে লুই আই কানের নকশা বাস্তবায়ন করবেন বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের সভায় জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিলের প্রসঙ্গক্রমে কবর সরানোর বিষয়টি উঠে আসে।

খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তার খেতাব পাওয়ারই কথা ছিল না। ওই সময় যাচাই-বাছাই না করে খেতাব দেওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। ভালো করে যাচাই করে দেওয়া হলে জিয়াসহ আরও অনেকে হয়তো এ ধরনের খেতাব পেতেন না।

সংসদ কমপ্লেক্স এলাকায় জিয়াউর রহমানের কবর প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘একটা কমপ্লেক্স করা হয়েছে। তার মধ্যে কোনও কবরস্থান ছিল না। সেটাকে কবরস্থান করা হলো। জাতীয়ভাবে এটি ছিল একটি ইডিয়টিক সিদ্ধান্ত। এখানে ব্যক্তি কোনও বিষয় নয়। ডিজাইনে কোনও কবরস্থান নেই। সেটা কেন করা হলো? একেবারে সংসদ ভবনের নাক বরাবর কবর দেওয়া হলো। লুই আইকানের যে ডিজাইন আছে সেখানে কবরের কোনও অস্তিত্ব নেই। নকশা না মেনে কবরস্থানে যাওয়ার জন্য সেখানে একটি বেইলি ব্রিজও করা হলো।’

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘লুই কানের নকশা এখন আমাদের কাছে আছে। নকশা অনুযায়ী সংসদের মধ্যকার কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের যে কবর আছে তা এখান থেকে সরানো হবে। প্রধানমন্ত্রী সংসদ কমপ্লেক্স এলাকার সব নকশাবহির্ভূত স্থাপনা সরিয়ে নকশার বাস্তবায়ন করবেন।’

প্রসঙ্গত, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে জিয়াউর রহমানের কবর সরানোসহ নকশাবহির্ভূত অন্যান্য স্থাপনা সরানোর ঘোষণা আসে। সে অনুযায়ী উদ্যোগ নিয়ে ২০১৬ সালের শেষ দিকে লুই আই কানের নকশা দেশে আনা হয়। তবে নকশা আসার পর সে রকম কোনও কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের কবর এবং অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে লুই আই কানের মূল নকশায় ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার বিগত মেয়াদের প্রথম দিকে (২০১৪ সালে) উদ্যোগ গ্রহণ করে। ওই সময়ে সংসদ ভবন এলাকায় নকশাবহির্ভূত সব ধরনের নির্মাণকাজও বন্ধ করে দেয় সরকার। নকশার বাইরে সব ধরনের স্থাপনা ভাঙারও সিদ্ধান্ত হয়। একই বছরের ১৭ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় জিয়াউর রহমানের কবর সংসদ ভবন এলাকা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সময় লুই আই কানের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংসদ ভবনের মূল নকশা আনারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর আগে সংসদ ভবন মূল নকশায় ফিরিয়ে আনতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, ‘শেরেবাংলা নগরে সংসদ ভবনের মূল নকশায় জিয়াউর রহমানের কবরের কোনও জায়গা নেই’। ওই প্রস্তাবে অন্যান্য নকশাবহির্ভূত স্থাপনাও সরানোর প্রস্তাব দেয় মন্ত্রণালয়।

পরে ৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, সংসদ ভবনকে তার মূল নকশায় ফিরিয়ে আনা হবে। এ সময় নকশা ফেরত আনার উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে সংসদের প্রশ্নোত্তরে তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, স্থপতি লুই আই কানের প্রণীত মূল নকশায় সংসদ ভবন চত্বরের কোথাও কোনও কবরের চিহ্নই ছিল না। কোথাও কবরস্থান দেখানো হয়নি। তবে আমাদের উদ্দেশ্য কারোর কবর সরানো নয়, লুই আই ক্যানের অমর এই স্থাপত্যশিল্পকে রক্ষা করা। তাই আমরা মূল নকশায় ফিরে যাবো।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানের মূল নকশা আনায় সরকার। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাফেজখানা থেকে লুই আই কানের তৈরি করা ৮৫৩টি নকশা ঢাকায় আনা হয়। পরে তার এক কপি স্থাপত্য অধিদফতরকে দেওয়া হয়।

তবে নকশা দেশে আসার পর জিয়াউর রহমানের কবর সরানো বা মূল নকশায় ফেরত আসার বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনও পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অবশ্য, সংসদ কমপ্লেক্স এলাকাকে মূল নকশার আদলে ফেরত আনতে উদ্যোগ দেখা না গেলেও সংসদ ভবনের মধ্যে নকশাবহির্ভূত যেসব রুম বা স্থাপনা করা হয়েছে তা অপসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

করোনা সংক্রমণকালে গত বছর ২৬ জুলাই সংসদ ভবনের সংস্কার বিষয়ক এক সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, লুই আই কান বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ও আশপাশের এলাকার যে নকশা করেছিলেন, সেই অনুযায়ী সংস্কার করা হবে।

সংসদকে লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী সবকিছু সাজানোর বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে তার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সংসদের সংস্কার কাজ সম্পন্ন হবে।

সংসদ ভবন এলাকায় লুইকানের নকশার বাইরেও কিছু স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার দুই দিন পর তার কবর ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যানে প্রতিস্থাপন করা হয়। ক্রিসেন্ট লেকে ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ করা হয়।

এছাড়া নকশাবহির্ভূতভাবে সংসদ কমপ্লেক্সের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খানের কবর রয়েছে। কবর ছাড়া শেরেবাংলা নগরে লুই কানের নকশাবহির্ভূত আরও কিছু স্থাপনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রটি (বিআইসিসি) নকশাবহির্ভূত বলে অনেকে উল্লেখ করলেও সংসদে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এটি নকশাবহির্ভূত নয়। মূল নকশায় সংসদ কমপ্লেক্সের ওই কোনার দিকে একটি সম্মেলন কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা আছে।

সংসদ ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে। স্থপতি মাযহারুল ইসলামকে সংসদ ভবনের নকশার দায়িত্ব দেওয়া হলেও তার প্রস্তাবে লুই আই কান প্রধান স্থপতি হিসেবে কাজ করেন। আর আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ ভবনের উদ্বোধন করা হয় ১৯৮২ সালে ২৮ জানুয়ারি।

সামনে ও পেছনে বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠসহ ২০৮ একর জমির ওপর জাতীয় সংসদ ভবন লুই কানের নকশার প্রথম ধাপ। এর চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানে লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ চত্বর। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলার কথা সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।

জিয়াউর রহমানে খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে যা বললেন, জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলে মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পদক বাতিলের প্রসঙ্গ তো এখন আসছে। এদের তো পদক দেওয়াই ‍উচিত ছিল না।’

স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় যে পদক দেওয়া হয়েছে তার প্রক্রিয়াটি যথাযথ ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এগুলোর জন্য জেনারেল ওসমানীই দায়ী। বঙ্গবন্ধু অন্ধের মতো বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর সব দায়িত্ব তাকে দিলেন। এই খেতাবগুলো দেওয়ার আগে অন্তত ছয় মাস যাচাই-বাছাই দরকার ছিল। কিন্তু উনি কী করলেন, ১১ জন সেক্টর কমান্ডারকে বীর উত্তম করে দিলেন। যুদ্ধ করুক আর না করুক। আমি একটি সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলাম। দেখেছি কার বন্দুক থেকে কয়টা গুলি বেরিয়েছে। কে বর্ডার ক্রস করে যুদ্ধ করেছে। নান অব দেম।’

তিনি বলেন, ‘আমি জিয়াউর রহমানকে ভালো করেই চিনি। আমার সঙ্গে এক বিছানায় এক সপ্তাহ ছিল। তারপর তাকে সেক্টর কমান্ডার করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কী যুদ্ধ করেছে না করেছে তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top