এখনো অস্ত রাগে নয় টেস্ট ক্রিকেট – অঘোর মন্ডল

এখনো অস্ত রাগে নয় টেস্ট ক্রিকেট – অঘোর মন্ডল

গাব্বায় কী দেখলো ক্রিকেট বিশ্ব? কেন, ভারতের জয়। হ্যাঁ,জয়। ভারত শুধু টেস্ট জিতলো না, সিরিজও জিতলো। যে জয়ের গায়ে ঐতিহাসিক, অভাবনীয়, অকল্পনীয়, অবিস্মরণীয়, অসাধারণ- অনেক তকমা এঁটে দেয়া হচ্ছে। এবং তার কোনটাই বাড়াবাড়ি নয়। তবে হ্যাঁ, হার-জিত যারই হোক, টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ বলতে হবে এটাকে।

ব্রিসবেনে ক্রিকেট বিশ্ব যা দেখলো; আসলে তা শুধু একটা টেস্ট ম্যাচ নয়! এটা ছিল টেস্টে চোয়ালবদ্ধ ধৈর্যশীল লড়াই, ওয়ানডের আগ্রাসী মানসিকতা আর টি-টোয়েন্টির ভয়ডরহীন জয়মন্ত্রে দীক্ষিত ক্রিকেটের মিশেলে তৈরি ক্রিকেটের নির্যাস। ওয়ানডে ক্রিকেটের উত্তেজনা, টি-টোয়েন্টির মারদাঙ্গা মেজাজে বুঁদ হয়ে থাকা অনেকেই টেস্ট ক্রিকেটের অস্তরাগ দেখতে শুরু করেছিলেন। বলতে শুরু করেন, টেস্ট ক্রিকেট শেষ! পাঁচ দিনের টেস্ট এখন মৃত্যু পথযাত্রী! ব্রিসবেনে ভারত-অস্ট্রেলিয়া তাদের ভুল প্রমাণ করে দিল। শুধু ব্রিসবেন টেস্ট নয়, গোটা সিরিজ ছিল টেস্ট ক্রিকেটের দারুণ দারুণ বিজ্ঞাপনের প্যাকেজ।

অ্যাডিলেডে গোলাপী বল দিয়ে দিন-রাতের টেস্ট দিয়ে সিরিজ শুরু। প্রথম ইনিংসে লিড নেয়া ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৬ রানে অলআউট! আট উইকেটে হার! পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে অধিনায়ক বিরাট কোহলির দেশে ফিরে আসা। বিশেষজ্ঞদের ভবিষৎদ্বাণীর কাজটা আরও সহজ হয়ে গেলো। ৪-০ তে হারতে পারে ভারত। কিন্তু ক্রিকেটীয় শাশ্বত সেই অমরবাণীকে সামনে নিয়ে এলেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা; ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা! সিরিজে বলের রং বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতো থাকলো ভারতীয় দলটা। গোলাপী বলের জায়গায় লাল বল দিয়ে মেলবোর্নে শুরু হলো বক্সিং ডে টেস্ট। খাদের কিনার থেকে একটা দল কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, এমসিজিতে সেটা করে দেখালো ভারত। এরপর সিডনিতে হার এড়ানোর লড়াই। হার না মানা মানসিকতা দিয়ে সেখানে লড়লেন তারা। অস্ট্রেলিয়াকে জয় বঞ্চিত করলেন।

তারপর ব্রিসবেনে, যেখানে গত ৩৮ বছরে কোন টেস্ট হারেনি অস্ট্রেলিয়া। গাব্বা-অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দুরগে এভাবে ফাটাল ধরাবে এক ঝাঁক আনকোরা তরুণ তুর্কি, সেটা ছিল অভাবনীয় ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের কাছে। কিন্তু যা ভাবা যায় না, সেটাই ক্রিকেটে ঘটে বলেই ক্রিকেট এতো অতুলীয়।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ানদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার নজির খুবই আছে। সেখানে পরাশক্তির অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে ০-১ এ পিছিয়ে পড়ে সিরিজ জয়, সত্যিই ব্যাখ্যা করা কঠিন। একেবারে তরুণ একটা দল নিয়ে ভারত সেই কাজটা করেছে। গোটা ভারত জুড়ে ক্রিকেট আবেগের বন্যা বয়ে যাবে এটা খুব স্বাভাবিক। সেই আবেগে ভাসছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী থেকে আমজনতা সবাই।

আবেগের এই স্রোত একটা সময় হয়তো থেমে যাবে। তারপরও ক্রিকেট ঐতিহাসিকদের কাছে এই সিরিজ গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। শচীন-সৌরভ-রাহুল-শেবাগ-লক্ষণ- কুম্বলে-ধোনি-বিরাট এর মত বিরাট কোন নাম নেই; এই দলে, অথচ সেই দলটাই কীনা করোনার এই অতিমারির মধ্যে অজি বধ করলো! তাও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে! আপাতত এর ব্যাখ্যা-ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন যুগের সূচনা। যার পেছনে আছে তাদের ক্রিকেটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আর ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে সম্পাদশালী বোর্ডের মাথায় আছেন এমন একজন লোক যার ক্রিকেট মেধা আর অভিজ্ঞতা ঈর্ষণীয়।

ভারতের যে কোন তরুণ করপোরেট জগতের আর দশটা পেশার মত ক্রিকেটকেও পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার কথা ভাবতে পারেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার যোগ্যতাটুকু অর্জন করতে পারলে বাকি জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কিছু ভাবতে হচ্ছে না তাদের। আইপিএল দিচ্ছে তরুণ ক্রিকেটারদের নিজেদের প্রমাণ করার মঞ্চ। আর তাদের ঘঁষে-মেজে চকচকে করার জন্য রয়েছে রাহুল দ্রাবিড়ের পরিচালনায় ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি।

ওয়াাশিংটন-ঠাকুর-আগারওয়াল-হানুমা বিহারী-পান্ট-গিল-সিরাজ-নটরাজন-রা সেই একাডেমির প্রোডাক্ট। ভালো পণ্য উৎপাদন করতে না পারলে তা বাজারে বিপণন করা যায় না। সেটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। যার ফসল এখন তারা পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে বাকি ক্রিকেট বিশ্বের কাছে সেই বার্তাটাও দিল ভারতীয় দল। দেশজ ক্রিকেট মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহারে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের অস্ট্রেলিয়া বধ।

টেস্ট ক্রিকেট নিস্তরঙ্গ-নিঃস্প্রাণ- উত্তেজনাহীন হয়ে পড়েছে, সেখানে প্রাণের স্পন্দন ফেরাতে ভ্যাকসিন দরকার, এমন চিন্তা অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, গাব্বায় সেই ভ্যাকসিনের ফরমুলা আবিষ্কার করলো ভারত-অস্ট্রেলিয়া। একুশ শতকের টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে- ধৈর্য এবং ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফুল প্যাকেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top