মুক্তিযুদ্ধ শুধু মাত্র যুদ্ধ নয় একটি চেতনার নাম – শাহানা সিরাজী
এক সাগর রক্তের বিনিময় আমাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার বীজ বপন হয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে। আমরা বুঝে গিয়েছি পাকিস্তানের সাথে আমাদের থাকা হবে না। আমাদের ভাষার উপর হস্তক্ষেপ, অর্থনীতির উপর হস্তক্ষেপ আমাদের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে পড়ে। আমরা এক রাষ্ট্র না হয়ে পাকিস্তানী শাসকেরা আমাদের সাথে উপনিবেশিক আচরণ করে . পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের প্রদেশ মনে করে।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সর্বাধিক আসন পাওয়া সত্ত্বেও তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। নানা রকম অত্যাচার চালাতে থাকে। দফায় দফায় মিটিং মিছিল হলেও তারা ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে নারকীয় নির্যাতন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী সাজানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সকল চেষ্টাকে বৃথা বানিয়ে দিয়েছে এ দেশের জনগণ।
বিশেষত ১৯৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অবজ্ঞা, প্রতিরক্ষায়, বেসামরিক প্রশাসনে এমন কী শিল্প সাহিত্যের উপর যে ধাক্কা আসে তার আবশ্যম্ভাবী রূপ হলো মুক্তি বা স্বাধীনতার আন্দোলন। অথচ কথা ছিলো যেহেতেু তাদের সাথে আমাদের ধর্মের মিল আছে আমরা পরস্পর এক হয়ে থাকবো। পূর্ব বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি। তাই এ বাংলার মানুষের উৎপাদিত পণ্য ভোগ করতো তারা, আমাদের জনগনের ভাগ্যে সেই অভাব অত্যাচার লেগেই ছিলো। ছয়দফা দাবী সময়ের ব্যাপার ছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবী তুললেন, এ জন্য তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। এরপর ৬৯ এর গণআন্দোলন স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরো তরাণি¦ত করে। শেষ পর্যন্ত ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রির ঘটনা ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধকে সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ঘোষণা অনুযায়ী এ দেশের আপামর জনসাধারণ এ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের জানমালের এতো ক্ষয়ক্ষতি করতে পারার কথা ছিলো না। আমাদের দেশীয় মানুষেরা যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন না দেখে কেবল আমরা একই ধর্মের মানুষ একসাথে থাকবো। দেশ স্বাধীন হলে ধর্ম চলে যাবে । সুতরাং ধর্ম রক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাহায্য করো। তারা গঠন করলো রাজাকার, আল বদর ,আল শামস বাহিনী। দেশের অনগ্রসর কুশিক্ষিত জনগোষ্ঠির কাছে শিল্প সাহত্য ছিলো পাপের বোঝা( তারা এখনো তাই মনে করে) মুক্তমনা মানুষ ছিলো তাদের কাছে ভয়ের ব্যাপার। পুরো নয় মাস ব্যাপী এ দেশের স্বপ্নবাজ তরুণদের প্রগতিমনা মানুষদের পাকিস্তানী সেনাদের কাছে ধরিয়ে দিয়ে গণহত্যা করিয়েছে। রাযেররবাগ বধ্যভূমি, মিরপুর বধ্যভূমি তার প্রমাণ। অনেক বুদ্ধিজীবীল লাশ সনাক্ত করাও যায়নি। সর্বশেষ যখন পাকিস্তানী বাহিনী বুঝতে পারলো তারা পারবে না রুখতে, রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ^বিদ্যালযের শিক্ষক ড.মুনীর চৌধুরী. ড.গোবিন্দ চন্দ্র দেব,ড, মোফাজবজণ হায়দার চৌধূরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড.আবুল খায়ের. ড. জ্যেিির্তময় গুহঠাকুরতা ,ড. সিরাজুল হক খান,অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি চিকিৎসক,মীর আবদুল কাইউম, মনোবিজ্ঞানী, অধ্যাপক ডা.আব্দুল আলীম চৌাধূরী,শহীদুল্লাহ কায়সার. সেলিনা পারভীন সাংবাদিক, রণদা প্রসাদ সাহাসহ এ দেশের অসংখ্য জ্ঞানীগুণী প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব যারা স্বাধীন বাংলায় বেঁচে থাকলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতো তাদের ধরে ধরে হত্যা করেছে। কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার শিক্ষাকে ধ্বংস করো, তার প্রগতিশীল মানুষদের মেরে ফেলো। রাজাকারের সাহায্যে তারা সেটাই করে ছিলো। ঘরের শত্রু বিভীষণ! এ দিনকে তাই শহীদবুদ্ধিজীবী দিবস বলা হয়। আজ ১৪ ডিসেম্বর সে ভয়াবহ দিন। আমরা শ্রদ্ধা ভরে তাদের স্মরণ করি । তাদের শূন্যতা এ দেশ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
ডা. ফজলে রাব্বি ডা. আব্দুল আলীম ছিলেন দেশের মেধাবী ডাক্তারদের শিরোমণি, মুণীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার এদের কোন বিকল্প আজ অবধি দেখা যাচ্ছে না। রাজাকার বাহিনী নিজের দেশের সমৃদ্ধির কথা না ভেবে শেষ পর্যন্তও পাক বাহিনীর তাবেদারী করে এ দেশের বারোটা বাজিয়ে দেশকে মেধা শূন্য করেছে। যার খেসারত আজো এ দেশে দিয়ে যাচ্ছে। এখনো রাজাকারীয় মনেবৃত্তির ব্যক্তি পদে পদে দেশকে রক্ষণশীল-কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রাখার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বিজ্ঞান র্চ্চা শিল্প সাহিত্য র্চ্চা ব্যক্তির মনোজগতে নান্দনিক সৌন্দর্যবোধ তৈরি করে এ সত্যটি আজো রাজাকার বাহিনী লালন করে না।
বর্তমানে দেশে সিনিয়র সিটিজেন প্রচন্ড অবহেলায় দিনাতিপাতকরছে। মনের সুকুমার বৃত্তির যদি লালন হতো তাহলে বৃদ্ধ পিতামাতা শ^শুর-শ^াশুড়ি অবহেলায় ধুকে ধুকে মরতো না। অন্য দিকে জ্ঞান বিজ্ঞানের দরজা কেবল মাত্র পরীক্ষা পাস কেন্দ্রীক , চাকুরী পাওয়া কেন্দ্রীক হয়ে গেছে । ফলে এদেশ দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে। এখানে মূল্যবোধ জিরো পজিশনে চলে এসেছে।
একমাত্র সঠিক পথ রচনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর ইতিবাচক পরিবর্তনের অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। সঠিক ইতিহাস রচনা, তা প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া এখন সময়ের দাবী।
আজকাল উঠতি প্রজন্ম মুক্তি যুদ্ধের কথা শুনতে চায় না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি। অবাক হয়ে দেখলাম তাদের ভেতর বেদনা নেই , হারানোর ব্যথা নেই। কেন এই দীনতা তা খুঁজে রিমেডি দেয়ার এখনই সময়।
শুধুমাত্র বছরে একদিন নয় প্রতিনিয়ত র্চ্চা করতে হবে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের গৌরবগাঁথা। তাদের পরিবার কেমন আছে তা জানাও জরুরী। মুক্তিযুদ্ধ শুধু মাত্র যুদ্ধ নয় একটি চেতনার নাম, হাজার বছরের পথের নাম, একটি জাতির অস্তিত্বের নাম, একটি রাঙা সূর্যের নাম, স্বাধীন সার্বভৌম একটি ভূ-খ-ের নাম, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার নাম । এর সঠিক মানচিত্র প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিয়ে যেতে হবে।
১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এ দিবস আনন্দের হলেও এর গায়ে লেগে আছে লাখো শহীদের রক্ত, হাজার নারীর আর্তচিৎকার। লক্ষ শিশুর পিতৃ¯েœহবিহীন বঞ্চনার করুণ বিলাপ। তবুও আমাদের বিজয় দিবস আসুক মুক্ত চেতনার বার্তা নিয়ে , আসুক মেরুদ- সোজা করে পদ্মা সেতুর মতে, আসুক প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের পাতা হয়ে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যারা প্রাণ দিতে দ্বিধাবোধ করেনি তাদের ত্যাগকে ধারণ করে অসাম্প্রদায়ীক দেশ গঠনে ভূমিকা পালন করতে হবে। এদেশ সকলের, এখানে আস্তিক, নাস্তিক, হিন্দু-মুসলিম- বৌদ্ধ -খ্রিস্টান সকলেই সমঅধিকার নিয়ে বাস করবে। পরস্পর সুখে -দুঃখে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটবে। দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবে।
দেশ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায় –অবিচার চিরতরে মুছে দিয়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বজায় রেখে চলবে। তাহলে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি লাভ করবে।
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ)
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।