স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করবে সরকার?
বিশেষ রিপোর্টঃ আসছে শীত মৌসুমে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে, আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা আগেই করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই অনুযায়ী সরকারও নিচ্ছে নানা প্রস্তুতি, রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনাও। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রস্তুতি নিলেই চলবে না, সেগুলো জনগণকে মানাতে হবে, প্রয়োজনে বাধ্য করাতে হবে।
গত ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তার আগের দিন প্রধানমন্ত্রী করোনা মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। এর অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের বিদেশফেরত বা আগতদের সবার করোনা টেস্ট এবং কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হওয়া করোনা মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কার কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, ‘যখনই করোনা দেখা দিয়েছিল, দেশেও যখন এটা আসতে শুরু করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমরা ২১ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলাম। আবারও এখন সময় এসে গেছে, এখন থেকে বাইরে থেকে যারা দেশে আসবে তাদের পরীক্ষা করা, তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা, এটা আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি বন্দরেই আগের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।’
একইদিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ শাহরিয়ার আলম জানান, সামনের দিনগুলোতে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার কারণে আগেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। বিদেশফেরতদের মাধ্যমে যাতে করোনা ছড়াতে না পারে সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।
দেশের করোনা হাল
গত ৮ মার্চ প্রথম তিন জন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে দেশে। সে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই রোগী শনাক্তের হার চলে যায় ২০ শতাংশের ওপরে। চলতে থাকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে এরপর থেকে শনাক্তের হার কমতে থাকে। প্রায় এক মাসের বেশি সময় থেকেই শনাক্তের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে ছিল। তবে গত ২ নভেম্বর রোগী শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশে।
সংক্রমণের মাঝের সময় জুন-জুলাইয়ের দিকে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) না পেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও গণমাধ্যমে এসেছে। তারপর থেকে সংক্রমণের হার কমার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা এবং সাধারণ শয্যা ফাঁকা থাকা শুরু হয়। শয্যা ফাঁকা থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল কমিয়ে আনে। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে রোগীর সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে।
চলতি মাসের শুরুর দিন থেকেই করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ১ নভেম্বরে রোগী শনাক্ত হয় ১,৫৬৮ জন, ২ নভেম্বর ১,৭৩৬ জন, ৩ নভেম্বর ১,৬৫৯ জন, ৪ নভেম্বর ১,৫১৭ জন এবং ৫ নভেম্বর ১,৮৪২ জন। ৫ নভেম্বরের শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল গত ৫৬ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর ৬ নভেম্বর শনাক্ত হন ১,৪৬৯ জন এবং ৭ নভেম্বর ১,২৮৯ জন। এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত হলেন চার লাখ ১৮ হাজার ৭৬৪ জন। আর করোনায় এখন পর্যন্ত মারা গেলেন ছয় হাজার ৪৯ জন।
মাস্ক ক্যাম্পেইন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘দেশের ভেতরে মাস্ক পরা যেহেতু একদমই কমে যাচ্ছে, তাই মাস্ক ক্যাম্পেইনকে আরও জোরদার করা হবে। এর আগে মাস্ক পরার সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাস্ক ক্যাম্পেইন মান্থ করতে চেয়েছিলাম, সেটাই আবার নতুন করে পরিকল্পনা হচ্ছে। এই তারিখ আগামী কয়েকদিনের মধ্যে চূড়ান্ত হবে।’
‘মাস্ক ক্যাম্পেইন মান্থ’-এ কী করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা ছিল সবার যেহেতু মাস্ক কেনার সামর্থ্য নেই তাই মাস্ক বিতরণ করা হবে প্রথম সপ্তাহে, দ্বিতীয় সপ্তাহে মাস্ক পরার বিষয়ে ক্যাম্পেইনটাকে জোরদার করা হবে আর তৃতীয় সপ্তাহে সচেতনতা বাড়ানো এবং মাস্ক দেওয়ার পরও যারা মাস্ক পরছে না, তাদের বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া।’
মাস্ক বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে তিনি জানান ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস-কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর সিভিল সার্জনদের মাধ্যমে করোনা বিষয়ক জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে বলা হয়েছে। দোকান মালিক সমিতি, আদালত, শীতকালীন সময়ে বিয়ে-পিকনিকের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোকে সীমিত বা অনুৎসাহিত করা হচ্ছে।
উদ্যোগ বাস্তবায়নে জনগণকে বাধ্য করতে হবে উল্লেখ করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস-কে অফিসগুলোতে কার্যকর করতে হবে। দোকান মালিক সমিতি বলেছে, নো মাস্ক, নো সেল—সেটা পালন করা হচ্ছে কিনা মনিটরিং করতে হবে। এগুলোকে কার্যকর করতে হবে। বিনা মাস্কে গণপরিহনে ওঠা যাবে না—একে কার্যকর করতে হবে। আর এগুলো কেউ না মানলে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে।’
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী আতিক আহসান বলেন, ‘সামনের দুই মাসে করোনার পরিস্থিতি আনএক্সপেকটেড হতে পারে। শীতের সময়ে আবহাওয়ার কারণে ঠান্ডাজনিত রোগ বেড়ে যায়, এর সঙ্গে করোনার প্রাদুর্ভাব সব জায়গাতেই বাড়তে পারে। আর এই সময়ে বৃদ্ধরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। অন্তত আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ঘরের ভেতরে তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে, যারা বাইরে যান তাদের।’
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘আলাদা করে শীতের জন্য প্রস্তুতির কিছু নেই, তবে যেসব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেওয়া ছিল এবং যেসব কাজ করা হচ্ছিল করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সেগুলোকে চালু রাখতে হবে। কিছু কিছু জয়গায় আরও জোর দিতে হবে। এরমধ্যে হাসপাতাল প্রিপারেশন—একটি বড় ইস্যু। আগে পরিকল্পনা ছিল, করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু শীতের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সেগুলো কমিয়ে না এনে সেভাবেই রাখা হচ্ছে।’
শীতের সময়ে করোনার সংক্রমণ কতটা ভয়ংকর হতে পারে জানতে চাইলে, আইইডিসিআর-এর সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘আমরা কীভাবে চলছি তার ওপর সংক্রমণ বাড়া-কমা নির্ভর করবে। মানুষ খুব নর্মাল হয়ে গেছে, তারা ধরেই নিয়েছে, করোনা কিছু না, কমন একটা অসুখ।’
মানুষের প্যানিক চলে যাওয়াতে একদিক থেকে ক্ষতিকর হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্যানিক থাকাটাও ভালো ছিল না ডেফিনেটলি, তখন অনেক ধরনের স্টিগমা ছিল যেগুলো ঠিক নয়, কিন্তু এখন একেবারেই করোনা নিয়ে মানুষ ভয় পাচ্ছে না বা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এটা একটু চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে।’
করোনায় রাজধানীর বিষয়ে তিনি জানান, ঢাকা নিয়ে চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। ঢাকায় রোগীর সংখ্যাও বেশি, ঢাকায় মানুষের যাতায়াত বেশি, ঢাকাই সেন্ট্রাল পয়েন্ট।
‘সংক্রমণ অলরেডি বেড়ে গেছে’ মন্তব্য করে করোনা বিষয়ক জাতীয় কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘শীতের সময়ে অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এর সঙ্গে যদি কোভিড আক্রান্ত হয় তাহলে তারা মডারেট টু সিভিয়ার হবে। তাদেরকে হাসপাতালে নিতে হবে দ্রুত। বিভাগীয় মেডিক্যাল কলেজগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট এবং অক্সিজেন লাইন তৈরি করতে হবে। নাজাল ফ্লো কেনোলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। কারণ হাসপাতালগুলোতে এটা পর্যাপ্ত না। এছাড়া মানুষকে উৎসাহ করার পাশাপাশি বাধ্য করতে হবে। আইনের প্রয়োগ করতে হবে, আইনের প্রয়োগ থাকা প্রয়োজন।’