ছুটির দিনে বই – হোসেন আবদুল মান্নান
আগামী প্রকাশনী’র স্টলে বসে দু’হাতে অটোগ্রাফস দিয়ে চলেছেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। বাংলা একাডেমির পুরনো আঙিনায় মানুষের মিলনমেলা। তাঁর বিখ্যাত নারী উপন্যাসটি ১৯৯৫ সালে নিষিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষিতে সে সময় তিনিও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বই নিষিদ্ধ হলে অধিকতর আলোচিত হয়। আলোড়ন তুলে চারদিকে। এটি সকল যুগেই হয়েছে। বলা বাহুল্য ১৯২৬ সালে বৃটিশ ভারতে আমাদের মাতৃভাষার কিংবদন্তি ও কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘পথের দাবি’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর পরই বইটি নিষিদ্ধ হলে এর চাহিদা এমনই বেড়ে গিয়েছিল যে, সরকারের সংরক্ষণ তালিকায় রাখার জন্য বইয়ের কতিপয় কপিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ‘নারী’ নিষিদ্ধ থাকাবস্হায় ১৯৯৮ সালে একুশের বই মেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রায় একই বিষয়ে রচিত অন্য বই ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ ‘। সেটিও অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল।
লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হলেও তিনি মূলত কবি, গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য অনন্যসাধারণ রচনাবলী। তাঁর ‘লাল নীল দীপাবলী’, ‘কতো নদী সরোবর’, ‘সাক্ষাৎকার’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’ এবং কবিতা আমাদের মা, বিজ্ঞাপনঃ বাঙলাদেশ ১৯৮৬ ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্হায় আমাদেরকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করেছিল।
লেখকের সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। তিনিও
অনিয়মিত ভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতেন। যদিও আমরা ক’জন তখন প্রায় নিয়মিত ছিলাম। ১৯৮৭, ‘৮৮ ও ‘৮৯ সালে উদ্যানের গোলচক্করে প্রয়াত প্রফেসর আহমদ শরীফের সান্ধ্যকালীন আড্ডায় পরিচিত হয়েছিলাম। মনে পড়ে, অনেক দিন একসঙ্গে ঘাসের বিছানায় বসে আমাদের সময়ের পন্ডিত ও বিপ্লবী আহমদ শরীফের বিদগ্ধ এবং বিচিত্রসব সংলাপ শ্রবণ করেছি। লেখক সরাসরি তাঁর ছাত্র ছিলেন বিধায় আলোচনায় সব সময় গুরুকে সমর্থন যোগাতেন। তবে অধ্যাপক ড.আবদুল্লাহ ফারুক, অধ্যাপক মোমতাজ উদ্দিন তরফদার বা অন্যান্য সমসাময়িকগন মাঝে মধ্যে খানিকটা অমত পোষণ করলেও শেষে এক পর্যায়ে ঐকমত্যে পৌঁছতেন। উদ্যানের পর্ব সমাপ্ত করে বেশ ক’দিন এ লেখকের একসাথে হেঁটে শাহবাগ এ্যভিনিউতে অবস্থিত ‘সেনোরিটা রেস্তোরাঁর ‘ খালি স্পেসটিতে বসেছি। সেনোরিটা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ক’জন বন্ধু চালাতেন।
আমি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাতে থাকা তাঁর বই দেখে তিনি আগ্রহ ভরে এগিয়ে নিলেন এবং লিখে দিলেন জনাব আবদুল মান্নানের জন্য শুভেচ্ছা। আমি সিভিল সার্ভিসে আছি তিনি জানতেন বলেই জনাব লিখেছেন। না হলে অবশ্যই সরাসরি মান্নানকে লিখতেন। সেদিন বই হাতে নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে আজিমপুরের বাসায় ফিরে আসি। বলে রাখা যায়, মধ্যে সাড়ে চার বছর নিষিদ্ধ থাকার পর তাঁর ‘নারী’ উপন্যাসটি পুনরায় প্রকাশিত হলে আমি তাও সংগ্রহ করি। ‘নারী’ উৎসর্গ করা হয় মেরি ওলষ্ঠোনক্র্যাফট্ ও বেগম রোকেয়াকে আর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ ‘ জন স্টুয়ার্ট মিল, সিমোন দ্য বোভোয়ার ও কেইট মিলেট কে।
‘ দ্বিতীয় লিঙ্গ ‘ ২৯৫ পৃষ্ঠার এ বইয়ে বিশ্বের সকল বিখ্যাত নারীবাদী লেখক, শিল্পী, সাহিত্যেক, মনীষী, রাজনীতিবিদগনের মতামত ও ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে। লেখক আধুনিক নারীবাদের প্রধান তাত্ত্বিক
সিমোন দ্য বোভোয়ার এর বই যার অর্থ নারী সেখান থেকে নিয়ে একই নাম ব্যবহার করায় তাঁর প্রতি ঋণী হয়ে সুখী হয়েছেন মর্মে স্বীকার করেছেন তিনি নিজেই। এতে কমপক্ষে বিশটি আলোচনা প্রবন্ধাকারে সন্নিবেশিত হয়েছে। নারীর দুই বিধাতা / নারীর পক্ষবিপক্ষঃ চার মহাপুরুষ / বালিকা / কিশোরী ও তরুণী /ভদ্রমহিলা উৎপাদন / রোকেয়ার নারীবাদ / রামমোহন ও বিদ্যাসাগর দুই ত্রাতা/ নারীবাদী সাহিত্যতও্ব ইত্যাদি। প্রতিটি প্রবন্ধেই তিনি নারী সম্পর্কে মহামানবদের উদ্ধৃতি সংযুক্ত করে দিয়ে আলোকপাত শুরু করেছেন।
বিশশতকের মহান ব্যক্তিত্ব ও স্থপতি নারীবাদী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ইহুদি পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিপক্ষে
বিশ্লেষণাত্বক সমালোচনাও শিক্ষনীয় এবং তাৎপর্যপূর্ন। নারীমুক্তির ত্রাতা হিসেবে ভারতীয় দুই সমাজ সংস্কারকের নাম চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এদের একজন রাজা রামমোহন রায় অপরজন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বলা হয়েছে, একজন দিয়েছেন নারীর প্রাণ অন্যজন মর্যাদা। ১৮১৮ বা ১৮১৯ সালের পূর্বে পর্যন্ত নারীর পক্ষে পৃথিবীতে আর কেউ এভাবে নামে নি। বইয়ের ভাষায়, ” পৃথিবীর আর কোথাও তাঁদের, অন্তত রামমোহনের আগে নারীর পক্ষে কোন পুরুষ কিছু লেখে নি,লড়াইয়ে নামে নি। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর পৃথিবীর দুই আদি নারীবাদী পুরুষ, মহাপুরুষ তাঁরা আইন প্রনয়ণ করিয়ে বাস্তবায়িত করেছিলেন নিজেদের সপ্ন। নারীদের ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণলিপিতে লেখা থাকার কথা “।
বেগম রোকেয়াকেও অসাধারণ অভিধায় স্বীকৃতি দেয়া
হয়েছে। রোকেয়ার গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস থেকে উক্তি
সর্বত্র ব্যবহার করা হয়েছে। “কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা
করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক” । নারীর পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব
রোকেয়া পুরোটাই করেছেন।
‘দ্বিতীয় লিঙ্গ ‘ সুখপাঠ্য, তথ্যসমৃদ্ধ, ও বহুপঠিত গ্রন্হের নিখাদ তথা নিখুঁত নির্যাস। অজানাকে জানায় আগ্রহী এক সত্যানুসন্ধ্যানী অকপট ভাষ্যকার চৌকস লেখকের শ্রমসাধ্য গ্রন্হ । কেবল সমকালীন নয়, ধ্রুপপদী সাহিত্যের ভুবনেও এর যথাযথ আসন সংরক্ষিত থাকবে বলে মনে হয়।
আবদুল মান্নান
লেখক ও গল্পকার
১৮ আশ্বিন, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।