আদালতে মামলাজট; কারন ও প্রতিকার – ড. এবিএম মাহমুদুল হক

PicsArt_09-17-10.48.53.jpg

আদালতে মামলাজট; কারন ও প্রতিকার -ড. এবিএম মাহমুদুল হক

ভূমিকা
মানুষ এমন এক বিচার বিভাগের স্বপ্ন দেখে যেখানে মামলা দায়েরের ২/৩ মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হবে, খুব অল্প খরচ হবে, আদালত চত্তরে সংশ্লিষ্ট সকলে খুব আন্তরিকতার সাথে মামলা সংক্রান্ত সকল বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করবে এবং আদালত যে রায় দিবে দ্রæত তা কার্যকর হবে। কিন্তু মামলাজটের কারণে এ স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন। এই মামলাজটের কারণে একদিকে যেমন বিচারপ্রার্থী জনগনের বিচার পেতে অনেক বিলম্ব হচ্ছে, তেমনি তার মূল্যবান সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে সেইসাথে ন্যায়বিচারও হচ্ছে বিঘিœত।

ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশদের প্রণীত আইনে আদালত সৃষ্টির পর হতেই এই মামলাজটের সৃষ্টি হয়। এর প্রধান কারন ছিল আইনে মামলা দায়ের থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত অনেকগুলো স্তরের উপস্থিতি। এসব স্তরের উদ্দেশ্য ছিল মামলার বিচার্য বিষয় সংক্ষেপ করা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যেয়ে প্রকারান্তরে আদালতে মামলার স্তুপ বাড়তে থাকে ও মামলাজটের সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীতে মামলার সংখ্যা ও জনসংখ্যার অনুপাতে বিচারক না বাড়ানো ও কার্যকর তদারকির অভাবে মামলাজটের আজকের এই ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের নি¤œ আদালতসমূহে প্রায় ৩৭ লক্ষ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর ১৭ কোটি জনগণের এই দেশে বর্তমানে বিচারকের সংখ্যা মাত্র ১৭০০ জন। এদেশের জনসংখ্যা আর মামলার সংখ্যার তুলনায় বিচারক সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। উপরন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ জনসংখ্যা ও মামলাসংখ্যার অনুপাতে বিচারক নিয়োগ না হওয়ায় মামলাজটের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান জনসংখ্যা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, মামলা সংখ্যা ও মামলা বৃদ্ধির হার বিবেচনায় প্রকৃতপক্ষে এদেশে কতজন বিচারক থাকা প্রয়োজন বা এই যে মামলাজট তা নিরসনের জন্য সুনির্দিষ্ট কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে বা ঠিক কি কি পদক্ষেপ নিলে আগামী ৪-৫ বৎসরের মধ্যে মামলাজট শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আনা সম্ভব সে বিষয়ে গবেষণার উদ্যোগ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে বা আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গ্রহণ করা হয়নি।

মামলাজট নিরসনের জন্য সময়ে সময়ে গঠন করা বিভিন্ন কমিটির প্রতিবেদন, আইন কমিশনের সুপারিশ, বিদেশী সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মামলাজট নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানের এই মামলাজট কি কি পরিকল্পনা গ্রহন করে কতদিনের মধ্যে নিরসন করা হবে এ বিষয়ে কোন “কৌশলগত পরিকল্পনা” বা “ঝঃৎধঃবমরপ চষধহ” গ্রহন করা হয়নি।
মামলাজটের এই সমস্যাকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে আদালতে মামলাজট নিরসন করা সম্ভব। এই বইয়ের পরবর্তী আলোচনায় মামলাজটের অতীত ইতিহাসের ও বর্তমান অবস্থা চিত্রিত করা হয়েছে। সেই সাথে মামলাজটের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং মামলাজটের নিরসনের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। উক্ত সুপারিশসমূহ দ্রæততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী ৪ থেকে ৫ বৎসরের মধ্যে মামলাজট শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব সেই সাথে এসব সুপারিশসমূহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ও কার্যকর মামলা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

মামলাজট নিরসনে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ

বিশ্বব্যাংক ১৯৯৯ সনে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে ২২৮ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়। উক্ত প্রজেক্টের নাম ছিল “লিগ্যাল এন্ড জুডিসিয়াল ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রজেক্ট”। উক্ত প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য ছিল আদালতে মামলাজট নিরসন করে কার্যকর আদালত প্রশাসন ও মামলা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। উক্ত প্রজেক্টের প্রাথমিক পর্যায়ে গাজীপুর ও খুলনায় বেইজ লাইন সার্ভে করা হয় ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫ টি জেলায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে ২১ টি জেলায় উক্ত প্রজেক্টের কাজ সম্প্রসারন করা হয়। যদিও উক্ত প্রজেক্টের লক্ষ্য ছিল কার্যকর আদালত প্রশাসন ও সুশৃঙ্খল মামলা ব্যবস্থাপনার প্রচলন করা যাতে করে আদালতগুলিতে মামলাজট নিরসন করা যায়। কিন্তু প্রজেক্টের কাজ শুরু হবার পর দেখা গেল যে, বিচারকদের এজলাশের তীব্র সংকট। কোন কোন জেলাতে বিচারকদের একেকটি চেম্বার ও এজলাশ ৩/৪ জনকে পর্যন্ত শেয়ার করতে হচ্ছে। সে প্রেক্ষিতে উক্ত প্রজেক্টের আওতাধীন জেলাগুলোতে বহুতল বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়। মামলাজট নিরসনের জন্য প্রজেক্টের জেলাগুলোতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে- কেন্দ্রীয় মামলা দায়েরের ব্যবস্থা, কেস ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা, জুডিসিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার নিয়োগ, অনলাইন কজলিস্টে ডাটা এন্ট্রি ইত্যাদি।

লিগ্যাল এন্ড জুডিসিয়াল ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ২১ টি জেলায় নতুন কোর্ট বিল্ডিং নির্মাণ। দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নকশায় অত্যন্ত সুন্দর নির্মাণ শৈলীতে যে কোর্ট বিল্ডিংগুলো নির্মাণ করা হয়েছে তা এক কথায় অসাধারন। এই প্রথম বিচার বিভাগে বিদেশী অর্থায়নে কোন ভালো কাজ হয়েছে মর্মে বলা যায়। এই প্রজেক্টের আরেকটি পার্ট ছিল মামলাজট নিরসন করা। প্রজেক্টে কর্মরত বিশেষজ্ঞদের সুপারিশমতে এদেশে মামলাজটের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বিচারকদের মামলার অসম বন্টন, বিচারকদের উপর নানা ধরনের প্রশাসনিক কাজের চাপ, সঠিক তদারকির অভাব, মামলাসমূহে অত্যাধিক মূলতবী করা, ইত্যাদি। উক্ত মামলাজট নিরসনে ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা প্রবর্তনে এই প্রজেক্ট কাজ করে গেলেও পরবর্তীতে এই প্রজেক্টের সময়সীমা শেষ হওয়ায় তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়নি।

দেওয়ানী আদালতসমূহে মামলাজটের কারণ
বর্তমানে বাংলাদেশে দেওয়ানী আদালতসমূহে মামলাজটের পরিমান সবচেয়ে বেশী। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, এদেশে দেওয়ানী আদালত প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনোই বেশীরভাগ আদালতে মামলার সংখ্যা অনুপাতে যে পরিমান বিচারক প্রয়োজন তা কখনোই ছিল না। ফলে দিনের পর দিন সব আদালতে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে কিছু আদালতে মামলা সংখ্যা এতো অপ্রতুল ছিল যে, বিচারককে বসে বসে বেতন নিতে হয়েছে। শুধু বিচারকের সংখ্যাই নয়। দেওয়ানী আদালতসমূহে মামলাজটের জন্য অনেকগুলো কারণ রয়েছে।

১) বিচারক স্বল্পতা
দেওয়ানী আদালতে মামলাজটের সবচেয়ে বড় কারণ বিচারক স্বল্পতা। ১৭ কোটি মানুষের দেশের দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থা সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য যে পরিমান বিচারক প্রয়োজন, তার অনেক অনেকগুন কম বিচারক নিয়ে দেওয়ানী আদালতসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। ফলে মামলাজট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৭০০ জন বিচারক কর্মরত থাকলেও শুধুমাত্র দেওয়ানী মামলা বিচার করে থাকে সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ পদের ৪৫০ জনের মতো বিচারক। এছাড়া যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজ পদের আরও ৩৫০ জনের মতো বিচারকও দেওয়ানী মামলার বিচারকাজ করে থাকেন। তবে তারা দেওয়ানী মামলার পাশাপাশি দায়রা মামলারও বিচারকাজ করে থাকেন।
যুগ্ম জেলাজজগণ একাধারে সহকারী দায়রা জজ হিসেবে চেক ডিসঅনার মামলা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনের মামলা, বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলা, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ ট্রাইব্যুনালের মামলা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মামলাসহ আরও বেশ কিছু প্রকারের মামলার বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সচরাচর তারা দায়রা ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলার বিচারকাজ শেষ করে যদি সময় থাকে তাহলে দেওয়ানী মামলা করেন। অবশ্য এতে তাদের কোন ত্রæটি বা অবহেলা রয়েছে তা বলা যায় না কেননা চেক ডিসঅনারের মামলা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা বা বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলায় সাক্ষী বেশীরভাগ সময়েই রেডি থাকে। আর দেওয়ানী মামলায় বেশীরভাগ সময়েই টাইম পিটিশন থাকে। অবশ্য দেওয়ানী মামলায় নিষেধাজ্ঞা শুনানীতে মাঝে মাঝে অ্যাডভোকেট ও পক্ষদের বেশ আগ্রহ থাকে যেগুলি মূল মামলা নিষ্পত্তির হিসেবের মধ্যে পড়ে না। সুতরাং তাদের মামলা নিষ্পত্তির হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মোট নিষ্পত্তিকৃত মামলার শতকরা ২০ ভাগ মামলাও মূল দেওয়ানী মামলা নয়। অথচ চার লক্ষ টাকার উর্দ্ধে যে কোন মূল্যমানের দেওয়ানী মামলার বিচার করার আদি এখতিয়ার যুগ্ম জেলাগণের (যদিও সংশোধন করে তা ২৫ লক্ষ করা হয়েছে, তা বর্তমানে মামনীয় সুপ্রিম কোর্টের আদেশে স্থগিত আছে)। অর্থঋন আদালত ও প্রেষনে কর্মরত বিচারকদের বাদ দিলে সারাদেশে উক্ত আদি এখতিয়ার প্রয়োগকারী যুগ্ম জেলাজজের সংখ্যা ১৫০ জনের মতো। উপরন্তু তারা ৮০ ভাগ সময় দায়রা মামলার বিচার নিয়ে ব্যস্ত। তাদেরকে শতকরা ২০ ভাগ দেওয়ানী আদালতের বিচারক হিসেবে বিবেচনা করলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ জন। অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষের দেশে ৪ লক্ষ টাকার উর্দ্ধে দেওয়ানী মামলার আদি এখতিয়ারসম্পন্ন বিচারক মাত্র ৩০ জন। ভাবা যায়?

সারাদেশে সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ পর্যায়ের কর্মরত বিচারকসংখ্যা ৪৫০ জনের মতো (প্রেষণে বিভিন্ন জায়গায় কর্মরতদের বাদ দিলে)। আবার যুগ্ম জেলাজজ থেকে শুরু করে জেলা জজ পর্যন্ত দায়রা আদালতের বিচারকদের সংখ্যা ৩৫০ জন। জেলাজজ ও অতিরিক্ত জেলাজজগণ সপ্তাহে সচরাচর একদিন দেওয়ানী মামলার শুনানী করে থাকেন। সেই হিসেবে তাদেরকে শতকরা ৮০ ভাগ দায়রা আদালতের বিচারক ও শতকরা ২০ ভাগ দেওয়ানী আদালতের বিচারক বললেও অতুক্তি হবে না। তাদেরকে শতকরা ২০ ভাগ দেওয়ানী আদালতের বিচারক হিসেবে বিবেচনা করলে অর্থাৎ তাদেরকে পূর্ণ দেওয়ানী বিচারকে রুপান্তরিত করলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ জনে। অর্থাৎ সারাদেশে মোট দেওয়ানী আদালতের বিচারক সংখ্যা ৪৫০+৭০=৫২০ জন। ১৭ কোটি মানুষের দেশের মোট দেওয়ানী আদালতের বিচারক মাত্র ৫২০ জন। সত্যিই এটি মারাত্বকভাবে অপ্রতুল।

সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজদের দেওয়ানী মূল মামলার আপীল আদালত জেলা জজ। যুগ্ম জেলাজজদের ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের দেওয়ানী মামলারও আপীল এখতিয়ার জেলা জজের। অতিরিক্ত জেলাজজগণও উক্ত আপীল শুনে থাকেন। সারাদেশে জেলাজজ ও অতিরিক্ত জেলা জজ রয়েছেন ২০০ জনের মতো। (বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে ও প্রেষণে কর্মরত ব্যতীত)। তারা সপ্তাহে সাধারনতঃ একদিন দেওয়ানী আপীল বা রিভিশন শুনে থাকেন। সেই হিসেবে তাদের সংখ্যা ৪০ জন। অর্থাৎ সারাদেশে সহকারী জজ ও যুগ্ম জেলা জজ মিলে ৬০০ জন বিচারকের দেওয়ানী আপীল ও রিভিশন শুনানীর জন্য বিচারক মাত্র ৪০ জন। কী ভয়াবহ চিত্র।

মজার বিষয় হলো বিচারকের এই পদসংখ্যা বা অরগানোগ্রাম ৩৭ বৎসর আগের। অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে নতুন উপজেলা ও জেলা সৃষ্টি হবার সময়ে এই অরগানোগ্রাম করা হয়েছে। তারপর এই দীর্ঘ সময়ে এদেশের মানুষ বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি থেকে ১৭ কোটি। সব সরকারী অফিসের জনবল বেড়েছে কমপক্ষে ১০ গুন থেকে ৫০ গুন পর্যন্ত। হাজার হাজার কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ জায়গা জমি বেচা কেনা করছে, নতুন নতুন বাড়ীঘর বা স্থাপনা নির্মান করছে। বিরোধ হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মামলা মোকদ্দমা হয়েছে ও হচ্ছে অথচ এই ৩৭ বৎসরে দেওয়ানী আদালতের বিচারকের পদ সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগ অর্থাৎ ৫০টি ও বাড়েনি। তাহলে কিভাবে আমরা মামলাজট কমানোর আশা করতে পারি। (যদিও নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, স্পেশাল জজ আদালত, পরিবেশ আদালত, দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনাল, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালসহ বেশ কিছু আদালত হয়েছে, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতেও কিছু পদ সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু প্রচলিত অর্থে সেসব আদালত দেওয়ানী আদালত নয়। সুতরাং বিচারকের স্বল্পতা দেওয়ানী আদালতে মামলাজটের সবচেয়ে বড় কারণ।

২) বিচারক পদের ত্রæটিপূর্ণ পদবিন্যাস ও মামলার অসম বন্টন
আদালতে মামলাজটের জন্য বড় কারণগুলোর অন্যতম হলো দেওয়ানী আদালতসমূহের বিচারক পদের ত্রæটিপূর্ণ পদবিন্যাস ও মামলার অসম বন্টন । এই ত্রæটিপূর্ণ পদবিন্যাসের ও মামলার অসম বন্টনের কারণে এখনও যেখানে বেশীরভাগ আদালত মামলার ভারে ভারাক্রান্ত অন্যদিকে কিছু কিছু আদালত রয়েছে যে সকল আদালতে মামলা সংখ্যা এতো কম যে তাদের মাসে পর্যাপ্ত সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করাই দুরুহ।
এই ত্রæটিপূর্ণ পদবিন্যাসের বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে দেওয়ানী আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে এই উপজেলাসমূহ ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। কিছু কিছু উপজেলা আদালতসমূহে অনেক মামলা ছিল। কিন্তু বেশীরভাগ উপজেলা আদালতগুলিতে মামলা সংখ্যা কম ছিল এবং কিছু কিছু উপজেলায় যাতায়াত ব্যবস্থা এতো দুর্গম ছিল যে, সেসব উপজেলায় কর্মরত বিচারকেরা খুব কমই কর্মস্থলে থাকতেন। সুতরাং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরনের মাধ্যমে প্রচুর বিচারকের পদ সৃষ্টি করা হলেও মামলাজটের অবস্থার উন্নতি হয়নি। উপজেলা পদ্ধতিতে একদিকে যেমন অধিক মামলা নিয়ে কিছু কিছু আদালত মামলা নিষ্পত্তিতে হিমসিম খাচ্ছিলেন অন্যদিকে মামলা না থাকায় বেশীরভাগ উপজেলা আদালতের বিচারক অলস সময় কাটাতেন ও বছরের পর বছর অপর্যাপ্ত নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম কোর্টের শো কজের মুখোমুখি হতেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিচারকের প্রচুর পদ সৃষ্টি করেও আদালতে জমে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে কাঙ্খিত সাফল্য সে সময়ে আসেনি। কেননা বিচারকের পদ সৃজনে সে সময় শুধুমাত্র উপজেলা ইউনিটকে বিবেচনা করা হয়েছে। জনসংখ্যা, মামলা সংখ্যা, ভৌগলিক আয়তন ইত্যাদি বিষয়সমূহ বিবেচনা করা হয়নিৎ ১৯৯১ সালের দিকে উপজেলা পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়। তখন সমস্ত উপজেলা আদালতসমূহকে জেলা আদালতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু জেলা আদালতগুলোতে ছিল না পর্যাপ্ত কোর্ট রুম, বিচারক বা কর্মচারীদের বসার জায়গা। তখন এমনও সময় ছিল যে, এক চেম্বারে ও এজলাশ ৩/৪ জন বিচারককে শেয়ার করতে হয়েছে। সেই সংকটের পর প্রায় ৩০ বৎসর অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত তার সম্পূর্ণ সমাধান হয়নি। আজও অনেক জেলায় বিচারকদের চেম্বার ও এজলাশ শেয়ার করতে হচ্ছে।

উপজেলা পদ্ধতি বিলুপ্তির পর উপজেলা আদালতগুলো জেলা সদরে স্থানান্তর করা হলেও সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতসমূহ একেকটি উপজেলা অধিক্ষেত্রের অনুকূলেই থেকে যায়। ফলে বিচারক প্রতি মামলার অসম বন্টন আগেকার মতোই রয়ে যায়। এখনো কোন কোন আদালত মামলার ভারে ভারাক্রান্ত আবার কোন কোন আদালতে পর্যাপ্ত সংখ্যক মামলাই নেই। বিচারক পদের বিন্যাস সুসম হলে যে পরিমান মামলা নিষ্পত্তি হতো এই ত্রæটিপূর্ণ পদবিন্যাসের কারণে সেই সংখ্যার কয়েকগুন কম মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এটাও মামলাজটের অন্যতম কারণ।

৩) দেওয়ানী আদালতসমূহে বিচারকের পদ দীর্ঘদিন শূণ্য থাকা
উপজেলা পদ্ধতি চাল্রু পর উপজেলা আদালতসমূহের শূূণ্যপদ পূরণের জন্য ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সনে দুই দফায় প্রায় ৩৫০ জন বিচারক নিয়োগ করা হয়। এসব বিচারকের বেশীর ভাগেরই উপজেলায় পদায়ন করা হয়। অনেক উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক দুর্গম হওয়ায় অনেক বিচারক যোগদান করেননি। আবার বেশ কিছু বিচারক যোগদান করেও পরে চাকরী ছেড়ে দেন। ফলে অনেক পদ শূণ্য থাকে। এরপর সপ্তম, অস্টম, নবম, দশম, একাদশ ও ত্রয়োদশ বিসিএসের মাধ্যমে ৫০-৬০ জন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়। তথাপি প্রায় শতাধিক পদ শূন্য থেকে যায়। ত্রয়োদশ বিসিএসের পর সপ্তদশ বিসিএস পর্যন্ত ১৯৯৪ সন থেকে ১৯৯৮ সনে অস্টাদশ বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ বৎসর কোনো বিচারক নিয়োগ হয়নি। তবে বিচার বিভাগের মূল শূণ্যতা সৃষ্টি হয় ১৯৯৮ সনের পর থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮ বৎসর বিচারক নিয়োগ না হওয়ায়।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পূর্বে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিচারকদের নিয়োগ করা হতো। ১৩ তম বিসিএসের মাধ্যমে ১৯৯৪ সনে ৪৫ জন বিচারক নিয়োগ করা হয়। তারপর দীর্ঘ ৪ বৎসর ৫ টি বিসিএস পরীক্ষায় কোন বিচারক নিয়োগ করা হয়নি। ১৯৯৮ সনে ১৮ তম বিসিএস এর মাধ্যমে ১৬২ জন বিচারক নিয়োগ করা হয়। এরপর ৪ টি বিসিএস বাদে ২২ তম বিসিএসে বিচারক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ও তাদের লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়।

এর মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় আপীল বিভাগ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। উক্ত রায় অনুযায়ী জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠন না হওয়ায় দীর্ঘদিন নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত থাকে। পরবর্তীতে ২৪ তম বিসিএসেও বিচার বিভাগে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। অবশেষে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠন হলে উক্ত কমিশনের মাধ্যমে ১৯৯৮ সনের দীর্ঘ ৮ বৎসর পর ২০০৬ সনে ২২ তম বিসিএসের ৭০ জন এবং ২৪ তম বিসিএসের ১৪০ জন মোট ২১০ জন বিচারক যোগদান করে।

১৯৯৪ সন থেকে ১৯৯৮ সন পর্যন্ত ৪ বৎসর এবং ১৯৯৮ সন থেকে ২০০৬ সন পর্যন্ত ৮ বৎসর বিচারক নিয়োগ না হওয়ায় বিচার বিভাগে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে মামলা নিষ্পত্তির হারও অনেক কমে যায়। বেশীর ভাগ জেলাতেই ৮-১০ টি সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজ পদের বিপরীতে কর্মরত থাকে ২/১ জন করে বিচারক আর কোন কোন জেলাতে তো কোন সহকারী জজই ছিল না। ফলে এক এক জন বিচারককে ৪/৫ জন বিচারকের দায়িত্বে থেকে কাজ করতে হয়েছে। উপরন্তু উক্ত আদালতসমূহের জরুরী বিষয়াদি ও প্রশাসনিক কাজেই আদালতগুলোকে বেশীরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। যে অল্প সংখ্যক বিচারক দায়িত্ব পালন করতেন, তারাও মূল মামলা নিষ্পত্তিতে মনযোগ কম দিতে পারতেন। ফলে মামলাজট দিনের পর দিন বাড়তে বাড়তে ভয়াবহ আকার ধারন করতে থাকে।

এছাড়াও বিচারক নিয়োগ হবার পর পুরনো বিচারকদের পদোন্নতি প্রদানে অনেক সময় মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের রশি টানাটানি, ফাইল দীর্ঘদিন ফেলে রাখা ইত্যাদি কারণে দীর্ঘদিন যুগ্ম জেলাজজ ও অতিরিক্ত জেলাজজ পদসমূহ শূণ্য থাকে। এর ফলে উক্ত আদালতসমূহেও দীর্ঘ মামলাজটের সৃষ্টি হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নিয়োগ না হওয়া ও পদোন্নতি যথাসময়ে না দেয়াও আদালতসমূহে মামলাজটের অন্যতম একটি কারণ।

৪) মামলাজট নিরসনে কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব
বাংলাদেশের আদালতগুলোতে যেভাবে মামলাজট দিন দিন বেড়েই চলেছে তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, আদালতসমূহের এই মামলাজট নিরসনের জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বা আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা নেই। এটা অনস্বীকার্য যে, বিচার বিভাগের মামলাজট নিরসন এবং কার্যকরভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন একটি কৌশলগত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার অভাবে একদিকে যেমন মামলাজট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি সাধারন জনগন পদে পদে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে।

সতেরো কোটি মানুষের দেশে দেওয়ানী আদালতের বিচারক সংখ্যা ৫ শত জনের মতো। যা খুবই অপ্রতুল। বর্তমান মামলাজট যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে নিরসনের জন্য ঠিক কতজন বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন এবং এই বিচারকের সংখ্যার বিপরীতে কতজন সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ করা প্রয়োজন বা বর্তমান বিচারকদের কিভাবে পদায়ন করলে তাদের সামর্থ্যরে সিংহভাগ ব্যবহার করা সম্ভব এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং এই পরিকল্পনার সাথে বিচারক, আইনজীবী, আইন প্রণেতা, সাংবাদিক, মামলার পক্ষ, সাধারণ জনগণ সহ কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।

৫) বিচারকদের পেশাদারিত্বমূলক মনোভাবের অভাব
পেশাদারিত্ব অর্থ সঠিক ব্যবহার, লক্ষ্য ও গুনাগুন বজায় রেখে কাজ করা, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, সৎভাবে কাজ করার উদ্যোম, দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা, সময়মতো কাজ শেষ করার প্রবনতা, হতাশ না হয়ে আশাবাদী থাকা। কর্মক্ষেত্রে উন্নতি চাইলে পেশাদারিত্ব আবশ্যক। ডিসিপ্লিন থাকা জরুরী। পেশাদারিত্বের উপর গুরুত্ব যত কম হয়, উন্নতি তত কম হয়। যে যত বেশী পেশাদার, তার উন্নতি হয় তত বেশী। যে সব প্রতিষ্ঠান পেশাদার নয় সেখানে ব্যক্তির পেশাদারিত্বও ব্যক্তিকে সামনে এগিয়ে দেয় না। সম্মিলিত পেশাদারিত্ব বা প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারিত্ব অর্জন করতে হবে।

সকল বিচারকের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সমান নয়। আমি অনেক বিচারককে দেখেছি আন্তরিকতার সাথে কাজ করে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী মাসে ৬-৮ টি মামলার স্থলে ৫০/৬০ টি মামলা নিষ্পত্তি করছেন আবার অনেককে দেখেছি, অনেক কাজ করার সুযোগ থাকা সত্বেও নূন্যতম কাজও করছেন না। শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা, এই সমস্যা, সেই সমস্যা বলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর খুবই অল্প স্বল্প কাজ করেই দিন অতিবাহিত করছেন।

যুগ্ম জেলাজজ পদের একজন বিচারকের কথাই ধরা যাক। তার নিকট বিচারাধীন থাকে চেক ডিসঅনারের মামলা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা, বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলা, সেসন মামলা এবং নানা প্রকারের দেওয়ানী মামলা। সে ইচ্ছা করলে দিনে ২/৩ টি চেক ডিসঅনারের মামলা ও ২/৩ টি মাদকের মামলায় সাক্ষী নিয়ে মাসে পর্যাপ্ত নিষ্পত্তি করতে পারেন। এতে তার চাকরীর নূন্যতম শর্ত পূরণ হলো ঠিকই কিন্তু পেশাদারিত্বের পরিচয় পাওয়া গেল না। সে যদি দিনে অন্তত ৪/৫ টি দেওয়ানী মামলার সাক্ষীসহ সবরকম মামলার ১০/১২ টি সাক্ষী নেন আবার সেই সাথে মাসে ৫/৭ টি দেওয়ানী মামলাসহ অন্ততঃ ২০/৩০ টি মামলা নিষ্পত্তি করেন তখন তাকে তার কাজের প্রতি আন্তরিক মর্মে বলা যায়। এটা করার জন্য তাকে যে দিন রাত পরিশ্রম করতে হবে তা নয় বরং আদালতের সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করলেই তা করা সম্ভব।
অনেকেই বলেন মামলা রেডী হয় না, সাক্ষী আসে না, উকিল সাহেবরা সময় চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মামলা রেডি করার দায়িত্ব তো বিচারকের। সাক্ষী সমন ঠিকমতো ইস্যু হচ্ছে কিনা, সেগুলো থানায় যাচ্ছে কিনা, সাক্ষীগুলির সাথে পুলিশ ঠিকমতো যোগাযোগ করতে পেরেছে কিনা ইত্যাদি বিষয় মনিটর করুন। দরকার হলে একজন স্টাফকে দায়িত্ব দিন। এটাই তো পেশাদারিত্ব। নিজের কাজকে কিভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যায়, সে কাজ করতে কি কি সমস্যা, তা সমাধানে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায়- এগুলো যখন নিজের থেকে নিজের মতো করে ছক করে সম্পন্ন করতে পারবেন, তখনইতো আপনি কাঙ্খিত ফললাভ করতে পারবেন। নিজ পেশার প্রতি কর্তব্যবোধ, দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ না থাকলে পেশাদারিত্ব অর্জন করা সম্ভব হয় না।

বিচারকের চাকরীটা আর দশটা চাকুরী থেকে আলাদা। এই সার্ভিসের সদস্যদের চাকরী করলাম বেতন পেলাম মিটে গেল প্রকৃতির ভাবনা ভাবলে চলে না। এই সার্ভিসে চাকুরীর জন্য সততা, মেধা ও দক্ষতা ছাড়াও থাকতে হয় মামলার পক্ষদের ন্যায়বিচার দেয়ার আকাঙ্খা, আন্তরিকতা, সংবেদনশীলতা, মেধার সর্বোত্তম ব্যবহার, আইনের জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ ও সর্বদা জ্ঞান অর্জনে আকাঙ্খা, বিনয় সহকারে শোনা, ধৈর্য্য, মানবিক মূল্যবোধ, আইনজীবী-মক্কেল-কর্মচারী, উর্দ্ধতন ও অধস্তন সকলের সাথে সুন্দর আচার ব্যবহার, উন্নত নৈতিক চরিত্রসহ সকল প্রকার মানবিক গুনাবলী। মানুষ বিচারকদের দেবতার আসনে রাখে আর সর্বদা আশা করে তার হাত দিয়ে কখনো যেন ন্যয়বিচার বিঘিœত না হয়। অথচ সকল বিচারকের মাঝে আমরা এ গুনগুলি খুঁজে পাই না। এ গুনগুলি অর্জন করা বা এসব গুনের চর্চা করা কঠিন কিছু নয়।

বিচার বিভাগে আমার চাকুরীকাল ২২ বৎসর। আমার পিতাও বিচারক হবার সুবাদে এদেশের বিচার বিভাগকে প্রায় ৪০ বৎসর যাবৎ আমার অনেক কাছ থেকে দেখা। বলতে দ্বিধা নেই আগের দিনের বিচার বিভাগে বিচারকদের বেতন ছিল কম, সুযোগ সুবিধা ছিল আরো কম কিন্তু মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান ছিল অগাধ, বলা যায় একেবারে আকাশচুম্বি। মানুষের এই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সম্মানবোধের উপযুক্ত কারনও ছিল। বিচারকরা তাদের কাজকে চাকরী মনে করতো না। মানুষকে ন্যায়বিচার দেয়ার মানষিকতা আর জ্ঞান অর্জনের দুর্নিবার আকাঙ্খা ছিল তাদের মধ্যে। অফিস সময় বলে তাদের কাছে ছিল না। সন্ধ্যায় বাসায় আসার সময়ও ট্রাঙ্ক ভরে তারা নথি নিয়ে আসতেন আর গভীর রাত পর্যন্ত সেগুলো দেখতো। সর্বদা আইনের চর্চা করার ফলে তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা, আরও নানাবিধ সমস্যার মধ্যেও তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।

সেই পেশাদারী মনোভাব, জ্ঞান অর্জনের আকাঙ্খা আর দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এখন অনেক বিচারকের মধ্যেই অনুপস্থিত এবং মনে হচ্ছে দিন দিন তা লোপ পাচ্ছে। এখনকার অনেক বিচারকরা নিজেদের সুযোগ সুবিধা ও পদমর্যাদা বিষয়ে যতটা সোচ্চার, আন্তরিকভাবে নিজের দায়িত্ব পালনে ততটা মনোযোগী নয়। আমার তো মনে হয় বিংশ শতাব্দীতে অর্থাৎ আগের দিনের বিচারকেরা ৭০ ভাগ ছিলেন পেশাদার মনোভাবের আর একবিংশ শতাব্দীতে অর্থাৎ এ যুগের বিচারকেরা ৭০ ভাগ অপেশাদার মনোভাবের। আমি মনে করি মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের নিবিড় পরিচর্চা ও সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শতভাগ বিচারকের মধ্যেই সেই পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

৬) মামলা পরিচালনায় আইনজীবীগণের অদক্ষতা ও অসহযোগিতা আইনজীবীগণ বিচার বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব না। কিন্তু মামলা পরিচালনায় তাদের কাঙ্খিত সহযোগিতা পাওয়া যায় না। আবার তাদের মধ্যে অনেকের দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক দেওয়ানী মামলা পরিচালনার সময় দেখা যায় আরজিতে খতিয়ানের বর্ণনা, ক্রম ওয়ারিশদের বিবরণ, দলিলসমূহের বর্ণনা ও নালিশের কারন বর্ণনায় অজ¯্র ভুল ও সমন্বয়হীনতা। আবার আরজি সংশোধনের অবারিত সুযোগ থাকায় কিছুদিন পরই আসে আরজি সংশোধনের দরখাস্ত। আবার মামলার সাথে অপর্যাপ্ত কাগজ থাকায় প্রয়োজনীয় কাগজাদি দাখিলে বিলম্বের ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে যেমন বিলম্ব হয়, তেমনি অদক্ষ হাতে মামলা পরিচালনার ফলে অনেক মোক্কেলই আদালত থেকে তার কাঙ্খিত ফললাভে ব্যর্থ হয়।

প্রত্যেক বারে হাতে গোনা কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীকে পাওয়া যায় যারা আরজি বা জবাব লেখাও ও মামলা পরিচালনায় অনেক দক্ষ। কিন্তু তাদের এতো বেশী মামলা থাকে যে সব আদালতে সময়ই দিতে পারে না। এক কোর্টে পিটিশন শুনানীর সময় অন্য কোর্টে ডাক পড়ে আবার অন্য কোর্টে সাক্ষী করার সময় আরেক কোর্টে ডাক পড়ে। এই করতে করতে যেই দুপুর দেড়টা/দুইটা বেজে যায়, তখন তাকে আর পাওয়া যায় না। মামলা না করার তখন নানান অজুহাত হাজির করে। কারো ডায়বেটিস, কারো হার্টের সমস্যা, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, কারো জরুরী প্রয়োজন, এই মিটিং সেই মিটিং, কারো আত্বীয় অসুস্থ ইত্যাদি, ইত্যাদি। ফলে মামলা দিনের পর দিন ঝুলতে থাকে। এর পিছনে অবশ্য মক্কেলদেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। যেমন কিছু মক্কেল রয়েছেন, যারা মামলার ধার্য তারিখে আদালতে না এসে মোবাইলে তার পক্ষে মামলার তদবির করতে বলেন। এসব মামলায় উকিল সাহেবরা সচরাচর তদবির করেন না ফলে আদালতে হাজিরা দিলেও শুনানীর সময় উকিল সাহেবদের পাওয়া যায় না। সুতরাং আইনজীবীদের মামলা পরিচালনায় অদক্ষতা ও অসহযোগিতার ফলে একদিকে যেমন সাধারণ জনগন আদালতে সঠিক সময়ে কাঙ্খিত ফললাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি মামলা নিষ্পত্তিতেও অনেক বিলম্ব হচ্ছে।

৭) মামলার পক্ষগণ মামলার তদবির না করা বা মামলা ঝুলিয়ে রাখার মানষিকতা

কিছু কিছু ব্যক্তি কোন কোন মামলা দায়ের করে শুধুমাত্র কোনমতে একটি নিষেধাজ্ঞার আদেশ পাওয়ার আশায়। নিষেধাজ্ঞা পেলে বা না পেলে তার ঐ মূল মামলা পরিচালনার আর আগ্রহ থাকে না। সুতরাং তদবিরের অভাবে সেসব মামলাগুলো চলে বছরের পর বছর। বিচারকরাও দয়ার শরীর। সময়ের দরখাস্ত দিলে তা খুব একটা না মঞ্জুর করেন না। যদিও বা দরখাস্ত না মঞ্জুর করে মামলা খারিজ করেন সঙ্গে সঙ্গে ছানীর দরখাস্ত। সেটা নামঞ্জুর হলে তার বিরুদ্ধে আপীল। ব্যাস ৫ বৎসরের জন্য মামলা ঝুলিয়ে রাখতে সফল। এভাবে মামলা দীর্ঘায়িত হচ্ছে আর আদালতে তৈরী হচ্ছে মামলার দীর্ঘ স্তুপ।

৮) আদালতের সময়ের সঠিক ব্যবহার না করা

সিআরও অনুযায়ী বিচারকদের এজলাশে উঠার সময় সকাল ৯:৩০ ঘটিকা। দুপুরে নামাজ ও খাবার বিরতি আধা ঘন্টা। এজলাশ থেকে নামার সময় বিকাল ৪:৩০ ঘটিকা। কিন্তু বাস্তবে এই সময় সচরাচর অনুসরন করা হয় না। এর নানাবিধ কারন রয়েছে। প্রথমত আইনজীবীরা আদালতে আসে না। তাদের মক্কেলরা আসে না। মামলার হাজিরা/পিটিশন এই সময়ের মধ্যে কেউ দাখিল করে না। পুলিশ হাজতী আসামীদের কোর্টে হাজির করে না। সাক্ষীগণও আসে না বা হাজিরা দেয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার বিকাল ৪:৩০ ঘটিকা পর্যন্তও অনেকে এজলাশে থাকেন না। এখানেও সেই একইরকম যুক্তি- আইনজীরীরা মামলা করতে চান না, মক্কেলরা থাকে না ইত্যাদি।

কিন্তু দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি, আইন কমিশনসহ মামলাজট নিরসনে যারাই সুপারিশ সম্বলিত রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে এজলাশে সময়মতো না উঠার পুরো দায়দায়িত্ব বিচারকের মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের কথা হলো আপনি সময়মতো এজলাশে উঠে বসে থাকেন। মক্কেলরা আপনাকে উঠা দেখে উকিল সাহেবদের ডেকে নিয়ে আসবে। আর উকিল মক্কেল না আসলে সমস্যা কি? নথি দেখেন, আদেশ লেখেন, রায় লেখেন ইত্যাদি। বাস্তবতা হলো অনেক বিচারকই উকিল, মক্কেল, হাজিরা পিটিশন সব রেডি না হলে এজলাশে উঠতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। এতে সকাল ১১ টা, সাড়ে ১১ টা কারো কারো এজলাশে উঠতে ১২ টাও বেজে যায়। আবার হাজিরা পিটিশন শুনানী ও সাক্ষী (যদি থাকে) গ্রহন শেষে নেমে যান। এতে আদালতের সময়ের অনেক অপচয় হয়। অ্যাডভোকেটরাও তাদের ইচ্ছামতো কোর্টে আসার সুযোগ পায় কিন্তু মক্কেলের জন্য সময়টা খুবই অল্প হয়ে যায়। ফলশ্রæতিতে মামলাজট বাড়তে থাকে।

৯) দেওয়ানী আদালতে মূল মামলা অপেক্ষা অন্তর্বতীকালীন বিষয়াদির আধিক্য
দেওয়ানী আদালতে অধিকাংশ মামলাতেই বাদী মামলা দায়েরের পরপরই একটি অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত নিয়ে হাজির হন। সে পিটিশন নিষ্পত্তি করতে না করতেই লোকাল ইসস্পেকশন, লোকাল ইসস্পেকশন রিপোর্ট আসলে তার উপর সাক্ষী যুক্তিতর্ক, সেই দরখাস্ত নিষ্পত্তি হতে না হতেই আরজি সংশোধন, কোন কোন মামলায় আসে রিসিভার নিয়োগের দরখাস্ত। এসব আদেশের বিরুদ্ধে আপীল, রিভিশন শুনানী শেষ হতে হতেই অনেক ক্ষেত্রে কেটে যায় ৫টি বছর। আবার এগুলোতো আইনেরই অংশ। মামলার পক্ষগণের অধিকারের প্রশ্ন। সুতরাং এগুলোকে নিয়েই শুরু হয় মামলার পথচলা। আর যদি মামলার কোন পক্ষ মূল মামলা নিষ্পত্তিতে অনাগ্রহী হয় তাহলে তো তার রয়েছে মামলা দীর্ঘায়িত করার অনেক অস্ত্র।

১০) জেলাজজগণ কর্তৃক অধীনস্ত বিচারক ও কর্মচারীদের কার্যকর মনিটরিং এর অভাব
জেলা জজ পদটি একটি জেলার সর্বোচ্চ বিচার বিভাগীয় পদ। তার অধীনে সকল দেওয়ানী আদালত, দায়রা আদালত, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। তার সঠিক ও গতিশীল নেতৃত্বের উপর নির্ভর করে একটি জেলার বিচার বিভাগের সফলতা-ব্যর্থতা, সাধারন মানুষের ন্যায় বিচার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি। অনেক জেলাজজকে দেখেছি তাদের গতিশীল নেতৃত্বে একটি জেলার বিচার বিভাগ মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ও ন্যায় বিচার প্রদানের ক্ষেত্রে অনন্য উদাহরন সৃষ্টি করেছেন আবার অনেনকে দেখেছি নিজেও মামলা নিষ্পত্তিতে খুব একটা তৎপর না আবার কে কখন অফিসে আসছে, যাচ্ছে, কে কতটা নিষ্পত্তি করছে না করছে, কার কি সমস্যা সে বিষয়ে খোঁজ-খবরও রাখেন না।

এ প্রসঙ্গে বিচারপতি আনোয়ারুল হক স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। স্যার রাজশাহী ও ঢাকায় জেলাজজ ছিলেন। তিনি সকাল ৯.৩০ ঘটিকায় এজলাশে উঠতেন এবং খোঁজ নিতেন কে কখন এজলাশে উঠছে-নামছে। জজকোর্টের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত প্রতিটি অফিসে কে কি করছে না করছে, কার কোর্টে কতগুলি মামলা, কে কতটা মামলা নিষ্পত্তি করছে, কে কতটা সাক্ষী নিচ্ছে, কত সময় এজলাশে থাকছে ইত্যাদি সব বিষয়ে তিনি খোঁজ খবর নিতেন এবং মোটিভেশনের মাধ্যমে অফিসারদের সর্বোচ্চ মামলা নিষ্পত্তিতে উৎসাহিত করতেন। এছাড়াও আরো কয়েকজন জেলা জজ যারা এখনো স্বরনীয় হয়ে রয়েছেন তাদের নেতৃত্বের গুনাবলীর জন্য তাদের মধ্যে বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি মুছা খালেদ, বিচারপতি বদরুজ্জামান, বিচারপতি শওকত হোসেন, বিচারপতি এ.কে.এম ফজলুর রহমান সহ অনেকে অন্যতম। এখনকার সময়েও অনেক জেলাজজগণই তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতৃত্বগুন দিয়ে নিজ নিজ জজশীপকে মামলা নিষ্পত্তিসহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের মামলাজট কমানোর ক্ষেত্রে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। এর জন্য প্রয়োজন সকল জজশীপের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তিতে গতিশীলতা আনয়নের জন্য শুধু বিচারকদের তৎপর হলেই চলে না। এর সাথে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, মামলার পক্ষ, অফিসের কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই তৎপর হতে হয়। এই জন্য প্রয়োজন সকল পক্ষের সমন্বয়, সুসম যোগাযোগ, সহযোগিতা ও সমস্যা চিহ্নিত করনের মানষিকতা। আর এগুলো বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সব পক্ষকে নিয়ে নিয়মিত সম্মেলন আয়োজন করা, কর্মচারীদের যথাযথ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা, আইনজীবীদের মামলা নিষ্পত্তিতে সহযোগিতা করার মানষিকতা তৈরী করা ইত্যাদি। এই সকল বিষয়ই একজন জেলাজজের সঠিক মনিটরিং এর দ্বারাই সম্ভব।

১১) সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নি¤œ আদালতগুলিতে যথাযথ তদারকির অভাব
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল অধস্তন আদালত সুপ্রিম কোর্টের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। সকল বিচারকদের কাজকর্ম, শৃঙ্খলা, মামলা নিষ্পত্তির পরিমান সকল বিষয় সুপ্রিম কোর্ট তদারকি করে থাকে। এছাড়াও প্রতি ৩ বৎসর অন্তর অন্তর প্রত্যেকটি জেলা আদালত একজন বিচারপতি পরিদর্শন করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে জেলা আদালতসমূহের উপর সুপ্রিম কোর্টের তদারকি অনেকটা ঢিলেঢালা। প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর মামলা নিষ্পত্তির যে বিবরনী সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয় সেগুলো পর্যালোচনা করে যারা নির্ধারিত সংখ্যার কম নিষ্পত্তি করেছেন তাদেরকে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রেরণ ছাড়া নি¤œ আদালত সমূহ সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা, কোন আদালত বা বিচারক কি কি সমস্যার মধ্যে আছেন, সেখানে মামলা সংখ্যা কেমন, নিষ্পত্তি যে পরিমান হচ্ছে, তার চেয়ে অধিক কিভাবে করা যায় তার দিকনির্দেশণা, কোন জেলায় কোন কোন ধরনের মামলা সংখ্যা বেশী, বিশেষ কি উপায়ে মামলা দায়েরের প্রবণতা রোধ করা যায় ইত্যাদি বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কোন তদারকির ব্যবস্থা নেই। উক্তরূপ তদারকি থাকলে নি¤œ আদালতের বিচারকেরা মামলা নিষ্পত্তিতে আরো বেশী তৎপর হতেন ফলে মামলাজট কিছুটা হলেও কম হতো।

১২) উচ্চ আদালতে আপীল বা রিভিশন শুনানীতে বিলম্ব হওয়া
দেওয়ানী আদালতে বিচারাধীন মামলার বেশীরভাগ বিলম্বের কারণ আপীল বা রিভিশন নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়া। আপীল আদালতসমূহে বহু সিভিল আপীল ও সিভিল রিভিশন পেন্ডিং যেগুলোর বয়স ৮-১০ বৎসরেরও বেশী। কিছু কিছু রিভিশন ও আপীল মামলা আমি পেয়েছি যেগুলোর বিরোধ খুব সামান্য কিন্তু পেন্ডিং ২০ বৎসরেরও বেশী সময় ধরে। একটু জটিলতার কারণে পূর্ববর্তী কোন বিচারক নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী হয়নি বা পক্ষরা শুনানী করতে আগ্রহী না হওয়ায় এতো দীর্ঘ সময় ধরে মামলাগুলো ঝুলে থাকে। রিভিশন ও আপীল পেন্ডিং থাকায় মূল মামলাও নিষ্পত্তি হতে দেরী হচ্ছে। অনেক সময় মামলার কোন পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে অপরপক্ষকে হয়রানী করার জন্য আদালতের আইনানুগ ও যৌক্তিক আদেশের বিরূদ্ধে অপ্রয়োজনীয় রিভিশন দায়ের করে শুনানী না করে শুধু দরখাস্ত দিয়ে কালক্ষেপন করতে থাকে।
দেওয়ানী আদালতে মামলাজট নিরসনে করনীয়।

ক্সবিচারক নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় পদসৃজন
দেওয়ানী আদালতসমূহে মামলাজট নিরসনের জন্য সবার প্রথমে দরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ করা। বিচারক নিয়োগ ব্যতীত এই ক্রমবর্ধমান মামলা নিষ্পত্তি করা কোনোভাবেই সম্ভব না। আবার একজন বিচারকের পদ সৃজনের সাথে আরও কিছু পদ ও অবকাঠামো নির্মানের প্রয়োজন হয়। উপজেলা পদ্ধতি চালু হবার সময় একজন মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজ) পদের সাথে সাথে ১০ জন সহায়ক কর্মচারীর পদ সৃজন করা হয়। যেমন একজন সেরেস্তাদার, একজন বেঞ্চ সহকারী, একজন নাজির, একজন হিসাব রক্ষক, একজন নি¤œমান সহকারী কাম টাইপিস্ট, তিনজন জারীকারক ও দুইজন পিয়ন। তেমনি জেলা সদরে সাবজজ পদের সাাথেও অনুরূপ পদ সৃজন করা হয়। একটি আদালত সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য উক্ত পদসমূহ প্রয়োজন। সেসময় বেশীরভাগ নতুন জেলার জেলা সদরে সাবজজ (বর্তমানে যুগ্ম জেলাজজ), ২য় আদালতের পদ সৃজন করা হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে অধিকাংশ জেলাতেই উক্ত যুগ্ম জেলা জজ, ২য় আদালতের পদ সৃজন করা হয়। মজার বিষয় হলো উক্ত যুগ্ম জেলাজজ ২য় আদালতে কোন সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ করা হয় নি। ফলে অন্য আদালত থেকে ধার করে বা প্রেষণে উক্ত আদালতের কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে নানা জটিলতা তৈরী হচ্ছে। উক্ত আদালতগুলি কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ২/৩ জন স্টাফ প্রদান করা হচ্ছে। উক্ত স্টাফ দিয়ে উক্ত আদালতের কাজ পরিচালনা করাই দুরুহ হয়ে উঠেছে।
যেমন একজন বিচারকের পদ সৃজনের পাশাপাশি কমপক্ষে ৭ টি পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একজন স্টেনোগ্রাফার, একজন বেঞ্চ সহকারী, একজন সেরেস্তাদার কাম হিসাব রক্ষক কাম তুলনাকারক, একজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর কাম নাজির, একজন জারীকারক ও কমপক্ষে একজন অফিস সহায়ক এবং সে গাড়ীর প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তা হলে একজন গাড়ীচালক। এসব পদ সৃষ্টি না করে বা সহায়ক কর্মচারীর ২/৩ টি পদ সৃষ্টি করে একটি আদালতের কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়।

ক্স সিভিল জাস্টিজ রিফর্ম কমিটি গঠন
দেওয়ানী আদালতে মামলাজট নিরসনে সিভিল জাস্টিজ রিফর্ম কমিটি গঠন করা হবে এক অনন্য উদ্যেগ। এই সিভিল জাস্টিজ রিফর্ম কমিটি প্রতিটি জেলা জজ আদালতের মামলা সংখ্যা বিশ্লেষণ করে উক্ত মামলা দ্রæত নিষ্পত্তির জন্য কি পরিমান বিচারক প্রয়োজন, মামলাজট নিরসনে তারা কি ধরনের উদ্যেগ গ্রহণ করবে তার বিস্তারিত কর্মসূচী প্রস্তুত করবে। এছাড়া প্রত্যেক মামলার একটি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করবে। জেলা ও দায়রা জজগণ উক্ত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি করতে প্রত্যেক বিচারককে নির্দেশ প্রদান করবেন। মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হলে বা কোনো সমস্যা হলে সিভিল জাস্টিস রিফর্ম কমিটি তা পুনরায় পর্যালোচনা করবেন। এই কমিটি প্রত্যেক জেলা জজ আদালতের পাশাপাশি প্রত্যেক বিচারকের জন্য মামলা নিষ্পত্তির টার্গেট নির্ধারণ করবেন এবং প্রত্যেক তিন মাস অন্তর অন্তর তা পর্যালোচনা করবেন।

এই কমিটি হবে স্থায়ী এবং আপীল বিভাগের কর্মরত/অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, জেলাজজ, সিনিয়র আইনজীবী ও কিছু তরুন আইন গবেষককে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই কমিটি বিচারক ও আইনজীবীদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচী প্রণয়ন করবে এবং প্রত্যেক জেলায় প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করবে।

ক্স বিচার বিভাগে মামলাজট নিরসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিদ্যমান মামলাজট নিরসনের জন্য কার্যকর একটি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের বিকল্প নেই। এই পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে আগামী ১০ বৎসরের মধ্যে মামলাজট শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার জন্য পর্যায় ভিত্তিক কর্ম-পরিকল্পনা। এর মধ্যে আরো থাকবে বিদ্যমান জনবলের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, নতুন অর্গানোগ্রাম প্রস্তুত, নতুন অর্গানোগ্রামের আওতায় বিচারক ও কর্মচারী নিয়োগের পর্যায় ভিত্তিক পরিকল্পনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন অবকাঠামো নির্মানের পরিকল্পনা, বিচারক, আইনজীবী ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।

সিভিল জাস্টিজ রিফর্ম কমিটি প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এই কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের সাথে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, সিনিয়র আইনজীবীবৃন্দ, মামলার পক্ষ, সাংবাদিক, আইন প্রণেতা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সঠিকভাবে উক্ত পরিকল্পনা করা গেলে তা বিচার বিভাগের মামলাজট নিরসন, গতিশীলতা আনয়ন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতে তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

ক্স বিচারকদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন
বর্তমানে বিচারকদের প্রশিক্ষনের জন্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান, ঢাকার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষন ইনস্টিটিউটে বিচারকদের সংবেদনশীলতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী প্রনয়ন করে কোন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় না। অথচ মামলাজট নিরসনে বিচারকদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এজন্য বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে বিচারকদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচী প্রনয়ন করতে হবে। পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য যেসকল গুনগুলো অর্জন করতে হবে তার মধ্যে নিজের কাজ ঠিকমতো করা, নিজের দোষগুনের দিকে লক্ষ্য করা, কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা, প্রানবন্ত উপস্থাপন, ঐকান্তিকতা দেখানো, অভিযোগ না করা, পেশাদারিত্ব মনোভাব বৃদ্ধি ও চর্চা, পরিশিলীত রুচিবোধ সম্পন্ন হওয়া, শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ফিটনেছ ও পরিশ্রম, জীবনাচারে সুশৃঙ্খল থাকা, দায়িত্বশীলতা ও সততার সাথে কাজ করা, সফট স্কিল আয়ত্ব করা, মিলেমিশে কাজ করার মানষিকতা, বিরক্তিকর আচরন ও অভদ্রতা পরিহার করা ইত্যাদি।

এছাড়াও সিভিল জাস্টিজ কমিটি বিচারকদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে কেন্দ্রিয়ভাবে, বিভাগীয় পর্যায়ে, জেলা পর্যায়ে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে নানান কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে সেইসাথে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাজজদেরকে নিজ নিজ জেলায় কিছু কিছু কর্মসূচী গ্রহনের জন্য গাইডলাইন দিতে পারে।

ক্স আইনজীবীদের কাজের মানোন্নয়নে প্রয়োজনীর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা
আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা বার কাউন্সিল শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্তু এই প্রশিক্ষণ একজন আইনজীবী জীবনে একবারের বেশী গ্রহন করার সুযোগ পান না। উক্ত প্রশিক্ষণে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের বিষয়াদির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। এরপর তাদের কাজের দক্ষতা বাড়ানোর কোন উদ্যোগ না বার কাউন্সিল না স্থানীয় জেলা বার এসোসিয়েশন কেহই গ্রহন করে না। ফলে আইনজীবীগণ বিজ্ঞ সিনিয়রদের কাছ থেকে যা শিখেন সেটাই তাদের শিক্ষা। তবে এখনকার সিনিয়র আইনজীবীগণ জুনিয়রদের শিখানোর ব্যাপারে ততটা আগ্রহী নন আবার জুনিয়র আইনজীবীগণও শিখার বিষয়ে ততটা মনোযোগী নন। ফলে সামগ্রিকভাবে আইনজীবীদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও পেশাদারিত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্য প্রয়োজন আইনজীবীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। আর এ প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বার কাউন্সিলকে সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলা আইনজীবী সমিতিকে। এছাড়া সিভিল জাস্টিজ রিফর্ম কমিটিও এই প্রশিক্ষণ আয়োজনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারেন।

ক্স জেলাজজ কর্তৃক কার্যকর তদারকি বা মনিটরিং
একজন জেলা জজ তার নিয়ন্ত্রনাধীন জেলায় কার্যকর তদারকি ও মনিটরিং এর মাধ্যমে মামলাজট অনেকাংশে হ্রাস করতে সক্ষম। প্রথমতঃ তিনি তার অধীনস্ত বিচারকদের কাজের পরিমান তদারকি করে উক্ত কাজের পরিমান বাড়ানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারকদের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশণা দিতে পারেন। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক আদালতে নিস্ক্রীয় মামলাসমূহ চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা করে তা দ্রæত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে পারেন। তৃতীয়তঃ তিনি অ্যাডভোকেটদের সাথে আলোচনা করে কার্যকর সমন্বয়ের সৃষ্টি করতে পারেন যাতে করে আদালতের সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায় এবং সেই সাথে মামলা নিষ্পত্তিতে বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটগণেরও সার্বিক সহযোগিতা পাওয়া যায়। এছাড়া এডিআর চালু ও তা সফল করার বিষয়ে একজন জেলা জজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি মধ্যস্থতা বিষয়ে বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের প্যানেল প্রস্তুত ও তা হালনাগাদ করার মাধ্যমে এবং বিচারক আইনজীবী ও মামলার পক্ষদের এ বিষয়ে উৎসাহী করার মাধ্যমে মামলাজট নিরসনের উদ্যোগ গ্রহন করতে পারেন।

ক্স প্রত্যেক জেলা আদালতের মামলাজট কমানোর মানচিত্র/ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা
মামলাজট নিরসনের জন্য কেন্দ্রিয়ভাবে যেমন একটি কৌশলগত পরিকল্পনা করতে হবে তেমনি সেই কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রত্যেক জেলার মামলাসংখ্যা, মামলা দায়েরের হার, জনসংখ্যা, শিক্ষিতের হার, অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রধান পেশা ইত্যাদি বিবেচনায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলাজট নিরসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সামগ্রিকভাবে একটি মানচিত্র ও ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করার পাশাপাশি প্রত্যেক মামলার জন্য পৃথক ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করতে হবে। উক্ত ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে একজন মানুষ জানতে পারবে তার মামলা কতদিনে নিষ্পত্তি হবে এবং সেই মামলায় তার কত খরচ হবে। তেমনিভাবে উক্ত ক্যালেন্ডার ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা পর্যালোচনা করতে হবে এবং উক্ত পর্যালোচনার ভিত্তিতে কিছুদিন পর পর সংশোধন বা নতুন বিষয় তাতে সংযোজন বা আধুনিকায়ন করতে হবে। এভাবে এক পর্যায়ে এসে উক্ত মানচিত্র ও ক্যালেন্ডার হয়ে উঠবে একটি জেলা জজ আদালত বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির দর্পন।

ক্স বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক জেলা আদালতগুলির উপর কার্যকর নজরদারি
বর্তমানে তিন বৎসর পর পর একটি জেলা জজ আদালতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক পরিদর্শন হয়ে থাকে। উক্ত পরিদর্শন কার্যক্রম সচরাচর সংশ্লিষ্ট জেলা জজশীপের আদালতসমূহের ত্রæটিসমূহ চিহ্নিত করা হয় এবং তা নিরসনে সুপারিশ পেশ করা হয়। কিন্তু উক্ত পরিদর্শণ কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট জেলা আদালতের মামলাজট নিরসন, বিচারক ও আইনজীবীদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি ও সার্বিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কোনো ভূমিকা রাখে না।
এ কারনেই উক্ত পরিদর্শন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য, পরিদর্শনের বিষয় ও আওতা পরিবর্তন করতে হবে। উক্ত পরিদর্শন হতে হবে প্রত্যেক বছরে একবার এবং উক্ত পরিদর্শন কার্যক্রমের ডিজাইন বা নকশা এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে করে তা একটি জজশীপের মামলাজট নিরসন, ন্যায়বিচার প্রদানে গতিশীলতা আনয়ন, বিচারক ও আইনজীবীদের সম্পর্ক উন্নয়ন, তাদের সংবেদনশীলতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

ক্স উচ্চ আদালতে আপীল বা রিভিশন মামলা দ্রæত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা
দেওয়ানী আদালতে অনেক মামলা আছে যেগুলোর কোন আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিভিশন বা আপীল পেন্ডিং রয়েছে। এসব রিভিশন নিষ্পত্তি হতে সচরাচর অনেক সময় লাগে। কোন কোন রিভিশন নিষ্পত্তি হতে ১০/১২ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। এই সময়ে উক্ত মূল মামলার কাজ বন্ধ থাকে। ফলে মামলাজটের সৃষ্টি হয়। এ কারনে হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানী আপীল ও রিভিশন নিষ্পত্তিতে আলাদা বেঞ্চ গঠন করা ও বেঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন যাতে করে এসব রিভিশন ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। এতে করে নি¤œ আদালতে মামলাজট অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

ক্স আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার
আদালতে মামলাজট নিরসনের জন্য কিছু আইনের সংস্কার করা প্রয়োজন। যেমন দেওয়ানী কার্যবিধিতে মামলা দায়েরের পর চুড়ান্ত শুনানী পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্তর পার হতে হয়। কিন্তু উক্ত স্তর সমূহে কি করনীয় সে বিষয়ে না অ্যাডভোকেট না মক্কেল কারো কোনো পরিস্কার ধারণা নেই। ফলে উক্ত স্তরসমূহ রাখা হয় ঠিকই কিন্তু উক্ত স্তরসমূহে মামলার কোনো পক্ষ কোনো তদবির করেনা। আইন সংশোধন করে উক্ত স্তর কমিয়ে ফেলা যেতে পারে। এছাড়া বর্তমানে আরজি বা জবাব সংশোধনের অবারিত সুযোগ থাকায় মামলার যেকোনো স্তরে মামলার পক্ষগণ খেয়ালখুশিমতো আরজি সংশোধন করে। ফলে মামলা বিলম্বিত হয়। দেওয়ানী কার্যবিধি সংশোধন করে এসব আরজি বা জবাব সংশোধনের সুবিধা কিছুটা হ্রাস করা হলে মামলা দ্রæত নিষ্পত্তিতে তা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

ক্স আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার
করোনাভাইরাস (কোভিট-১৯) এর সংক্রমনের ফলে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সীমিত আকারে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আদালতের কার্যক্রম চালু করা হয়। উক্ত কার্যক্রম চালু করার ফলে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুনানী করে অনেক দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়। আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করা হলে উক্ত ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুনানীর বিধান রদ করা হয়। কিন্তু এই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুনানী কার্যক্রম আদালতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের দ্বার উম্মুক্ত করে দিয়েছে এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারে বিচারক, আইনজীবী, মামলার পক্ষের যে ভীতি ছিল তা দূর হয়েছে। এখন সময় এসেছে আদালতে ব্যপক ভিত্তিক আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করা এবং এই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করা গেলে তা মামলা নিষ্পত্তিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

এই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি অনেকভাবে আদালতে ব্যবহার সম্ভব। যেমন- মামলার যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী যে অনেক দূরে, যাকে বার বার সমন বা নোটিশ দিয়েও হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না তার সাক্ষ্য এই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে নেয়া সম্ভব হলে সেই মামলাটি দ্রæত নিষ্পত্তির পথে অনেকখানি এগিয়ে যাবে। আবার মামলার কোনো গুরুত্বপূর্ণ দলিল বা কাগজ, যা সাব রেজিস্ট্রি অফিস বা ভূমি অফিস বা অন্য কোন অফিসে সংরক্ষিত, তা আদালতে তলব দেয়ার স্থলে সংশ্লিষ্ট অফিসের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যদি উক্ত দলিল বা কাগজ বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহন করা ও তা প্রদর্শনী চিহ্নিত করা সম্ভব হয়, তাহলে মামলাসমূহ অনেক দ্রæত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। এছাড়া মামলার কোনো পক্ষ অসুস্থ হলে সাধারণত সে সময়ের দরখাস্ত করে থাকে ফলে মামলা মূলতবী করা হয়। এক্ষেত্রে উক্ত অসুস্থ পক্ষকে ভার্চুয়ালি আদালতের কার্যক্রমে যুক্ত করা গেলে মামলা মূলতবী করার প্রয়োজন হবে না সেক্ষেত্রে আদালতের মামলাজট অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

মামলাজট নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (অউজ) এর প্রয়োগ
বাংলাদেশের নি¤œ আদালতে বর্তমানে যে পরিমানে বিচারক কর্মরত রয়েছে, তাদের পক্ষে বিদ্যমান মামলাজট কমানো সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বর্তমানে কর্মরত বিচারকের কমপক্ষে দ্বিগুন বিচারক নিয়োগ করা। কিন্তু শুধু বিচারক নিয়োগ দিলেই তো হয় না, একজন বিচারকের অনুকূলে কমপক্ষে ৫ জন কর্মচারী নিয়োগ দিতে হয়।

এছাড়াও বিচারকের বসার জন্য চেম্বার, বিচার করার জন্য এজলাশ, নথি রাখার জন্য সেরেস্তা, কর্মচারীদের বসার জন্য অফিস রুম ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মানের প্রশ্ন এর সাথে জড়িত। যা অনেক সময় সাপেক্ষ ও ব্যয় সাপেক্ষ। তবে আমাদের আদালতসমূহের জমে থাকা মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বা এডিআর কার্যকরভাবে চালু করা গেলে তা হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য সাশ্রয়ী এবং সাধারন মানুষ এই প্রক্রিয়ায় সহজে, কম হয়রানীতে ও কম খরচে বিচার পাবে।

উন্নত দেশগুলিতে এডিআর পদ্ধতির সফলতা
কমন ল ভুক্ত উন্নত দেশগুলি যেমন আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো অনেক রাষ্ট্র এডিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রভুত সফলতা অর্জন করেছে। তাদেরও দেশে একসময় প্রচুর মামলাজট ছিল। এডিআর পদ্ধতির সফল প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের মামলাজট নিরসনে সক্ষম হয়েছে। এডিআর পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে তাদের আদালতসমূহে মামলা দায়েরের হারও অনেকাংশে কমে গিয়েছে। যে কোন বিরোধ তারা আদালতে যাবার পূর্বেই এডিআর পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে ফেলছে। এভাবে তারা তাদের বিরোধের শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হচ্ছে।

আর মামলার পক্ষরাও এই এডিআর পদ্ধতিতে তাদের মামলা নিষ্পত্তিতে আগ্রহী হচ্ছে। এ কারনে এই পদ্ধতিতে তারা তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হচ্ছে।

বাংলাদেশের দেওয়ানী আদালতে এডিআর ব্যবস্থার প্রচলন
আমাদের দেশেও উন্নত দেশগুলির উক্ত সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০০৩ সনে দেওয়ানী আদালতে এডিআর ব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা চালুর পর এই পদ্ধতির সুবিধা সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রচার প্রচারনা অভাবে অ্যাডভোকেট ও মামলার পক্ষদের এই পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এই পদ্ধতির প্রয়োগের জন্য প্রত্যেক জেলায় অ্যাডভোকেটদের একটি প্যানেল করা হয়, যারা এডিআর করবেন। তাদের কাছে এডিআর করার জন্য কিছু কিছু মামলাও প্রেরণ করা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, বেশীরভাগ অ্যাডভোকেটগণ উক্ত মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার জন্য পক্ষদের নিয়ে বসেননি। তদুপরি এই পদ্ধতিতে অ্যাডভোকেটদের ফি নির্ধারন করা নেই ফলে অ্যাডভোকেটরাও এই পদ্ধতির প্রতি আগ্রহী হন না।

বাংলাদেশে দেওয়ানী আদালতে এডিআর ব্যবস্থা সফল না হবার কারণ
এই আইনটিতে মধ্যস্থতা করার ক্ষেত্রে পক্ষদের পছন্দকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং আদালতের বিচারকদেরকেও পক্ষগণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ করতে পারবেন মর্মে বলা হয়েছে। আইনটি পাশের পর সব মহল থেকে যে ধরনের সাড়া পাওয়ার আশা করা হয়েছিল তা পাওয়া যায় নি। আইনটিকে সাধারণ মানুষের সামনে, বিশেষ করে মামলার পক্ষদের সামনে তুলে ধরা হয় নি। যার কারণে আইনটি তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। এই আইনটি সফল না হওয়ার পিছনে শুধু প্রচারের অভাবকেই দায়ী করা যায় না আরও কিছু সমস্যা এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধরা পড়ে। নি¤েœ এই সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো-
ক্স এডিআর ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারন মানুষের ধারণা না থাকা

দেওয়ানী কার্যবিধিতে এডিআর ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২০০৩ সনে। তখন এডিআর ব্যবস্থাকে ফলপ্রসু করার জন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ও কিছু জেলা শহরে এই এডিআর ব্যবস্থার উপর সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন আদালতে এ ব্যবস্থা চালুর জন্য উদ্যেগও নেয়া হয়। জেলায় জেলায় আইনজীবীদের নিয়ে প্যানেল প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু আইনটি যতটুকু সফল হবে মর্মে ধারণা করা হয়েছিল তা হয়নি। আইনজীবী ও মামলার পক্ষদের এই পদ্ধতি ব্যবহার করার বিষয়ে ততটা আগ্রহী করা যায়নি। এর মূল কারন হিসেবে চিহ্নিত করা যায় মামলার পক্ষদের এই আইন বিষয়ে অজ্ঞতাকে। অনেক মামলার পক্ষ রয়েছে তারা নিজেদের মামলা আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলে খুশি হবে এবং যে কোন আপোষের উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে কিন্তু আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তির যে একটি আইন আছে এ বিষয়ে তারা জানে না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, শতকরা ৮৩ ভাগ মামলার পক্ষ এডিআর বিষয়ে যে একটি আইন আছে, তা তারা জানে না।
ক্স এডিআর ব্যবস্থা সম্পর্কে আইনজীবীগণ কর্তৃক পক্ষদের সঠিক ধারণা না দেয়া

দেওয়ানী মামলায় এডিআর পদ্ধতি চালু হলেও বিজ্ঞ আইনজীবীদের এই পদ্ধতি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা ছিল না। ফলে তারাও মামলার পক্ষদের এই পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেননি বা তাদের এই পদ্ধতিতে আকৃষ্ট করার জন্য কোন পদক্ষেপও গ্রহন করেননি। এতে অবশ্য বিজ্ঞ আইনজীবীদেরকে খুব একটা দায়ী করা যায় না কারণ তারা তো নিজেরাই এই পদ্ধতির ভালো মন্দ সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। আর কোন মক্কেল যদি নিজে থেকে আগ্রহী না হয় আইনজীবীরা তাতে আগ্রহ দেখান না কারন এই এডিআর পদ্ধতিতে কোন মামলা নিষ্পত্তি হলে তার কোন লাভ নেই বরং ক্ষতি। আর এডিআর পদ্ধতিতে সবসময় কিছু ছাড় দেয়ার প্রশ্ন থাকে কিন্তু বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটবৃন্দ মামলার পক্ষদের ছাড় দেয়ার প্রস্তাব সাধারণত দিতে চান না। বরং তারা মামলায় জয়ী হবে মর্মে ধারণা দিয়ে থাকেন। ফলে এডিআর পদ্ধতিতে বিজ্ঞ আইনজীবীদের যেমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি তেমনি তারা তাদের মক্কেলদেরও এই পদ্ধতি অনুসরন করতে উদ্বুদ্ধ করেন নি।

ক্স মামলার অপর পক্ষকে হয়রানী করার মানষিকতা
কমন ল সিস্টেমের বিচার ব্যবস্থা হলো পক্ষ প্রতিপক্ষমূলক বিচার ব্যবস্থা। এই বিচার ব্যবস্থায় মামলার এক পক্ষ জয়লাভ করে আর অপরপক্ষ পরাজিত হয়। এই ব্যবস্থায় জয়লাভের নেশায় মানুষ যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা সেই সম্পত্তির মূল্যের বেশীও মাঝে মাঝে মামলা চালাতে গিয়ে খরচ করে ফেলে। আবার যখন দেখে মামলায় তার অবস্থান খারাপ তখন অপর পক্ষকে হয়রানী করতে থাকে। তখন বার বার সাক্ষীর জন্য দিন পরলেও সাক্ষী হাজির করেনা বরং নানান অজুহাতে দিনের পর দিন সময় ক্ষেপন করতে থাকে।

ক্স আদালতের বিচারকদের এডিআর ব্যবস্থা কার্যকর করতে যথেষ্ট আন্তরিক না হওয়া
২০০৩ সনে দেওয়ানী কার্যবিধিতে যখন প্রথম এডিআর ব্যবস্থা চালু করা হয়, তখন অনেক জেলাতেই বিচারকেরা আগ্রহ করে এই এডিআর ব্যবস্থা কার্যকর করতে উদ্যোগ গ্রহন করেন। কিছু মামলা তারা সফলভাবে নিজেরা এডিআর এর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হন। তবে বেশীরভাগ জেলাতেই এই পদ্ধতি তেমন একটা কার্যকর হয়নি। এর মূল কারণ সংশ্লিষ্ট বিচারকদের এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে যথেষ্ট আন্তরিক না হওয়া। এই ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারকদের উচিত ছিল আরও উদ্যোগী হয়ে বিজ্ঞ আইনজীবী, মামলার পক্ষ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এই ব্যবস্থার সুফল সম্পর্কে জানানো ও এই ব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ গ্রহণ করতে আগ্রহী করে তোলা এবং নিজে থেকে কিছু মামলা আপোষে নিষ্পত্তির জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু বেশীরভাগ বিচারকই সে ভূমিকা পালন করেননি।

এর অবশ্য যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারন রয়েছে। অনেকে মনে করেছেন যে, মামলার পক্ষদের চেম্বারে নিয়ে এসে আপোষ নিষ্পত্তির বিষয়ে আলোচনা করলে বিচারকের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হবে। কেননা তখন মামলার পক্ষগণ বিচারকদের সহজলভ্য মনে করবে এবং কারনে অকারনে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। এতে সাধারন মানুষের বিচারকের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ সেটা নষ্ট হবে বা বিচারকের আভিজাত্য বা মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। পরবর্তীতে আপোষে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলা বিচারের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরী হবে।

কিছু বিচারকদের এরূপ মনোভাব একেবারেই অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। কেননা যে সকল বিচারক মামলার পক্ষদের নিয়ে আপোষের জন্য বসেছেন, তারা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এসব অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন। তারা সমস্যা হিসেবে এটাও চিহ্নিত করেছেন যে, বিচারের মানষিকতা আর আপোষের মানষিকতা ভিন্ন। একই বিচারক যখন আপোষ করতে বসবেন তখন তার মানষিক অবস্থা থাকবে পক্ষদের বুঝিয়ে সমঝোতার দিকে নিয়ে যাওয়া। আর বিচারের মানষিকতা হলো পক্ষদের থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে উপস্থাপিত সাক্ষ্য ও প্রমানাদির ভিত্তিতে বিচার করা।

এক্ষেত্রে একজন বিচারকের উপর মামলার পক্ষদের নিয়ে আপোষের ও মামলার বিচারের ভার থাকা উচিত নয়। আপোষের জন্য আলাদা বিচারক নিয়োগ করলে তার আপোষের বিষয়ে দিনের পর দিন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে এবং ধীরে ধীরে তার এ বিষয়ে পেশাদারিত্ব অর্জিত হবে। একসময়ে তিনি প্রচুর মামলা আপোষে নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবেন। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত আপোষের জন্য আলাদা বিচারক নিয়োগ দেয়া এবং তার আপোষ বিষয়ে পর্যাপ্ত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা যাতে করে তিনি এ বিষয়ে পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পারেন।

ক্স মামলার জটিলতা
আমাদের দেশের বেশীরভাগ দেওয়ানী মামলাগুলো একটু জটিল প্রকৃতির। এর নানাবিধ কারন রয়েছে। তবে মূল কারণ সঠিক ভূমি ব্যবস্থাপনার অভাব। প্রত্যেক মৌজার সিএস খতিয়ান প্রস্তুতের সময় যতটা দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয় পরবর্তীতে এসএ খতিয়ান ও আরএস খতিয়ান প্রস্তুতের সময় তা করা হয়নি। ফলে এসএ ও আরএস খতিয়ানে প্রচুর ভুল ভ্রান্তি থেকে যায়। তাছাড়া অর্পিত সম্পত্তির তালিকা তৈরীতে অনিয়ম, ভূমি অফিসে সঠিকভাবে তদন্ত না করেই নামজারী প্রদান, জমি রেজিস্ট্রেশনে অনিয়ম, জমি রেজিস্ট্রেশন আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু টাউট বা সুবিধাভোগী শ্রেনী কর্তৃক মিথ্যা বা সাজানো দলিল প্রস্তুত ইত্যাদির কারণে এই জটিলতার পরিমান আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাটোয়ারা মামলা মামলা যেখানে মূল মালিকের অনেকগুলো খতিয়ান, অনেক ব্যক্তিকে পক্ষ করতে হয় এবং বেশ কয়েকসেট বিবাদী মামলায় প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে বা স্বত্ব ঘোষণার মামলা যেখানে অনেক ব্যক্তি পক্ষ থাকে, সেসব মামলায় সকল পক্ষকে আপোষের টেবিলে বসানো কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে যায়। কোন কোন মামলায় মূল বিরোধ ২/৩ টি পক্ষের মধ্যে থাকে কিন্তু মোকদ্দমায় স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা অনেক ব্যক্তির থাকায় তা আপোষে নিষ্পত্তি করা কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে যায়।

ক্স বিচারের নতুন এই পদ্ধতির প্রতি মানুষের আস্থার অভাব
মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির এই ব্যবস্থা কিরূপ হবে, সে বিষয়ে মানুষের ধারণা ছিল না। বেশীর ভাগ মানুষের এই বিষয়টি সম্পর্কে কোন ধারনা ছিল না। যাদের এই ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা হয়েছিল, তারা এই ব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তি করতে ইতস্তত বোধ করতো কেননা তাদের এই পদ্ধতির উপর আস্থার অভাব ছিল। এই পদ্ধতিতে আপোষে নিষ্পত্তি হলে সেই সিদ্ধান্ত আদালতের ডিক্রির সমান হবে কিনা বা সেই সিদ্ধান্তের কপি নিয়ে খারিজ খাজনা ইত্যাদি করা যাবে কিনা ইত্যাদি। এছাড়া মামলার পক্ষগণ সাধারনত নিযুক্তীয় অ্যাডভোকেটদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। যেহেতু মামলার অ্যাডভোকেটগণই এই ব্যবস্থাকে সহজভাবে গ্রহন করেননি, সেহেতু তারা তাদের মক্কেলদের এই পদ্ধতি বিষয়ে সঠিক ধারণা প্রদান করেননি ববং এ পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি বিষয়ে নিরুৎসাহিত করতেন। ফলে মামলার পক্ষগণও এই পদ্ধতিতে আস্থা রাখতে পারেননি।

ক্স প্রচার প্রচারনার অভাব
এডিআর পদ্ধতি আদালতে চালু হবার পর এই পদ্ধতির ভাল দিকগুলি সম্পর্কে যতটুকু প্রচার প্রচারনা করা প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি এবং প্রচার প্রচারনা জন্য জেলা জজ আদালতগুলিতে কোন প্রকার বরাদ্দও প্রদান করা হয়নি। ফলে সাধারন মানুষ এবং মামলার পক্ষগণ এই ব্যবস্থা বা এর সুফল সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিল। বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমে বিচারক ও কিছু কিছু আইনজীবীদের এই পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা হয় কিন্তু সাধারণ মানুষদের বা মামলার পক্ষদের এই পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনা দেয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। ফলে প্রচার প্রচারনার অভাবই এই পদ্ধতি সফল না হবার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ।

ক্স মামলার তৃতীয় পক্ষের প্রভাব
অনেক সময় দেখা যায় যে, একটি মামলায় বাদী ও বিবাদী ছাড়াও তৃতীয় কোন ব্যক্তি অতি উৎসাহী হয়ে মামলার পক্ষদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আপোষ বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে গেলে এদের প্রভাব বেশী লক্ষ্য করা যায়। এরা মামলার কোন পক্ষ না হয়েও মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে এরা পক্ষদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অনেক সময় মামলার দুই পক্ষ একটি বিষয়ে সমঝোতায় আসলেও তাদের প্রভাবে তারা আর আপোষ করতে চায় না ফলে আপোষের পুরো প্রক্রিয়া ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মামলার এই তৃতীয় পক্ষ সাধারনত মামলার কোন পক্ষের আত্বীয়-স্বজন বা বন্ধু বান্ধব হয়ে থাকে আবার কখনো এরা আদালতে সুবিধাভোগী কিছু দালাল শ্রেনীর লোকও হয়ে থাকে যারা এই মামলার বিষয়ে নিজেদের স্বার্থ সৃষ্টি করে নেয়। একটা বিরোধকে জিইয়ে রেখে সুবিধা নেয়াই তাদের কাজ। আপোষে কোন মামলা নিষ্পত্তি হলে তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় যার কারণে তারা কখনো চায় না কোন বিরোধ আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হোক বা খুব অল্প সময়ে কোন পক্ষ আদালতের কোনো মামলা থেকে অব্যহতি পাক।

ক্স আদালতের ডিক্রির প্রতি দুর্বলতা
পক্ষ-প্রতিপক্ষমূলক এই বিচার ব্যবস্থায় মামলার পক্ষদের একটাই চাওয়া থাকে যেন তার পক্ষে ডিক্রি হয় এবং ডিক্রীর অনুবলে সে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ কোন বিরোধীয় সম্পত্তির উপর তার অধিকার বলবৎ করে থাকে। কিন্তু এই ডিক্রির জন্য তার বছরের পর বছর আদালত প্রাঙ্গনে ঘুরতে হয় আর খরচ যা হয় তা অনেক সময় বিরোধীয় সম্পত্তির চেয়েও অনেক বেশী। তবুও তারা আশায় বুক বেঁধে থাকে মনে করে আর দুটি তারিখেই হয়তো নিষ্পত্তি হবে। দুই তারিখের জায়গায় যদিওবা পরবর্তী দশটি বা বারটি তারিখে মামলা নিষ্পত্তি হয় বা তার অনুকূলে ডিক্রি হয়, তথাপি এই ডিক্রি জারী করার জন্য প্রয়োজন হয় আবার নতুন করে জারী মামলা করা, কমিশন করা, চুড়ান্ত ডিক্রি হওয়া আরো কত কি। তবুও এই ডিক্রির প্রতি দুর্বলতার জন্যই সে মাসের পর মাস বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকে। মামলায় যদি তার কাগজপত্র ভালো থাকে তাহলে সে আরো সময় নিয়ে আরো খরচ করে ডিক্রি নিতে চায় একটু ছাড় দিয়ে আপোষ করতে চায় না। আদালতের ডিক্রির প্রতি মামলার পক্ষের এই দুর্বলতাই অনেক সময় কোন মামলা আপোষে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।

ক্স মধ্যস্থতাকারীগণের প্রশিক্ষণের অভাব
দেওয়ানী মামলায় মধ্যস্থতার বিধান যখন ২০০৩ সনে চালু করা হয়। তখন মধ্যস্থতারকারী হিসেবে যারা কাজ করবেন, সেই বিচারক বা আইনজীবীদের কোন প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে বিচারক বা আইনজীবী যারা মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছেন তারা সাধারনত তাদের নিজেদের বিচার বিবেচনা জ্ঞান বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছেন। এতে কেউ সফল হয়েছেন কেউ হননি।
সফল হওয়া বা না হওয়াতে মামলার পক্ষদের মনোভাব যেমন একটি ফ্যক্টর হিসেবে কাজ করে তেমনি মধ্যস্থতাকারীর দক্ষতাও একটি বড় কারন হিসেবে কাজ করে। আর এই দক্ষতা অর্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো প্রশিক্ষণ। নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন মধ্যস্থতাকারীকে দক্ষ করে তোলা সম্ভব এবং একজন দক্ষ মধ্যস্থতাকারীর মধ্যস্থতায় সফলতার হার অনেক বেশী। একজন মধ্যস্থতাকারী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতার মাধ্যমে মামলার কোন পক্ষকে একটি সমাধানের দিকে এগিয়ে নিতে অনেক সাহায্য করে থাকেন। সে মামলার বা বিরোধের কোন পক্ষের মানষিক বা সামাজিক অবস্থা, তার চাওয়ার সাথে আইনগত ও ঘটনাগত বিষয়াবলীর সম্মিলন ঘটিয়ে একটি সমাধানের দিকে তাকে সফলভাবে পরিচালিত করে থাকেন। এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মধ্যস্থতাকারীর উপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং আপোষের মাধ্যমে তার বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং শেষ পর্যন্ত একটি সমাধানে পৌছতে সক্ষম হন।

ক্স মধ্যস্থতাকারীগণের ফি আইনে নির্ধারিত না থাকা
মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির এই আইনে মধ্যস্থতাকারীর ফি আইনে নির্ধারন করা নেই। ফলে মামলার পক্ষগণ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যস্থতাকারীর জন্য সম্মানজনক ফি নির্ধারন করতো না। যার কারনে মধ্যস্থতা করার প্রতি কোন অ্যাডভোকেট তেমন আগ্রহী হতেন না। যদিও একটি মধ্যস্থতায় মধ্যস্থতাকারীর জন্য কত ফি ধার্য করা হবে, তা অনেক কঠিন বিষয়, কেননা একেকটি মামলার প্রকৃতি একেকরকম। আবার একই প্রকৃতির মামলার মধ্যে কিছু বিরোধ আছে ছোট আর কিছু আছে অনেক বড়। কোন মামলা আপোষে নিষ্পত্তি করতে হয়তো ২/১ ঘন্টাই যথেস্ট আবার কোন মামলার আপোষ করতে ২০/২৫ টি বৈঠকে পর্যন্ত বসতে হতে হয়। সেই দৃষ্টিকোন থেকে আইনে মধ্যস্থতাকারীর ফি ধার্য করা হয়নি। কিন্তু আইনে ফি ধার্য না করার কারণে মধ্যস্থতার সময় পক্ষগণ মধ্যস্থতাকারীর জন্য সম্মানজনক ফি নির্ধারন না করলে মধ্যস্থতাকারীগণ মধ্যস্থতায় আগ্রহী হতো না। কারণ একজন ব্যস্ত অ্যাডভোকেটকে তার নিজের মামলার প্রস্তুতি নিতেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়, তার সময়ের মূল্য অনেক। মধ্যস্থতার জন্য তিনি মনোনীত হলে তার জন্য সম্মানজনক ফি ধার্য না করা হলে তিনি সেই মামলায় মধ্যস্থতায় বসতে তেমন আগ্রহী হন না।

ক্স মধ্যস্থতাকারীগণের প্যানেল কার্যকর না থাকা
দেওয়ানী কার্যবিধিতে সংযুক্ত ২০০৩ সনের মধ্যস্থতা সংক্রান্ত আইনে প্রত্যেক জেলার জেলাজজকে মধ্যস্থতাকারীদের একটি প্যানেল প্রস্তুত করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সেই নির্দেশনা মোতাবেক বেশীরভাগ জেলাজজ নিজ নিজ জেলায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে অবসরপ্রাপ্ত জেলাজজ ও বিজ্ঞ আইনজীবীদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল প্রস্তুত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই এডিআর পদ্ধতি সফলতা লাভ না করায় সেই প্যানেল আর হালনাগাদ করা হয়না। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যস্থতাকারী প্যানেলে নবীন ও উদ্যোগী কিছু আইনজীবীদের অর্ন্তভুক্ত করা যাতে করে তারা মধ্যস্থতা করার বিষয়ে আগ্রহী থাকেন এবং ভবিষ্যতে তারা মধ্যস্থতা করাটাই পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই প্যানেল প্রস্তুত করার সময় সিনিয়র ও ব্যস্ত আইনজীবীদের এই প্যানেলে অর্ন্তভুক্ত করা হয় যারা আগ্রহ করে প্যানেলে অর্ন্তভুক্ত হয়েছেন কিন্তু মামলা আপোষে নিষ্পত্তিতে অতটা আগ্রহী ছিলেন না সবচেয়ে বড় বিষয় এই যে, তারা এতো বেশী ব্যস্ত থাকতেন যে, মধ্যস্থতার জন্য তারা সময় বের করতে পারতেন না। ফলে এই ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

উক্ত সমস্যাসমূহ সমাধানে করনীয়
ক্স মামলার পক্ষ ও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার প্রচারনা
এডিআর পদ্ধতি মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন এই ব্যবস্থার সুফল সম্পর্কে জনগনকে অবহিত করা। এজন্য প্রচার প্রচারণা আবশ্যক। প্রচার প্রচারনা মাধ্যমে শুধুমাত্র মামলার পক্ষদেরই এই বিষয়ে অবহিত করলেই হবে না সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই পদ্ধতির সুফল সম্পর্কে ব্যপক প্রচার চালাতে হবে। প্রচার প্রচারনা পাশাপাশি এডিআর বিষয়ে প্রত্যেক আদালতে একটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, যাতে করে সাধারন মানুষ এডিআর বিষয়ে উক্ত অফিসের মাধ্যমে জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের মামলা আপোষের মাধ্যমে সমাধানে উদ্যোগী হতে পারে। এছাড়া প্রত্যেক মামলা দায়েরের সাথে সাথে এডিআর এর সুফল বিষয়ে তথ্যকনিকা প্রত্যেক মামলার বাদীকে প্রদান করা যেতে পারে। তেমনি বিবাদী জবাব দাখিল করলে তাকেও এডিআর বিষয়ক তথ্যকনিকা প্রদান করা যেতে পারে।

একটি বিষয় লক্ষনীয় তা হলো এডিআর বিষয়ক প্রচার প্রচারনা তখনই গতি পাবে যখন একটি ভালো এডিআর পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হবে। কেননা দেখা গেলো যে, প্রচার প্রচারনা করা হলো কিন্তু এডিআর পদ্ধতিতে বিরোধ মীমাংসা করতে গিয়ে মানুষ কাঙ্খিত সেবা পেলো না বা তার খারাপ অভিজ্ঞতা হলো, তাহলে এই ব্যবস্থা থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং এই পদ্ধতি অসফল হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি ভালো অফিস রুম বরাদ্দ করা বা ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং দক্ষ কিছু মধ্যস্থতাকারীকে নিয়োগ করা যাতে করে মানুষ এডিআর করতে এসে তার বিরোধ মীমাংসা না হলেও যেন এই ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখতে পারে।

ক্স অ্যাডভোকেটদের এডিআর বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা
এডিআর পদ্ধতি সফল করতে সবার প্রথমে প্রয়োজন বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটদেরকে এই এডিআর পদ্ধতির বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা। যখন আইনজীবীগণ এই এডিআর পদ্ধতিতে মামলার নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী হবেন, তখনই এই ব্যবস্থা সফল হবে। আর আইনজীবীদেরকে এই ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী করতে হলে প্রয়োজন তাদের জন্য কিছু প্রনোদনার ব্যবস্থা করা। যেমন এডিআর পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি হলে সংশ্লিষ্ট মধ্যস্থতাকারী আইনজীবী যেমন মামলার পক্ষদের নিকট থেকে ফি পাবেন সাথে সাথে সরকারের তরফ থেকে বা আইনগত সহায়তা সংস্থার নিকট থেকে কিছু সম্মানী পাবেন তাতে করে তারা মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী হবেন।

এছাড়া প্রত্যেক আইনজীবী সমিতিতে মাঝে মধ্যে এডিআর বিষয়ক সেমিনার, কর্মশালা এবং যে সকল আইনজীবীগণ মধ্যস্থতাকারীদের প্যানেলে অর্ন্তভুক্ত হবেন, তাদেরকে নিয়ে নিয়মিত ট্রেনিং এর আয়োজন করা হলে এই পদ্ধতি সম্পর্কে অ্যাডভোকেটদের আগ্রহ সৃষ্টি হবে এবং তারা এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে পক্ষদের পরামর্শ দিবেন।

ক্স মধ্যস্থতা করার জন্য আলাদা স্থাপনার ব্যবস্থা করা
এডিআর করার জন্য কোন জেলা আদালতে কোন পৃথক স্থাপনার ব্যবস্থা না করায় মধ্যস্থতাকারীগণ মামলার পক্ষদের নিয়ে কোথায় বসবেন এ বিষয়ে বেশ সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোন কোন অ্যাডভোকেট তারা পক্ষদের নিয়ে তাদের চেম্বারে বসেন। কিন্তু বেশীরভাগ অ্যাডভোকেটদের পক্ষদের নিয়ে বসার জন্য সুন্দর জায়গা নেই। প্রত্যেক জজকোর্ট বা ম্যাজিস্ট্রেসিতে মধ্যস্থতা করার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হলে এই ব্যবস্থা সফল হবার পথে অনেক গতি পাবে।

ক্স মধ্যস্থতাকারীদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা
কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। একজন প্রশিক্ষিত মধ্যস্থতাকারী একজন সাধারণ মধ্যস্থতাকারী অপেক্ষা অনেক বেশী মামলা মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে সক্ষম। এডিআর ব্যবস্থাকে ফলপ্রসু করতে হলে প্রত্যেক জেলায় প্রশিক্ষিত মধ্যস্থতাকারী তৈরী করতে হবে। আর প্রশিক্ষিত মধ্যস্থতাকারী তৈরীতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা আবশ্যক। প্রত্যেক জেলার আইনজীবী সমিতির সদস্যদের মধ্য হতে নবীন, মেধাবী ও উদ্যোগী আইনজীবীদের ঢাকাতে বা বিভাগীয় শহরে নিয়ে এনে এডিআর বিষয়ক ট্রেনিয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে আবার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটেও তাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া দেশে বা বিদেশের প্রশিক্ষিত মধ্যস্থতাকারী দিয়ে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে বা জেলা শহরেও ট্রেনিং এর আয়োজন করা যেতে পারে।

মধ্যস্থতাকারীদের দেশের প্রচলিত দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনের পাশাপাশি ভূমি আইন, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন খতিয়ান সম্পর্কিত বিধিবিধান, একজন মানুষের মানষিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এজন্য ভূমি সংক্রান্ত আইনসমূহের পাশাপাশি মনোবিজ্ঞানের কিছু বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। কেননা মধ্যস্থতার সময় পক্ষদের মানষিক অবস্থা ও মনোভাব বিষয়ে ধারণা করতে পারলে কোন বিরোধ আপোষে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সফলতার হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।

ক্স মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে এডিআর বাধ্যতামূলক করা
মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে এডিআর পদ্ধতিকে বাধ্যতামূলক করা হলে যে মামলাগুলোর বিরোধীয় বিষয় সামান্য ও যেগুলো সহজে আপোষযোগ্য সেগুলো নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। অনেক বাটোয়ারা মামলা রয়েছে, যেগুলোতে মামলার বিরোধ খুব সামান্য যেমন জমির আইল ঠিকমতো নেই বা সীমানা নিয়ে বিরোধ অথবা জমির অংশে একটু গন্ডগোল ইত্যাদি। কিন্তু এই মামলাগুলোতেই দেখা যাচ্ছে যে, ৫/৭ বৎসর ঘোরার পর একটি প্রাথমিক ডিক্রি হচ্ছে, তার আপীল নিষ্পত্তি হয়ে আসার পর কমিশন করে উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে চুড়ান্ত ডিক্রি, এরপর জারী মামলা। সবকিছু শেষ হতে লেগে যাচ্ছে ১০-১৫ বৎসর। অথচ এই মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হতে বড়জোর ২/৩ মাস সময় লাগে।
একজন প্রশিক্ষিত মধ্যস্থতাকারী মামলার উভয়পক্ষকে নিয়ে ২/৩ বার বসলেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। ছোট খাট বাটোয়ারা মামলা ছাড়াও কিছু অগ্রক্রয়ের মামলাও আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তিযোগ্য। এছাড়া স্বত্ব ঘোষনার কিছু মামলা আছে যেগুলোতে আসলে দুপক্ষের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারো নামে ভুলভাবে রেকর্ড হয়েছে বা খতিয়ানে অংশের কমবেশী হবার কারণে তাদের মামলা করতে হয়েছে। এডিআর পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হলে এসব মামলাগুলো মামলার প্রাথমিক অবস্থাতেই আপোষে নিষ্পত্তি করা সম্ভব। ফলে বছরের পর বছর মামলার পক্ষদের আদালত প্রাঙ্গনে ঘুরতে হবে না। বরং তারা ২/৩ মাসের মধ্যেই তাদের মামলা নিষ্পত্তিতে সক্ষম হবেন।

ক্স এডিআর করতে আগ্রহীদের নিয়ে প্যানেল প্রস্তুত করা
এডিআর সংক্রান্ত আইন পাশ হবার পর প্রত্যেক জেলার জেলা জজকে মধ্যস্থতাকারীদের প্যানেল প্রস্তুতের জন্য বলা হয়। কিন্তু প্যানেলে সিনিয়র আইনজীবীদের অর্ন্তভুক্ত করার কারণে এবং উক্ত সিনিয়র আইনজীবীগণ ব্যস্ততার কারণে মধ্যস্থতার জন্য সময় দিতে না পারায় এই এডিআর ব্যবস্থা আশানুরূপ সফলতা পায়নি। ব্যস্ত সিনিয়র আইনজীবীদের স্থলে যদি আগ্রহী, মেধাবী ও নবীন আইনজীবীদের যদি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ করা যেতো তাহলে এই আইন কিছুটা হলেও হয়তো সফলতা পেতে পারতো। এ কারনেই এই আইনটি পুনরায় কার্যকর করার সময় অবশ্যই এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এডিআর করতে আগ্রহী এবং মধ্যস্থতা করাটাকে যারা পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারবেন তাদের সমন্বয়ে প্যানেল প্রস্তুত করা হলে এই এডিআর পদ্ধতি অনেকাংশে সফলতা পাবে।

ক্স প্রত্যেক জজশীপে একজন পূর্ণকালীন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ দেয়া
এডিআর পদ্ধতিকে সফল করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রত্যেক জেলা জজ আদালতে কমপক্ষে একজন পূর্ণকালীন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ দেয়া। উক্ত মধ্যস্থতাকারী বিচারক, অ্যাডভোকেট বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য হতে নিয়োগ করা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একজন পূর্ণকালীন মধ্যস্থতাকারী একজন বিচারক অপেক্ষা ৫ গুন বেশী মামলা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবেন।

একজন পূর্ণকালীন মধ্যস্থতাকারী এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া উচিত যার চাকুরী বা পেশায় অন্তত ১০ বৎসরের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং যার দেওয়ানী বা ফৌজদারী সব আইনের উপর সাধারন জ্ঞান রয়েছে। মধ্যস্থতা বিষয়ে তার প্রশিক্ষণ থাকাটাও একটি পূর্বশর্ত। তবে মধ্যস্থতাকারী একজন বিচারক হলে এই এডিআর ব্যবস্থা অধিক ফলপ্রসু হবে। কেননা ১০ বৎসরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যুগ্ম জেলাজজ পর্যায়ের একজন বিচারক সবচেয়ে বেশী মনোযোগ সহকারে উভয় পক্ষের সমস্যার একেবারে গভীরে ঢুকে সমাধানের চেষ্টা করবেন। আর বিচারপ্রার্থীদেরও তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস অনেক বেশী থাকবে। এজন্য প্রয়োজন হবে প্রত্যেক জেলায় যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ে যুগ্ম জেলা জজ (এডিআর) একটি পদ সৃজন করা। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিচারক মধ্যস্থতাকারীগণকে সেখানে নিয়োগ দেয়া।

এছাড়া পূর্ণকালীন অ্যাডভোকেট মধ্যস্থতাকারীও নিয়োগ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারকের বেতনের সমান মাসিক বেতনে নিয়োগ করা যেতে পারে যাতে করে তার জীবিকার জন্য অন্য কোন আয়ের উৎসের সন্ধান না করতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত বিচারক যারা এ ধরনের কাজ করতে আগ্রহী তাদেরকেও মাসিক ভাতার ভিত্তিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে।

এডিআর পদ্ধতি আমাদের দেশে সফল হবার সম্ভাবনা
অনেকেই ধারণা করেন যে, এডিআর পদ্ধতি এদেশে কার্যকর করা সম্ভব নয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এদেশে দেওয়ানী আদালতে বিচারাধীন বেশীরভাগ দেওয়ানী মামলা আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব। কিছু মামলা আছে যেগুলো মামলার জটিলতার কারণে, সরকারের স্বার্থ থাকার কারণে বা পক্ষগণের অনাগ্রহের কারণে আপোষে নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয় তবে সেসকল মামলার সংখ্যা শতকরা ৩০ ভাগের বেশী না।

বাংলাদেশে এডিআর ব্যবস্থার সফল প্রয়োগের জন্য করনীয়
প্রতিটি জেলায় মধ্যস্থতার জন্য পৃথক আদালত স্থাপন করা এবং জেলার প্রত্যেকটি কোর্ট থেকে স্বল্প বিরোধের মোকদ্দমাগুলি সেখানে বদলি করা। মধ্যস্থতাকারী বিচারক মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হলে সেগুলি আবার সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারের জন্য চলে যাবে। এতে করে একজন বিচারক পূর্ণ মনোযোগ মধ্যস্থতার পিছনে দিতে পারবেন এবং পর্যাপ্ত সময় পাবেন। বিচারের মেজাজ ও মধ্যস্থতার মেজাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং পরিবেশও ভিন্ন। দুটো একসাথে চললে যে সমস্যা হয় মধ্যস্থতাকারী বিচারকের তা হবে না। ফলে সফলতার হার অনেক বেড়ে যাবে। এর সাথে মধ্যস্থতার কৌশল বিষয়ে ঐ াবচারককে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে এই পদ্ধতি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে।
অ্যাডভোকেটদেরকে মোকদ্দমায় মধ্যস্থতা করার বিষয়ে আগ্রহী করার জন্য ও মধ্যস্থতা বিষয়ে তাদের সম্পূর্ণ ধারণা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এজন্য প্রতিটি জেলার বার এসোসিয়েশন থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক অ্যাডভোকেট এনে বিভাগীয় শহরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বা প্রত্যেক জেলায় ওয়ার্কশপ এর ব্যবস্থা করা। মামলার পক্ষ আপোসে যাতে আগ্রহী হয় সেজন্য আপোষ করলে সুবিধার ব্যবস্থা রাখা ও আপোসে নিষ্পত্তি না হলে এমন কিছু পরিণতির বিধান করা যাতে করে পক্ষগণ কিছুটা ছাড়া দিয়েও আপোস করতে উদ্যোগী হয়।

বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প পদ্ধতি সাধারণত দেওয়ানি মোকদ্দমায় ব্যবহার হয়ে থাকে। ফৌজদারি অপরাধগুলোর একটি বিরাট অংশ সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। সে কারণে সেগুলো আদালতের মাধ্যমে আপোষ করার সুযোগ বর্তমানে নেই। কেননা খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চোরাচালান, দূর্নীতি ইত্যাদি অপরাধসমূহ টাকার বিনিময়ে আপোসের সুযোগ থাকলে রাষ্ট্রের কাঠামো ও স্থিতিশীলতা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ ফৌজদারী মামলা যৌতুক নিরোধ আইনের আওতায় ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধ- যেগুলো আপোসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি সম্ভব। সুতরাং ফৌজদারী মামলায়ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন প্রচলন করা প্রয়োজন।

উপসংহার
একটি মামলা দায়েরের পর আদালতের অতিপরিচিত চিত্র হলো মামলার প্রতিটি পর্যায়ে বছরের পর বছর সময় চলে যাবে অথচ মামলার পক্ষগণ জানতে পারবে না যে কবে তার মামলা নিষ্পত্তি হবে, তাতে কত খরচ হবে বা আদৌ তা নিষ্পত্তি হবে কিনা। আমাদের বিচার ব্যবস্থাতে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয় এবং দশকের পর দশক অনুৎপাদনশীল কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয় উপেক্ষিত ও অবিবেচিত। আমাদের দেশের আদালতসমূহে বিচারাধীন মামমলার সংখ্যানুপাতে বিচারক অপ্রতুল। আবার অধিক বিচারক নিয়োগও আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় সমীচীন নয়। এমতাবস্থায়, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন একদিকে যেমন এসব জমে থাকা মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে তেমনি কম সময়ে ও কম খরচে মোকদ্দমা নিষ্পত্তির ফলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাও বাড়বে।

মোকদ্দমায় অত্যাধিক ব্যয় ও দীর্ঘসূত্রীতা কমাতে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের অন্তর্ভূক্তি নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এই আইন আশানুরুপ সফলতা লাভ করতে পারে নি। এর প্রায়োগিক সমস্যাসমূহ নিরসন করা গেলে এই আইন প্রত্যাশিত সাফল্য লাভে সক্ষম হবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ বিচারপ্রার্থী মানুষ তাদের মামলা আপোসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী। সুতরাং আপোসমূলক একটি কার্যকর পদ্ধতি আমাদের দেশের আদালতসমূহের জমে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে- বিচার ব্যবস্থায় উন্মোচিত হবে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত।

ড. এবিএম মাহমুদুল হক
ভোলা জেলার জেলা ও দায়রা জজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top