অচেনা ঘোর – শাহানা সিরাজী
১.
আম্মা চুল ধরে একটা কঠিন মার দিলো। আম্মার মুখের আকার এখন স্বাভাবিক নেই। ঠোঁট উল্টে আছে, শান্তচোখ দুটো বাঘিনীর মতো ক্ষীপ্র হয়ে উঠেছে, নরম হাত হঠাৎ এমন কাঠ-লারকি হলো কী করে! হুঙ্কার দিচ্ছে যেন এখনই কেটে- টেনে-হিছড়ে-চিবিয়ে-চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন! এখনই প্রাণ বুঝি এই পৃথিবীকে বিদায় জানাবে! আত্মরক্ষার যতোই চেষ্টা করি না কেন আম্মার এ জ্বলন্ত মূর্তির হাত থেকে রেহাই নেই। খেয়ে যাচ্ছি কঠিন মার। কী করে আম্মাকে বলি, কেন আমি ঘুমের ভেতর হাঁটি। আমি হাঁটি না তো! দাদীর সাথে ঘুমাই। অনেক রাতে পড়া শেষ করে ঘুমাতে যাই। তারপর কী হয় আমি জানি নাতো! দাদী প্রায় আমাকে কলের পাড় থেকে, পুকুরের ঘাট থেকে, তুলাগাছের তল থেকে ধরে এনে আবার বিছানায় শুয়ে দেন। এ সবের আমি কিছুই জানি না। সকাল হলেই দাদীর কান্না কাটিতে আম্মা ত্যাক্ত হন। আব্বা জমিদার টাইপের মানুষ। জমি-জিরাত নিয়ে দেন-দরবার করেই দিনরাত কাটে। সংসারের কোথায় কী ঘটছে আব্বার দেখার সময় নেই! দাদীর কান্নাকাটিতে আম্মা কাউকে কিছু না বলে সোজা আমাকে মার। বল কই যাস? কোথায় তোর নাগর? মার খাওয়া রেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম নাগর কী ? আম্মা মেরেই যাচ্ছেন। মারতে মারতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তখন হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। আঁচলে মুখ ঢেকে রান্না ঘরের দিকে গেলেন। ততোক্ষণে খড়ের আগুন চুলা থেকে বেরিয়ে বেড়া ছুঁই ছুঁই। দাদী শান্ত ভাবে এ সব দৃশ্য দেখলেন। তারপর এ সকালেই আমার পরহেজগার দাদী ছাতা হাতে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। ঠিক দ্বিপ্রহরের পর ফিরে এলেন। গোসল করলেন। আমি তখনো সেই ধূলোমাখা মাটিতেই বেঘোর পড়ে আছি। আম্মা যেমন কাছে এসে দেখেননি তেমনি কেউই না। হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমাকে ডাকছে, ধূলোয় পড়ে আছিস কেন? উঠ, এ দিকে আয়। মেম্বার বাড়ির দরজায় তেঁতুল গাছে প্রচুর তেঁতুল। চল তেঁতুল পাড়ি। আহা! জিবে জল এসে গেলো। আমি সোজা হাঁটা শুরু করলাম। দাদী মাত্র খাবার মুখে দেবেন, ঠিক সে সময় খেয়াল করলেন, যেমন করে দাদীর বিছানা থেকে রাতের বেলা উঠে যাই তেমনই এখনও উঠে যাচ্ছি। দাদী কবিরাজকে ইশারা দিলেন। কবিরাজও দাদীকে ইশারা দিলো। আমি হাঁটছি,তাঁরাও হাটছেন। আমি হাঁটছি বন বাদাড় ডিঙিয়ে সোজা। মেম্বার বাড়ি যাবার রাস্তা কিন্তু সোজা নয়। হালকা মেজাজে এগিয়ে যাচ্ছি।
২.
তাঁরা আমার সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আমার কানে আবার ভেসে আসছে, আরে এতোক্ষণ লাগে? তাড়াতাড়ি আয়। মেম্বারের ছেলে আসলে আস্ত রাখবে না। আমি হি হি করে হেসে উঠলাম। এই ভর দপুরে একটা বারো বছরের মেয়ে যদি এ রকম হিহি হাসে আর হাওয়ার বেগে উড়ে চলে কে না ভয় পায়? আমার দাদী চিৎকার করে কান্না করতে গেলেন কিন্তু পারলেন না। কবিরাজ থামিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে তেঁতুল গাছের তলে চলে এলাম। আমার দাদী জানে আমি গাছে উঠতে পারি না। কিন্তু সেদিন দাদী দেখলেন তরতর করে তেঁতুল গাছে উঠে গেলাম। আবার শুনেতে পেলাম, এই আমারে একটা দেয়। সব নিজে খাচ্ছিস কেন? একটা তেঁতুল ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারলাম নিচে। তেঁতুলটি কবিরাজের নাকের উপর পড়লো। উপর থেকে পড়ায় নাক ফেটে রক্ত বের হয়ে গেলো। একটা শিস দেয়ার শব্দ কানে এলো। সারা শরীর হিম হয়ে গেলো। ভয়ে নয় অদ্ভুত এক ভালো লাগা। থরথর কাঁপছি। কিন্তু কেন বুঝতে পারছি না। একটা অবয়ব চোখের সামনে স্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে যায়। কে? কে? মেম্বারের ছেলে নয় তো! তাহলে তেঁতুল পাড়ার অপরাধে আজই খবর আছে। চুপ করে বসে থাকার পাত্রি আমি নই। যা হয় হবে। তেঁতুলের একটা ডাল ধরে আর একটি ডালের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওড়নার খোটে তেঁতুল। শিসটি ক্রমশ কাছে আসছে মনে হলো। হ্যাঁ,ওই যে, এতো সুন্দর শিস দিতে পারে সে! মুখটি দেখা হলো না। চুল দেখে মনে হলো,লাভলু। মেম্বারের ছেলে। চলে গেলো পাশ কেটে। কবিরাজ আর দাদী ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রইলো। একই নিয়মে আমি তেঁতুল তুলেই যাচ্ছি। আবার কে যেন ডাকছে, আরে সে চলে গেছে, এবার নেমে আয়। আমি ধীরে ধীরে নেমে পড়লাম। দাদী আমাকে ধরে বাড়ির পথে ফিরিয়ে আনলো। একই রকম সেই ধূলোমাখা উঠানেই আমি শুয়ে পড়লাম এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রইলাম।
৩.
দিনদুপুরে দাদীর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা দাদীকে বিচলিত করছে। আম্মা এসে ঘুমের ভেতরই আবার লাত্থি উষ্ঠা দিতে শুরু করলো। কোন নাগরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিস? দেখা হয়েছে বুঝি? দাদী এবার আম্মাকে কষে চড় লাগিয়ে বললেন, আরে থাম, ওর সাথে ভূত আছে। আমি জেগে দেখি আমার কোচড় ভর্তি তেঁতুল। এগুলো এলো কোথা থেকে! বিস্ময়ে হতবুদ্ধ হয়ে গেলাম। দাদী আম্মাকে বললেন, ময়না গাছে উঠতে পারে? দেখেছিস কখনো? আম্মা বললেন, পারে না। কিন্তু পারতে কতোক্ষণ! তুই মা হয়ে মেয়ের বদনাম দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস! বেশরম! আম্মা গজ গজ করছেন, নাগর এসে পড়লো বলে। ঠিক তখনই লাভলু এসে আম্মার কাছে নালিশ‘ দিচ্ছে আপনার মেয়ে আমাদের কাঁচা তেঁতুল সব পেড়ে নিয়ে এসেছে। ’ তাকিয়ে দেখে আমি ধুলোয় ধুসরিত, মুখে পাঁচ আঙুলের দাগ, হাতে মোটামোটা দাগ ফুলে ফুলে আছে। চুল এলোমেলো কিন্তু জ্বলজ্বলে চোখ উজ্জ্বল , যে চোখ একটু আগেও আম্মার মারের চোটে ঝরছিলো। লাভলু আমার দিকে তাকিয়েই এক চিৎকার দিলো। চাচী এটা কী করলেন!
আম্মাও ঝাঁঝ মিশিয়ে উত্তর দিলেন, কেন তোমাদের তেঁতুল পাড়েনি? সে অন্যায় করেনি? এ শাস্তি তার প্রাপ্য। লাভলু অবাক আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো, মাথায় হাত দিয়ে বললো, শিস বুঝি তোর খুব পছন্দ। মুখে হালকা মৃদূ হাসি, আমার যে কী হলো! এমন লাগছে কেন? কোথায় যেন সব উল্টা-পাল্টা হয়ে যাচ্ছে। কানের ভেতর শোঁ শোঁ কিসের শব্দ! হার্টবিট এতো বাড়লো কেন? লাভলু একই ভাবে তাকিয়ে আছে। আম্মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, শোন ছেলে, তোমার বাবা মেম্বার হতে পারে, তোমার যে শিক্ষা দীক্ষায় মন নেই তা আমি জানি। আমার মেয়েটি মেধাবী তাকে আমি লেখাপড়া শেখাবো। তুমি এখন আসতে পারো। তার বাবা বাড়ি এলে তেঁতুলের টাকা দিয়ে আসবে।
লাভলু আরো কাছে এসে বিজলীর মতো আম্মার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার ঠোঁটে চুম এঁকে দিয়েই দৌড়। চাচী তেঁতুলের টাকা দেয়া লাগবে না। কাল আমিই ওকে তেঁতুল দিয়ে যাবো। বলতে বলতে হাওয়া। আমি দড়াম করে বসে পড়লাম। চোখ থেকে অনবরত জল ঝরছে। এতো ঘটনার কোনটাই আমার মাথায় কাজ করছে না।
৪.
পড়তেই আছি,পড়তে পড়তে সিজদাহতেই ঘুম এবং সেই ডাক, আজ তোর জবাফুল গাছে এতো ফুল ফুটেছে যে, দেখলে অবাক হয়ে যাবি, আয় দেখবি আয়…
আমার সিজদাহ দেখে দাদী খুশি হয়ে গেলেন, খুশি মনেই আবার নিয়ত করলেন, তখনো চারদিকে অপার্থিব এক নীরবতা, এক কুহক মায়া জাল বিছিয়ে রেখেছে। ঘোরাক্রান্ত আমি দরজার ছিটকিরি খুলে এগিয়ে গেলাম আমার জবা গাছটির কাছে। আমার দাদী নিয়ত ছেড়ে আমাকে অনুসরণ করলেন। দেখলেন, ফুলের পাপড়িতে নাক ডুবিয়ে গাছটিকে জড়িয়ে আমি ঘুমিয়ে আছি । যেন গাছকন্যা। আমার চারপাশে অসংখ্য রক্তজবা ভোরের মৃদূল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। কেউ যেন হাত ধরে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে গন্ধরাজফুলের ঝোঁপের ভেতর, সাদা সাদা ফুলের কন্ঠে বিরল আওয়াজ, তোর বুঝি শিস খুব পছন্দ! এবার কোন দিকে পা বাড়ালাম। মেম্বার বাড়ির দিকে? মনে নেই। আমার দাদী আমাকে ধরে এনে বিছানায় শুইয়ে দোয়া ইউনুস পড়ে ঝাড়তে লাগলেন।
পরদিন সকালেও আম্মা আচ্ছামতো মারলেন। আজও কোন কথা বলিনি। মনের কথা মনেই আছে। জ্বরের সাথে মার। আব্বার উপর ক্ষেপে গেলাম, আব্বা কেন বাড়ি আসে না? আম্মার এতো মেজাজ আব্বা নেই বলেই। পেয়েছে আমাকে কলুর বলদ! আজ মার খেয়ে আব্বা আসার পথের পরে বসে রইলাম। ক্লান্ত দেহে আবারো ঘুম। যথারীতি আবারো ঘোর। এবার যেন শুনতে পেলাম,চল স্কুলে যাবি। বৌচি খেলবো। কে ডাকলো? নুরজাহান? পান্না? রায়হান? কণ্ঠস্বর খুব অচেনা লাগলো। আমি হাঁটা শুরু করলাম স্কুলমুখে। পৌঁছে গেলাম। স্কুলের বেঞ্চিতে প্রথম আমার জায়গা। আমার রোল নাম্বার এক। আমার জায়গায় বসে পড়লাম। কিন্তু হেড স্যার আমাকে আবিষ্কার করলেন, আমি বেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমুচ্ছি। শেকান্তর স্যার আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। এতো সকালে স্কুলে বই-খাতা ছাড়া,অগোছালো আমাকে দেখেই অবাক হলেন। কিছু অনুমান করার চেষ্টা করলেন। গায়ে মারের তো দাগ! কে মেরেছে? তিনি রীতিমতো আৎকে উঠলেন। আমার ফার্স্ট গার্ল্ ,তার এ অবস্থা কে করলো! তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে দেখেন প্রচন্ড জ্বর। চোখ খুলতে পারছি না। তাঁর কোলেই মাথা এলিয়ে দিলাম। পরম মমতায় তিনি আমাকে তাঁর কক্ষে নিয়ে গেলেন। মাথায় পানি ঢাললেন, দোকান থেকে চা বিস্কুট আনিয়ে নিজেই যত্ন করে মুখে তুলে দিলেন। আমার চোখ থেকে ঝরঝর জল ঝরছে। বললাম,স্যার বাবা, উনাকে আমি বাবা ডাকতাম, কিন্তু আগে স্যার লাগাতাম, সরল অঙ্কের নাম কে সরল রাখলো? কাল একটিও অঙ্ক মিলেনি। তিনি হাসলেন,নিয়ম মানিসনি নিশ্চয়ই। এবার বলতো এখানে এতো সকালে কী করেতে এলি? বই খাতা কই?
৫.
এতো আদুরে নরম গলা পেয়ে আমার সাহস বেড়ে গেলো, বললাম, আব্বা অনেকদিন বাড়ি আসেন না। আব্বার পথের পরে বসে পাহারা দিচ্ছিলাম। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছি। তারপর দেখি আমি আপনার কোলে। এখানে কী করে এলাম বলতে পারবো না। তিনি বললেন, স্বপ্ন দেখেছিস বুঝি! আমি বিস্কুট গিলতে গিলতে বললাম, স্যার বাবা, আমি যেন শুনলাম, কে যেন ডাকছে, চল স্কুলে যাই, বৌচি খেলবো। তারপর স্কুলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু এখানে কী ভাবে এলাম বলতে পারবো না।
স্যারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা গেলো। চল বাড়ি যাবি। ড্রেস পরতে হবে না? বই খাতা আনতে হবে তো। বাড়ির কথা শুনে ভড়কে গেলাম। আম্মার মার আবার কপালে আছে!
স্যার বাবা যেন বুঝতে পারলেন,চল কিছুই হবে না। ভয় পাসনে। আমি আছি।
কী আশ্চর্য ! আমি স্যার বাবার হাত ধরে নাচতে নাচতে কথা বলতে বলতে সরল অঙ্ক মেলাতে মেলাতে বাড়ি ফিরলাম। আম্মা স্যার এর সাথে কী মিষ্টি করে কতো কথা বললেন! নাস্তা খাওয়ালেন। স্যার সবই বললেন, আমাকে কোথায় পেলেন বললেন না। আমি তৈরি হয়ে আবার স্যার বাবার হাত ধরে স্কুলে চলে এলাম। স্কুল ফেরৎ আমার চোখ মুখে এক ধরণের আলোর প্রভা দেখা যাচ্ছে। চোখ উজ্জ্বল, স্বভাবে চঞ্চল পা যেন মাটি স্পর্শ করছে না। অথচ তখনো আমার গায়ে তীব্র জ্বর। দাদীর গা ঘেষে বসলাম, দাদীর পান পাতা সব ছিঁড়ে কুচি কুচি করে বাতাসে উড়িয়ে দিলাম। হো হো করে হাসছি। কবিরাজ দাদীর কানে কানে কী যেন বললেন, দাদী ব্যস্ত হয়ে আম্মাকে ডাক দিলেন। আম্মা শুনে বললেন, কচুর ভূত! যা ইচ্ছে করেন। হয়তো মনে মনে চেয়েছেন,মেয়ের কী হলো! জানি না সেটা। খাবার দিলো তাও ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। টেবিলে একটিও পানির গ্লাস নেই সব আছাড় মেরে চুর চুর করে ফেলেছি। দাদী দুহাতে শক্ত করে আমাকে ধরে রাখলেন। কবিরাজ ইতোমধ্যে চক্র আঁকলেন, হরিতকি গাছের ডাল বের করলেন, আরো কী কী গাছের ডাল,শেকড়, মানুষের খুলি, হাড় বের করে চক্রের চারপাশে রাখলেন। আমাকে চক্রের ভেতর বসিয়ে মন্ত্র পাঠ করলেন, এক গ্লাস পানি দিয়ে বললেন, দেখো এখানে কী দেখতে পাও? আমি মাথা নাড়লাম, দেখতে পাই। কাকে দেখো? চুপ করে আছি। কী বলবো! আমি লাভলুকে দেখতে পাই। আম্মা শুনলে জ্যান্ত কবর দেবে। কবিরাজ জোর দিয়ে বললেন.খাজা বাবাকে দেখতে পাও। আমি হেসে দিলাম। হ্যাঁ,খাজা বাবা কী সুন্দর শিস বাজায়। কবিরাজ মহা খুশি। উনি আমার কনিষ্ঠ আঙুল চেপে ধরে বললেন, তোর নাম কী? আমার নাম ময়না। আরে না,ময়না তো আমার মেয়ের নাম, তোর নাম বল। মহা মুশকিল। বুদ্ধি করলাম অন্য নাম বলতে হবে। নইলে এ বাঁদরের কাছ থেকে আমার মুক্তি নেই। বললাম,টইনকিয়া। ঘাড়ে ছেপেছি গত মাসের পাঁচ তারিখে।
এখন যাবি কবে বল। কী জানি কখন যাই। আরে যেতে হবেই তোকে। গোল মরিচ পুড়ে ধরলো নাকের কাছে। আচ্ছা এভাবে বাঁচা যায়? কী শুরু হয়েছে? বললাম এখনই যাচ্ছি।
যা । ঝাড়–মুখে যা। আমার গায়ে জ্বরের মাত্রা হতে পারে একশ চার ডিগীর মতো। মাথা তুলতে পারছি না। আমার হুঁস নেই এখন। কবিরাজ নাকি ঝাড়– মুখে তুলে দিয়ে বাড়ির দরজা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে আমাকে। সারা পাড়ার সব মানুষ সে তামাশা দেখেছে। পরে আমার ভাই আমাকে বলেছে। সেদিন থেকে টানা এক সপ্তাহ আমার হুঁস ছিলো না। দাদী আমার নাসিং করেছেন। আম্মা কাছেই আসেননি। মা কেমনে এরকম হয়! এ এক সপ্তাহে বহুবার আমি মেম্বার বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেছি। আমি যেন শুনতে পাই, দেখলি তোর স্যার বাবা আমাকে কেমন করে মারলো। আমি না পড়লে উনার কী! হাত থেকে রক্ত পড়ছে। আমি এগিয়ে যাচ্ছি রক্ত মুছে দিতে। শিস শুনতে। এমন কঠিন অবস্থাতেও শিস শোনানো থামেনি। আমার দাদী ছায়ার মতো আমার সাথে লেগেছিলো। একবার এমন অবস্থা হয়েছে যে আমি ছুটছি স্যার বাবাকে কেটেই ফেলবো এভাবে কেউ কাউকে মারে! দাদী আমার সাথে সাথে চলতেন বলেই ফিরে এসে আবার ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যেতাম। এক সপ্তাহ পরে দাদীকে ডাকলাম, দাদা পানি খাবো। আমার দাদী কাঁদতে কাঁদতে হাসলেন। জড়িয়ে ধরলেন। তোর কী হয়েছে, বলতো?
এভাইে চলতে চলতে আম্মা বিরক্ত হয়ে আমার পায়ে শেকল বেঁধে রাখতেন যখন আমি ঘুমাতে যেতাম। আমার দাদী নীরব হয়ে গেলেন। কবিরাজ বাড়ি থেকে বিদায় হলো। এ কান সে কান করতে করতে পাড়াময় ঢিঢি পড়ে গেলো,ময়না পাগল হয়ে গেছে। তাকে তার মা শেকল বেঁধে রাখে। এখন রাতদিন শেকল বাঁধা থাকি। স্কুলে যাওয়া বন্ধ। আমার স্যার বাবা আমাকে দেখতে এসে চোখের পানি ফেললেন। তোর কী হয়েছে। আমি অবাক! কই নাতো আমার কিছুই হয়নি!
তোর পায়ে শেকল কেন?
আব্বা অনেক দিন বাড়ি আসে না। তিন মাসে হবে। আম্মার অনেক রাগ আব্বার উপর তাই আমাকে শেকল পরিয়ে রেখেছে। তারপরই বললাম স্যার বাবা সরল অঙ্ক সত্যি সরল।
কেমনে বুঝলি?
৬.
কেমনে বুঝলি?
বললাম জলের মতো। সময় মতো বাঁধ না দিলে নতুন করে পথ করে নেয়। আমার শুধু একটাই ভয় , আম্মা আমাকে আর স্কুলে পড়তে দেবেন না। তুই তো অসুস্থ। কে বললো? পায়ে শেকল কতো কারনেই লাগায় চীনারা দেখেন না বাচ্চাদের লোহার জুতো পরায় পা যাতে বড়ো না হয়!
আমার আম্মাও চান না তার মেয়ে বেশি হেঁটে পা ক্ষয়ে দিক। বলেই হাসতে শুরু করলাম। স্যার মেনে নিলেন আমি পাগল!
শুরু হলো সত্যিকারের পাগলের সাথে যে আচরণ করে ঠিক সে আচরণ। আমার ঘুম নিদ জাগরণ সব কিছুতেই এলো অস্বাভাবিক পরিবর্তন। ঘুমাতে ভয় যেতাম। কিন্তু ঘুমাতেই ইচ্ছা করতো। কারণ ঘুমালেই সেই মিষ্টি কণ্ঠ -তুই বুঝি শিস পছন্দ করিস! কিংবা আম্মার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠোঁটে চুম দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সে দৃশ্য- অকারণ আনন্দ জাগায়। আম্মাকে সহ্যই হয় না। আম্মা যেমন রোজ মার লাগায় আমিও তেমনই রোজ হাতের কাছে যা পাই তাই ছুঁড়ে মারি। আম্মাকে তুই তোকারি করি। যা , ফকিরের ছা,বাপের বাড়ি যা। আমার বাপের বাড়ি ছাড়।
দাদী রোজ খাবারের প্লেট সামনে নিয়ে চোখ ভাসায়। ভাই ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকায়। আমার কেবল হাসি পায়। অট্টহাসি। হাসতে হাসতে কাঁদতে থাকি। কেন কাঁদি জানি না। দাদী আমার মুখে খাবার তুলে দেয়। বলি আমার হাত আছে হাতটা খুলে দিন। আমি পড়বো। কে শোনে কার কথা! তোর সথে দাদু জিন আছে। তোকে ঘুমের ভেতর কোথায় কোথায় যে নিয়ে যায়! তোর বন্ধুরা কেউ তোর কাছে আসে না। এমন কি তোর ভাইও তোকে ভয় পাচ্ছে। কী হয়েছে,দাদু? আমি ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকি। আমি তো জানি না আমার কী হয়েছে! শুধু বুকের ভেতর কেমন যেন লাগে, কোথায় কে যেন ডাকে! চুপ করে থাকি। সে দিন থেকে আমি চুপ হয়ে গিয়েছি। ঘুমাই না। ঘুম এলে চোখে বালি ঘষে দিই। কতো দিন ঘুমাই না। কতো দিন। এক মাস,দুই মাস, এক বছর হয়ে গেছে। আমার পায়ে নূপূর থাকতে পারতো সে পায়ে শেকল। একদিন দেখি এমন ঘুম এসেছে যে ঘুমিয়েই পড়েছি। আবার সেই ঘোর, তুই বুঝি শিস খুব পছন্দ করিস! আমি যেন আটলান্টিকের গহীন থেকে জেগে উঠছি, চোখ বড়ো বড়ো করে বলছি, সবাই আমাকে পাগল বলে,পায়ে আমার শেকল,আসবো কী করে!
আমার ঘুম ভেঙে যায়। শুনি সেই কণ্ঠ চাচী ও চাচী, ময়না কোথায়?
আম্মা সেই রকম রেগে উত্তর দিলেন, কেন? ময়নাকে দিয়ে তোমার কী কাজ! এবার পরীক্ষায় পাশ দিয়েছো নাকি! হ্যাঁ চাচী, আম্মা মিষ্টি পাঠিয়েছেন। আমার আম্মা শান্তস্বরে বললেন,পাঠিয়েছেন রেখে যাও। পরে দেখে নেবো। আরে বাবা, আসেন আমি নিজে হাতে আপনাকে একটা মিষ্টি খাওয়াই । আপনি আমার বাপের কাজ করেছেন। নইলে এবারও পাশ দেয়া হতো না। আম্মার চোখ ফাঁকি দিয়ে লাভলু আমার কারাগারে হাজির। আমাকে দেখে বেদনায় নীল হয়ে উঠলো। কিছু না বলে, ধীরে ধীরে খুব কাছে এলো। আমার চোখ আবারো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । কিসের অপেক্ষা করছি? এবার আমার এইট ক্লাসে থাকার কথা। আমার ফাইনালে আম্মা আমাকে অংশ নিতে দেয়নি। সে কষ্টে আমাকে আরো বেশি অস্থির করে তুললো। লাভলু বললো, আমি টেনে উঠেছি। পান্না এইটে। এবার পান্না ফার্স্ট। তোর স্যার বাবা তাকে নিয়েই ব্যস্ত। তোর কী হয়েছে রে? আমি কিছুই বললাম না। শুধু চেয়েই রইলাম। সে এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটে আবার চুম দিলো। এবার যেন আকাশ ছুঁলাম। চোখ বুজে বোঝার চেষ্টা করলাম, আমার নিয়তি, আমার বাঁচার উৎস তবে কী লাভলু!
এমন সময় আব্বা এসে হাজির হলেন। পুরো এক বছর বাউন্ডেলের বাচ্চা জমি-মামলা মকদ্দমা নিয়ে হাই কোর্ট ,সুপ্রিম কোর্ট করে করে মামলায় জিতে ফুলের মালা পরে ঘরে ঢুকলেন। আম্মা নববধুর মতো সেজেগুজে স্বামী সেবায় মগ্ন। আব্বা ঘরে ঢুকেই আমাকে ডাকলেন। ময়না ও ময়না … লাভলু তখন আমাকে আঁকড়ে ধরেছে , তোর কিছুই হয়নি। আবার স্কুলে নিয়ে যাবো তোকে। আমি জানি আমার কিছুই হয়নি। কেবল আম্মাকে সহ্য করতে পারছি না। চল,পালাই। কোথায়? যে দিকে চোখ যায়। আমার পায়ে শেকল! লাভলু ঠিকমতো পড়াশোনা করলে এতো দিনে অনার্স পাশ করতো। সে এখনো সেকেন্ডারি পাশ করতে পারিনি। কাজেই লাভলুর পক্ষে যা সহজ আমার পক্ষে তা মোটেই সহজ ছিলো না। সে বললো, আচ্ছা দেখছি। আমার দাদীকে ধরে এনে বললো,আপনার নাতনীকে বাঁচাতে চান? তাহলে শেকল খুলে দিন। দাদী কাঁদতে কাঁদতে শেকল খুলে আমাকে লাভলুর হাতে দিয়ে বললো,যা নিয়ে যা। এক বছর বন্দি থাকার পর আমি হাঁটতে ভুলে গিয়েছি। লাভলু শক্ত করে আমাকে ধরে রাখলো। আমি যেন পুরোপুরি তার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেলাম।
তাদের বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় নিয়ে আমাকে বসালো। পায়ে অনেকক্ষণ অলিভ অয়েল ম্যাসেজ দিতে দিতে শিস ধরলো। আমি থরথর কাঁপতে থাকলাম। অনিদ্রা,অবহেলা,আম্মার পিটুনি সব মিলিয়ে আমি বিধ্বস্ত । লাভলুর যত্ন ,তার স্পর্শ সব কিছুকে ওলটপালট করে দিলো। আমার মাথায় চিরুনী দিতে দিতে সে বলেই যাচ্ছে, চাচীর কথায় পণ করেছিলাম,পড়াশোনা শেষ করেই তোর কাছে যাবো। কিন্তু রোজ এতো ডাকিস যে থাকতে পারিনি। আমি ডাকি? হ্যাঁ,ডাকিস তো! তোর ডাকেই তো ছুটে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম তার পায়ে কী শেকল? দেখি কালশিটে একটি দাগ্। ঠিক আমার পায়ের মতো! তার চোখও লাল ঠিক আমার চোখের মতো। কতো দিন ঘুমাই না। আজ ঘুমাবো।
মেম্বার সাহেব এবং আব্বার গলার শব্দ শুনতে পেলাম। খুব ক্ষীণ,বহুদূর থেকে- লাভলু আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মুখের সাথে মুখ রাখলো। এক ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করলাম। ছটফট করছে লাভলু আমিও – চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। আব্বা চিৎকার করছেন, আমার মেয়ে কোথায়? মেম্বার চিৎকার করছেন-আমর ছেলে কেন তোমার বাড়ি যায়? এরপর আর কিছু মনে নেই। পাঠক অনুমান করতে পারেন এরপর কী হয়েছিলো…
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর সাধারণ
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক