মাধবী – শাহানা সিরাজী
এই তুমি কোথায়? কখন থেকে কোন সাড়া নেই শব্দ নেই। আচ্ছা এ ভাবে কোথায় হারিয়ে যাও। আমার ভীষণ চিন্তা হয়। পুলক হাসতে হাসতে বলে আমি শিউলির বাসায়! মাধবী সাথে সাথেই ফোঁড়ন কাটে যেতেই পারো। কেউ থাকতে আসে না। যে যাবার সে যাবেই। পুলক বুঝি দমবার পাত্র! সেও ছাড়ে কতো লঞ্চ ডুবে গেলো ! এতো কেবল খেয়া! মাধবীও বেপরোয়া, ভাসতে না জানলে যতো বড়ো লঞ্চই হোক ডুববেই! কে ধরে রাখবে? পুলক আবার বলে ,সবাই হারতেই আসে কে আসে বীর হতে! মাধবী ফোঁস ফোঁস করে ওঠে- হ্যাঁ, বীর টাঙ্গাইল নিরালা বাসস্টেশনের সেই ল্যাংড়া ফকির যে ভিক্ষা করে নিজের মানুষকে নিজের মতো আগলে রেখেছে, যে বলে আমার বউ দিয়ে আমি কেন কাজ করাবো ,মানুষ আমার বউকে খারাপ করে ফেলবে। সেই রিকশাপুলার যে বলে আমি ঠিক না থাকলে আমার বউ আমাকে জায়গা দেবে! পুলক ভেঙছি কাটে , আরে জানি জানি, মেলা শুনেছি এই গল্প। মাধবী বলে প্রতিবারই নতুন আঙ্গিকে একই গল্প আসে। শিউলি না মালতী, জহুরা না মরিয়া সে তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার কিন্তু খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিও। আর কোন কথা না বলে ফোন ছেড়ে দেয়।
মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। আজ ঈমাম সাহেব নিজেই আজান দিচ্ছেন। মাধবীর ঘরের পাশেই মসজিদ। ঈমাম সাহেব তাকে প্রচÐ সমীহ করে বলা যায়। কারণ সে কোন কথা বললে ঈমাম সাহেব গুরুত্বের সাথে তা গ্রহণ করে। এ জন্য মাধবীরও ঈমাম সাহেবের প্রতি এক ধরণের সম্মানের সাথে ভালো লাগা কাজ করে।
একদিন মাধবী ঈমাম সাহেবকে বললেন, আজান কেন সুরেলা হয় না? আজান শুনলে মন ভালো হয়ে যাবার কথা। ঈমাম সাহেব সেদিন থেকে নিজেই আজান দেন।
আবার একদিন জানতে চাইলেন,ম্যাডাম এখন কেমন লাগে? মাধবী হাসে, এখন বেশ সুরেলা আজান হয়। বুকটা ধকধক করে ওঠে। মাধবী চুপে চুপে ঈমাম সাহেবকে বলে, সামাজের সময় যে খুৎবা দেন আরবী বললে কেউ কী বোঝে? যদি সাথে সাথে বাংলাও বলে দিতেন তা হলে মানুষ জানতে পারতো তার আসলে কী করণীয় । সাদা পোশাকে আবৃত স্বর্গীয় মূর্তি মাথা নেড়ে সায় দেয়,ঠিক বলেছেন। এমনই আসা যাওয়ার পথে ইমাম সাহেবের সাথে এক ধরণের ভালো লাগা তৈরী হয়েছে। আদব-কায়দা বিনিময় হয়। কিন্তু আজান সে থেকে ঈমাম সাহেবই দিচ্ছেন। মসজিদের পরিবেশ পাল্টে গেছে। কারণ প্রায় মাধবী নিজের ইচ্ছার কথা ঈমাম সাহেবকে জানান। তিনি সেগুলো নিজের মতো করে প্রচার করেন। এটা একটা ইতিবাচক দিক। মাধবীও দারুণ এক্সাইটেড থাকে। কেন সে পুরুষ হয়নি। তাহলে তাকে অন্যের আশ্রয় নিতে হতো না! মাধবী দীর্ঘ একটা শ্বাসফেলে নিজের কাজে মন দেয়। আর পুলকের কথা ভাবে-
কেমন অগোছালো মানুষ। কোন দায়িত্ব কর্তব্য নেই। চলছেই তো চলছে। মাধবী কেন তাকে এতো ভালোবাসে? এও জানে পুলক থাকবে না। কেউই থাকে না। থাকেনি। বিয়ে তো বাবাই দিয়েছে। সংসারকে এতো মন দিয়ে ভালোবেসেছে,এতো নিখুঁত দায়িত্ব পালন করেছে তবুও সংসার তাকে ধরে রাখেনি। ছাড়তে হয়েছে। সবার উপর কর্তৃত্ব করার জন্যই কী সবাই ছেড়ে যায়? নাকি আসলে সে নিজেই কিছু পেতে চায়। কী চায়? ব্যক্তিগত চাওয়া তার না শাড়ি, না চুড়ি না বাড়ি না গয়না। তবে কী? কী চায়? সবাইকে কেবল আঁকড়ে ধরতে চায়? এই আঁকড়ে ধরাই কী কাল ? সুজিতের সাথে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িকে এতো আপন করেছে যে শ্বাশুড়ি ভেবেছে তার কর্তৃত্বই শেষ। ননদ ভেবেছে এতো কেন মাস্টারি করে! দেবর ভেবেছে এতো তদারকি কেন করে। সুজিত? সে তো রীতিমতো বোরিং ফিল করা শুরু করেছে। কারণ খাওয়া থেকে চলা সবই মাধবীর ইচ্ছায় করতে হবে। এ দিকে বাচ্চাও হচ্ছে না। হবে কী করে? সারা দিনের কাজের পরে মাধবী বিছানা শুয়েই নাক ডাকা শুরু করে । এর ভেতর সুজিতের থাকা সম্ভব নয়। কালে ভদ্রে তাদের মিলন হয়। তাও মাধবীর তাড়াহুড়া। বাসায় অনেক মানুষ কে কখন জেগে যায়!্ শব্দকরা যাবে না। সুজিতের এসব কী আর ভালো লাগে! এক দিন দুদিন করতে করতে একদিন সুজিত বলেই ফেললো আসলে তোমার সাথে আর থাকতে পারছি না। প্রথমে গ্রাহ্য করেনি। বললো, কোথায় আর থাকো। থাকি তো আমিই। আমিই তো সব করি । থাকো আর কোথায়? বলেই চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিলো বললো চিনি কিন্তু কম। চিনি ¯েøা পয়জন । এখন থেকে ডাইরেক্ট চিনি খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। এতো মাস্টারি! সুজিত চায়ের বাটি ফেলে দিয়ে বললো, কালই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো। মাধবী একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সুজিতের চেহারার দিকে তাকালো, সে দেখলো তার জন্য সেখানে রয়েছে তীব্র ঘৃণা। ঠিক সে সময়ই ডাক পিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে গেলো। মাধবী দেখলো চিঠি তার নামেই।
এবাড়িতে আসার পর মাধবীর ইচ্ছা ছিলো সবাইকে নিয়ে একটি মালা গেঁথে এক সাথে থাকবে। কিন্তু কী আশ্চর্য ! সে যতোবার এগিয়ে গিয়েছে অভিভাবক হয়ে ততোবারই সবাই তাকে লাঞ্চিত করেছে। সে চুপচাপ সহ্য করেছে। ভেবেছে সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। সে আরো ভালো বাসবে সবাইকে। নিশ্চয়ই তার ভালোবাসায় ঘাটতি পড়েছে। কিন্তু না ঠিক হয়নি। এখন তাকে সবাই আতঙ্ক মনে করে। সে যেন একা হয়ে গিয়েছে। সুজিতও কেমন আচরণ করে। সে সব সময় ভাবতো শ্বশুরবাড়িকে সে ভালোবাসবে। তাহলে তাকেও সবাই ভালোবাসবে। কিন্তু হায়! মানুষ যে কিসে শান্তি পায় তা মানুষ জানে না! এতো যাদেরকে সে আগলে রাখে তারা তাকে সহ্য করতে পারছে না। একমাত্র শ্বশুর মাধবী মাধবী ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যায়। সে নিজেকে সতর্ক করলো। মাধবী এখনো তোর পিতার কথা শোন। তোকে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়িয়েছে,তুই ফার্মেসীর মতো বিষয়ে পড়েছিস, তুই তো মেধাবী ছাত্রী ছিলি । নিজেই তো কিছু একটা করতে পারিস। মাধবী চট করেই সিদ্ধান্ত নেয় চাকুরী করবে। পত্রিকায় নজর রাখলো। এখানে সেখানে এপ্লাই করতে লাগলো। ইন্টারভিউ দিলো কয়েক জায়গায়। সব জায়গা থেকেই সে আশাবাদী ছিলো। আজ প্রথম সে একটা চিঠি পেলো। খুলে দেখে এলাহী কাÐ! তার চাকুরী হয়ে গেছে নাম করা ঔষধ কোম্পানী জোহানস ফার্মায়। দারুণ, পোস্টিং ঢাকাতেই। ইচ্ছা করলে সে আজই জয়েন করতে পারে। মাধবী আবার তাকায় সুজিতের দিকে, না চেহারা একই রকম। কোন পরিবর্তন নেই। মাধবীর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সে ওখান থেকে আর ভেতরের ঘরে যায়নি। চিঠি হাতে সোজা বাপের কাছে হাজির। বললো,পঞ্চাশ হাজার টাকা দাও । আগামী মাসে শোধ দিয়ে যাবো। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বাপ তাকে কিছুই বলেনি। জানতে চায়নি টাকা দিয়ে সে কী করবে। কারণ মাধবীকে তার বাবা চিনে। নিশ্চয়ই টাকা প্রয়োজন পড়েছে। সে দিনই সে তার অফিসের পাশেই চৌধুরী পাড়ায় সে ভাড়া বাসায় ওঠে। তার বন্ধু রুদ্র একই কোম্পানীতে কাজ করে। রুদ্রই তাকে বাসায় নিয়ে এসেছে। মাধবী তার বাবাকে বললো,তুমিএকটা ভালো বাবা, আমাকে কানে ধরে লেখাপড়া শিখিয়েছো,স্বপ্ন দিয়েছো। আমি ছিলাম নারী। কেবল চেয়েছি সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে। কিন্তু বাবা তুমি চাইলেও সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে পারবে না। কারণ যাদের নিয়ে থাকতে চাও তারাও তোমাকে চাইতে হবে। তার বাবা মৃদূ হাসে। তুই যে বুঝতে শিখেছিস তাতেই আমি খুশি। তা চাকুরিটা কোথায় হয়েছে,শুনি? মাধবীর মুখে আলো ফোটে,বাবা জোহন্স ফার্মায়। তার বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে বলে ,মানুষের মন মেঘলা আকাশের মতো। চেনা যায় না। পৃথিবী অনেক সুন্দর আবার নিষ্ঠুর। সে তার বাবাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সেই মাধবীর গ্রহ থেকে ছিটকে পড়া । চাকুরীর ক্ষেত্রেও সবাইকে এমন ভাবে কাছে টানে মানুষ দিশাহারা হয়ে যায়। রুদ্রর পাশে বাসা নিয়েছে,সকাল সন্ধ্যা রুদ্রের প্রতি তার অতিমাত্রায় কেয়ারিং রুদ্রের সংসারে তুলেছে ঢেউ। মাধবী কেন তাকে এতো টেক কেয়ার করে এ নিয়ে পারমিতার অভিযোগ অনুযোগের শেষ নেই। সেদিন রুদ্রের সাথে ঝগড়া করে পারমিতা চলে যাচ্ছে বাপের বাড়ি। সামনেই পড়লো মাধবী , সে আশ্চর্য হয়ে বললো, ভাবি তুমি যাচ্ছো কোথায়? রুদ্র তোমাকে বকেছে? খারাপ কথা বলেছে? সেতো তোমাকে কষ্ট দেয়ার কথা নয়! সে তোমাকে ভালোবাসে। আমি নিজে সাক্ষী। পারমিতা থতমত খেয়ে বলে তার মাথা গরম হলে হুঁস থাকে কী বলে! মাধবী হাসে,চলো ঘরে চলো,এতো রাগ করো না। বাবুরা কষ্ট পাবে। সে নিজেই পারমিতাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ভীষণ চটে যায় । রুদ্র কী রে, বউ এর সাথে এতো খারাপ আচরণ করিস কেন? ছিঃ ছিঃ।
রুদ্র বলেই ফেললো, তোর.. এ পযর্ন্ত বলার পর পারমিতা কথা টেনে নিয়ে বলে, বাজার করতে বলেছি তাই ক্ষেপেছে। বলেই রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র মাথা নিচু করে বসে আছে। মাধবী হঠাৎ হেসে বলে, রান্না করেছো? পারমিতা, রুদ্র আমার শৈশবের বন্ধু। আমাদের সম্পর্ককে আমরা এতো উঁচুতে নিয়ে গিয়েছি যেখানে কেবল দেবতারা বাস করে। তুমি আমাকে বলতে পারতে। আমি তোমাদের সাথে কোন দূরত্ব রাখিনি। মাধবী ধৈর্য ধরে সেদিন পারমিতাকে মোকাবিলা করে। নিজেই রান্না করে খাইয়ে এসেছে কিন্তু দুঃখ যা পাবার তা পেয়েছে। নিজের ঘরে ফিরে আচ্ছা মতো চোখ ভাসিয়ে কেঁদেছে। এ দুনিয়ার মানুষ কী ভালোবাসা বোঝে না! সব কী এক জায়গায় কেন্দ্রিভূত! সবার সাথেই বুঝি মানুষ সেক্স করে! মাধবী নিজেকে আড়ালে নিয়ে এলো। হাসে কথা বলে কিন্তু সে প্রাণ আর খুঁজে পায় না। দুমাস পর একদিন রুদ্র দেখে মাধবীর ঘরে তালা। অফিসে গিয়ে শোনে মাধবী চাকুরী চেড়ে চলে গেছে। সে থেকে আর কোন দিন রুদ্র মাধবীকে খুঁজে পায়নি।
মাধবী আবার জয়েন করেছে একেবারেই নতুন একটি ইন্ডাস্ট্রিতে। নতুন কোম্পানী। তাকে স্যালারী দেবে চার লাখ টাকা। এতো টাকা সে কী করবে? তথাপি টাকা তো টাকাই। নতুন কোম্পানী ,মাধবী রাত দিন খেটে রাতারাতি কোম্পানীর মার্কেটিং বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মার্কেটিং এবং ম্যানেজমেন্ট পলিসি চমৎকার। মানুষকে ভালোবাসাই যার ধর্ম তার কথা শুনবে না এমন মানুষ অন্তত কর্ম ক্ষেত্রে থাকতে পারে না। এখানে তার সাথে সখ্য গড়ে ওঠে আবীরের। আবীরের চঞ্চলতায় সে মুগ্ধ। কিন্তু ধরা দিতে চায় না। আবীর তার চেয়ে বয়সে কিছু কম হতে পারে। মাধবী ভাবলো, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। সে তো আবার সংসার করবেই না। আবীর কেন তার পিছু নিয়েছে ! মাধবী কিছুই বলে না। জীবন সম্পর্কে সে অনেক ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। সমাজের প্রচলিত ধারায় সে বিশ্বাস করে না। এক সময় তো করতোই। চেয়েছিলো সমাজ সংসার আঁকড়ে থাকতে, পারলো কই? সুতরাং যেখানে মনের বন্ধন হবে সেখানেই সে থাকবে এবং সে ভাবেই থাকবে।
যখন থেকে আবীর তার সাথে চলাচল শুরু করছে তখন থেকে মাধবীও কেমন যেন হয়ে গেছে। বাসায় ফিরলে তার ভালো লাগে না। আজকাল শরীর জেগে ওঠে। তার মনে পড়ে সুজিতের কথা. কেমন আছে সে? সে কী মাধবীকে খুঁজেছিলো? বাবার কাছে গেলেই তো আমাকে পেতো! সুজিতের গায়ের গন্ধ এসে তাকে উথাল পাথাল করে দিলো। একা একাই খুব কাঁদলো। আমার আসলে দোষ কী ছিলো? আমি তো তাদের ভালোই বাসতাম। এখনো বাসি। মাধবীর ইচ্ছা করে তাদেরকে কাছে রাখতে। কিন্তু যে অপমান সুজিত তার নারী সত্ত¡াকে করেছে তা সে মেনে নিতে পারেনি। পারবে না। এমনই করুণ যখন মাধবীর মনের দশা তখনই কড়া নাড়লো আবীর। দরজা খোলার পর আবীর নিজেই তাজ্জব হয়ে যায় , এ কোন মাধবী! সে পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলে, মাধবী হঠাৎ কোথা থেকে এল, ফাগুন দিনের ¯্রােতে এসে, হেসেই বলে যাই যাই যাই। মাধবী দুহাতে মুখ ঢেকে ভেঙে পড়ে। আবীর হাল ধরে। কাছে আছে। পাশে বসে। এলোমেলাচুল সরিয়ে দেয়। চোখ মুছে দেয়। খুব গাঢ় স্বরে বলে আমি না হয় তোমার চেয়ে বয়সে কিছু কম কিন্তু ছোটো তো নয়। আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না? মাধবী উ™£ান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর জানালা খুলে দেয়, পর্দা সরিয়ে দেয়। আলোকে আহŸান করে। এসো এসো দক্ষিণ দুয়ার খোলো। ধীরে ধীরে মাধবী আবীরের সাথে মিশে যায়। দুহাতে জড়িয়ে নেয় তুমি পারবে আমাকে সহ্য করতে? কখন সব পেরিয়ে এসেছি জানি না। মানুষকে কাছে টানলে মানুষ পর হয়ে যায়। আমার ভয় হয় তুমিও যদি পর হয়ে যাও? না মাধবী, আমি যাবো না। কখনো না। এ রাত যদি কখনো ভোর না হতো! তোমার চোখে চোখ রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দিতাম। সেই আবীরও কিন্তু চলে গিয়েছে। কেন জানো? মাধবী খুব আঁচলে রাখতে চাইতো। অন্য কোথাও যাবে মাধবী তা হতে দিতো না। কতো দিন অভিনয় করে চলা যায়! আবীরের আকন্ঠ তৃষ্ণা! মাধবী তার ঢাল বাকীটুকু হাপুসহুপুস। যেখানেই নারী সেখানেই আবীর। আবার দেয় ছুট মাধবীর কাছে। মাধবী দেখেও না দেখার ভান করে। কারণ সে আবীরকে ভালোবাসে। আবীর খাবারের টেবিলে বলে,আমার নিয়তি তুমি। যেখানেই যাই ফিরে আমি তোমার কাছেই আসি। আসবো। কিন্তু সে দিনই ছিলো আবীরের শেষ আসা। মাধবী দিনের পর দিন বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে । আবীর ফিরেনি। চাকুরী তো কবেই ছেড়েছে। কোথায় আছে কেমন আছে কিছুই মাধবী জানে না। প্রচÐ অভিমান তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
প্রতিদিন মানুষে আয়ু কমে। মাধবীরও তাই নয় কী? এরই মাঝে মা বাবা সবাই গত হয়েছে। ভাই বোন সবাই যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত। কেউ তার খবর রাখার সময় কোথায়? আর কেইবা দায়িত্ব নেয়! রোগ হোকশোকহোক একাই তাকে সামলাতে হয়। একাই মাধবী লড়াই করে যাচ্ছে। সামাজিক জীবনে মাধবী সফল একজন মানুষ ব্যক্তি জীবনে এ কেমন সফলতা! একবার ভাবে দত্তক বাচ্চা নেবে। আবার ভাবে পরের বাচ্চা আপন নাও হতে পারে। যাক না জীবন যে ভাবেই যাচ্ছে। এখানেই মাধবী শেষ করতে পারতো তার ব্যক্তিজীবনের খাতা । কিন্তু এসে যে জুটলো পুলক। তারে সে বাঁধে না। যেমন আছে তেমনই থাক। সংসার যার জীবনে নেই , পুরুষের ভালোবাসা যার জীবনে নিতান্তই কুহক মায়া তার এ সবের দিকে তাকাতে নেই। তাই পুলক কাছে আসলে নিজে রান্না করে খাওয়ায় বটে মনে মনে এই ধরেই রেখেছে যৌবনে যে পারেনি প্রচÐ ভালোবেসেও মানুষ কাছে রাখতে এই মাঝ বয়সে পারবে, তা ভাবা যায় না। টাকার তার অভাব নেই। নিজের গাড়ি বাড়ি সবই তার আছে নেই কেবল মানুষ। একান্তই মনের মানুষ!
মুজিদের ঈমাম সাহেব তাকে যে শ্রদ্ধা করে কিংবা তার অফিসে সবাই তাকে যতোটুকু ভালোবাসে তার ছিটেফোঁটা দিয়েও যদি মাধবী নিজের হৃদয় বন্ধক দিতে পারতো!
অবিশ্বাস তাকে এতোই ধ্বংস করেছে কেউ তাকে ভালোবাসি বলারই সাহস পায় না। পুলক আজো তাকে ভালোবাসি বলতে পারেনি। মাধবী ঠিকই তিনবেলা রুটিন করে খোঁজ করে, কোথায় আছে কেমন আছে? আবারো তার অভিভাবকত্ব! সে কেন অন্য সবার মতো প্রেমিকা হতে পারে না! তার মুখে কী প্রেমের কোন আভা নেই। পুলক দেখতে পায় না? মাধবীর সামনে সে কেন ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? কেন মাধবী যা বলে তাতেই সায় দেয়? আসলে ব্যক্তিত্বের দেয়াল ভেঙে মাধবীও নিজেকে প্রকাশ করতে পারেনি। তাই পুলক যখন বললো , সে শিউলির কাছে যাচ্ছে মাধবীর কোন ভাবান্তর নেই। হালকা একটা হাসি দিয়ে বলে, মাধবীর ঝরে যাবার সময় এখন। বর্ষা শেষ হয়েছে সেই কবে? কতোদিন আর টিকে থাকবে মলয় দেশের মাধবী? এরে দিয়ে কেবল ঝোপ বানানো যায়। ঝোপের আড়ালে লুকানো যায় কিন্তু ঝোপের ভেতর কেউ প্রবেশ করতে পারে না। মাধবীর চিন্তায় ছেদ ঘটায় পুলকের ফোন। মাধবী ফোন ধরেই বলে আবার কেন ফোন করেছো?
কেন? ফোন করতে নিষেধ আছে?
-না, মানে ভাবছি কাজলের কাছে যাবো! মাধবী আবারো হাসে, আকাশ অনেক বড়ো,তাতে কতো তারা। কোন তারা কোথায় আলো ছড়ায়, কোন তারা ঝরে যায় কে তার খবর রাখে! যেতেই যদি চাও,যাও। হুইসেল দেয়ার কিছুই নেই।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে বলে ভেবো না রাত শেষ হয়ে গিয়েছে! এখনো সুবহি সাদিক বাকী, এখনো সুখ তারার হারিয়ে যাওয়ার দেরী ,এখনো আকাশ জুড়ে চাঁদ হেসে যাচ্ছে, শারদীয় দেবী দোলায় চেপেছে, মর্ত্যালোকে এখনো পদার্পন করেনি, নিশুতীরাতের পাখিরা এখনো ঘুমুচ্ছে। জোর গলায় এখনো বলতে পারি , যুবক, তোমায় অনেক ভালোবাসি। ঠিক যেন মেঘনার দূরন্ত ঢেউ,পদ্মার পাড়ভাঙা আগ্রসী আঘাত,যমুনার মিলনসুধায় অমিয় তৃষ্ণা। এখনো নিতে পারো মুঠো মুঠো, এখনো জেসমিন মাতাল করে! এখনো ছায়া খুব দীঘল হয়নি- মাধবীকুঞ্জ লতায় পাতায়মুখরিত। জবিনের স্বাদ বহুমাত্রায় সামনে এসে দাঁড়ায়। সুজিত বেঁচে আছো কিনা জানি না, ফিরে যদি আসো তোমার মতো মুখ ফেরাবো না, কেবল জানতে চাবো সুখী ছিলে তো? আবীর যদি আসো আবার প্রচÐ বৃষ্টির দিনে ছাতা বের করে বলবো, নিরাপদে পৌঁছে যাও, পুলক তো জানেই না সে আসলে কী! মাধবী নিজের ভেতর হারায়। এই যে মেকী হাসি মুখে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সবাই তারা সত্যি ভেতরে বাহিরে একই মুখোশে আছে? নাকি হাসতে হয় বলে হাসে, খেতে হয় বলে খায়! তারা কী অন্তরে বাহিরে একই সাধু! হায় জীবন! হাজার মানুষের ভীড়ে মানুষ একা! বড্ডো একা!
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর
পিটিআই, মুন্সীগঞ্জ
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।