মগের মুল্লুক! নদী তীর রক্ষায় খরচ মিটার প্রতি ৩ লাখ ৩১ হাজার কেন?

Ban_Govt4.jpg

মগের মুল্লুক! নদী তীর রক্ষায় খরচ মিটার প্রতি ৩ লাখ ৩১ হাজার কেন? 

বিশেষ প্রতিবেদকঃ কিশোরগঞ্জের ১০টি উপজেলা এবং হবিগঞ্জের একটি উপজেলার বিভিন্ন নদী ভাঙন কবলিত স্থান রক্ষার্থে নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ, ওয়েভ প্রটেকশন ও নদী ড্রেজিং/খাল পুনঃখনন করতে চায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কাজটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে খরচ হবে ১ হাজার ১১২ কোটি ৮ লাখ টাকা। পুরোটাই সরকারি অর্থায়নে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের সদর, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলি, বাজিতপুর, ভৈরব, পাকুন্দিয়া, করিমগঞ্জ ও তারাইল উপজেলা এবং হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় এই কাজগুলো করা হবে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পে ১৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজ করার জন্য ৫৭৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকার চেয়েছে। মন্ত্রণালয়টির এমন প্রস্তাবে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। তারা বলছে, এতে প্রতি মিটার নদী তীর প্রতিরক্ষায় খরচ হবে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা।

এ অবস্থায় নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজের যৌক্তিকতা কাজের যৌক্তিকতাসহ ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ ব্যাখ্যা দিতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। আগামী ১০ সেপ্টেম্বর পিইসি সভায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কমিশন সূত্র।

এ বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ১৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৫ হাজার ৪৩১ কোটি ৬ লাখ টাকা মূল্যের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা রক্ষা করা সম্ভব হবে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কশিমন বলেছে, নদীগুলো যদি ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাডের কারণ হয়, তাহলে এত দীর্ঘ তীর প্রতিরক্ষা কতটুকু যৌক্তিক, তা সভায় আলোচনা (পিইসি সভায়) করা যেতে পারে। পুরো নদীর দৈর্ঘ্য, কতটি স্থানে তীর প্রতিরক্ষা কাজ করা হবে, হাইড্রোলজিক্যাল ও মরফোলজিক্যাল স্টাডি ও ব্যথেমেট্রিক সার্ভের মাধ্যমে বিস্তারিত ডিজাইন ও এর ভিত্তিতে ব্যয় প্রাক্কলন করা প্রয়োজন।

নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজের পর কী কী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা পাবে ছক আকারে তার তালিকা ডিপিপিতে সংযুক্ত করা যেতে পারে।

এছাড়া নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের চেইনেজ, স্থান (জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন), নকশা ও এ কাজে ব্যবহৃত মেটেরিয়ালের বিস্তারিত বিবরণ ডিপিপিতে উল্লেখসহ এ খাতে ব্যয় সর্বশেষ রেট সিডিউল অনুযায়ী যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা যেতে পারে।

সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকা খরচে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন প্রস্তাব করায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে পরিকল্পনা কমিশন জানতে চেয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে মন্ত্রণালয় সভায় ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রকল্পের মেয়াদকাল যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। এছাড়াও প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ও খরচ বিষয়ে আরও অনেক প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

নদী তীর প্রতিরক্ষা ছাড়া প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম ও উদ্দেশ্য হলো ৬৫ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, হাওরের ফসল রক্ষা করতে নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন প্রতিরোধ করা। ৩৭ দশমিক ৪০০ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করে নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে ১০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে ৮টি ভিলেইজ প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ এবং ৮ কিলোমিটার ওয়েভ প্রটেকশনের মাধ্যমে হাওর এলাকায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বাসস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করা। পরিবেশের বিরূপ প্রভাব থেকে প্রকল্প এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। ৫টি আবাসিক ও ৫টি অনাবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে ৪৩ শতাংশ। পাশাপাশি করা হবে বৃক্ষ রোপন।

প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, হাওর পরিবেষ্টিত কিশোরগঞ্জের উল্লেখযোগ্য নদীর মধ্যে ধনু, ঘোড়াউত্রা, বৌলাই, কালনী-কুশিয়ারা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ অন্যতম। ধনু নদী সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় প্রবাহিত বাউলাই বা বালু নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায় ঘোড়াউত্রা নদীতে পতিত হয়েছে। নদীটির গতিপথ অধিকাংশই হাওর এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ঘোড়াউত্রা নদীটি কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার শিংপুর ইউনিয়নে ধনু নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এরপর নদীটি একই জেলার বাজিতপুর উপজেলার মাইজচর ইউনিয়নে মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। পথিমধ্যে সিঙ্গুয়া (সোয়াইজানী) নদীটি নিকলী উপজেলার নিকলী ইউনিয়নে ঘোড়াউত্রা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

বরাক নদী হতে কুশিয়ারা নদীর উৎপত্তি হয়ে বদরপুর হয়ে অমলসিদ নামক স্থানে এসেছে এবং অমলসিদ থেকে নবীগঞ্জের ভিতরে প্রবেশ করে দিরাই হয়ে আজমিরীগঞ্জে এসে কালনী নাম ধারণ করে অষ্টগ্রামে ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হয়েছে। ধলেশ্বরী নদী মেঘণা নদীতে পতিত হয়েছে। নদীগুলোর গতির পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে হাওরের বিভিন্ন এলাকায় একেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে।

ফলে বর্ষাকালে প্রবাহ বেড়ে গেলে দুই পাশের প্লাবন ভূমি দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। লুপ তৈরি হওয়ার ফলে আউটার বেন্ড এলাকায় নদীর ভাঙন তীব্র হয়েছে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীতে পলি জমা, নদীর তীর ভাঙন অব্যাহত আছে। এরকম বউলাই, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদেরও বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙন দেখা দিচ্ছে। নদী ভাঙনের কারণে স্থানীয় জনসাধারণ বাড়িঘর, সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসানালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জায়গাজমি হুমকির সম্মুখীন।

অন্যদিকে খাল ভরাটের ফলে নিষ্কাশন ও নাব্যতা কমে যাচ্ছে, এতে বন্যার প্রকোশ বাড়ছে ও আগাম বন্যার ফলে হাওর এলাকায় কৃষকের ফসলহানি ঘটছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানি সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৯ সালে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top