বাজারের ব্যাগে বাছিরকে ২৫ লাখ টাকা দেন মিজান – আদালতে দুদক পরিচালক
আদালত প্রতিবেদকঃ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে বরখাস্ত পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরকে একটি বাজারের ব্যাগে ভরে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন বলে আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন মামলার বাদী শেখ মো. ফানাফিল্যা।
দুদকের পরিচালক ফানাফিল্যার জবানবন্দির মধ্য দিয়ে বুধবার আলোচিত এই ঘুষের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের কাছে বাদী মামলার এজাহারকে সমর্থন করে জবানবন্দি দিয়ে আসামিদের শাস্তি চান।
এ সময় তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদের পরিচয়সহ তাদের শনাক্ত করেন। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আস্তে ধীরে থেমে থেমে জবানবন্দি দেন তিনি।
সাক্ষ্যগ্রহণকালে মিজানুর রহমান ও এনামুল বাছিরকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
এদিন বিচারক বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সময়ের আবেদনে তাকে জেরা করা হয়নি। আগামী ২ সেপ্টেম্বর বাদীকে জেরা ও রাষ্ট্রপক্ষের অপর সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন রাখা হয়েছে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দুদক পরিচালক ফানাফিল্যা বলেন, “আসামি খন্দকার এনামুল বাছির দুদকের কর্মকর্তা হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিজানুর রহমানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার জন্য ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন। অপরদিকে মিজানুর রহমান সরকারি কর্মকর্তা হয়ে নিজের বিরুদ্ধে আনা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেন।”
এক নারীকে জোর করে বিয়ের পর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ ওঠায় গত বছরের জানুয়ারিতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় মিজানকে।
এর চার মাস পর তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক; এক হাত ঘুরে সেই অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির।
সেই অনুসন্ধান চলার মধ্যেই ডিআইজি মিজান গত ৮ জুন দাবি করেন, তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা বাছির।
এর সপক্ষে তাদের কথপোকথনের কয়েকটি অডিও ক্লিপ একটি টেলিভিশনকে দেন তিনি। ওই অডিও প্রচার হওয়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা।
অভিযোগটি অস্বীকার করে বাছির দাবি তখন করেন, তার কণ্ঠ নকল করে ডিআইজি মিজান কিছু ‘বানোয়াট’ রেকর্ড একটি টেলিভিশনকে সরবরাহ করেছেন।
অন্যদিকে ডিআইজি মিজান বলেন, সব জেনেশুনেই তিনি কাজটি করেছেন ‘বাধ্য হয়ে’।
ঘুষের অভিযোগ ওঠার পর তাদের দুজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত বছর ১৬ জুলাই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ শেখ মো. ফানাফিল্লাহ বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। এরপর ২২ জুলাই এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তার করে দুদকের একটি দল। আরেক মামলায় গ্রেপ্তার ডিআইজি মিজানকেও পরে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
শেখ ফানাফিল্যা বাদীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, “সরেজমিন অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, মিজানুর রহমান ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি বাজারের ব্যাগে করে ২৫ লাখ টাকা এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রমনা পার্কে মিলিত হন। আলোচনা শেষে রমনা পার্ক থেকে মিজানুরের গাড়িতে ওঠেন খন্দকার এনামুল বাছির।
“পরে গাড়িটি যখন শাহজাহানপুরে থামে তখন মিজানুর রহমান ২৫ লাখ টাকা এনামুল বাছিরের হাতে তুলে দেন। পরে এনামুল বাছির গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে রওনা হন।
“একইভাবে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মিজানুর রহমান তার আরদালি সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ে উত্তরার বাসা থেকে রওনা হন। পরে রমনা পার্কে তার সঙ্গে দেখা করেন বাছির। তারপর মিজানুরের গাড়িতে উঠে শান্তিনগরে আসেন এনামুল বাছির। তখন মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন এনামুল বাছির। এছাড়া এনামুল বাছির মিজানের কাছে একটি গাড়ি দাবি করেন। আর গাড়ি দাবি করার বিষয়টি লিখিতভাবে দুদকের কাছে স্বীকারও করেন বাছির।”
মামলার বাদী শেখ মো. ফানাফিল্যা বলেন, মিজান ও এনামুল বাছির বেআইনিভাবে অন্যের নামের দুটি সিম ব্যবহার করে নিজেরা এসএমএস আদান-প্রদান করতেন। একটি সিম কেনা হয় মিজানের বডিগার্ড হৃদয়ের নামে, আরেকটি সিম কেনা হয় মিজানের আরদালি সাদ্দামের নামে। মিজানের নির্দেশে একটি সিমসহ মোবাইল এনামুল বাছিরকে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে এসএমএস আদান- প্রদানের বিষয়টি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন (এনটিএমসি) মনিটরিং সেন্টারের ফরেনসিক কল রেকর্ডিংয়ে প্রমাণিত হয়। এভাবেই মিজানুর রহমান ও এনামুল বাছির ঘুষ লেনদেন করেছেন।
এই মামলায় গত ১৯ জানুয়ারি ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কেএম ইমরুল কায়েশ। এরপর তিনি অভিযোগ গঠনের তারিখ ঠিক করে মামলাটি ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বদলির আদেশ দেন।
গত ১৮ মার্চ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।